২০১৭ সালে ফেসবুকের প্রকাশিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, ফেসবুক মেসেঞ্জারে প্রতিদিন প্রায় ৫ বিলিয়নেরও বেশি ইমোজি আদান-প্রদান করেন এর ব্যবহারকারীরা। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে ইমোজি যেখানে চ্যাটিং, স্ট্যাটাস কিংবা কমেন্ট বক্সে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সেখানে ইমোজিবিহীন একটি যুগ ঠিক কতটা পানসে হতে পারতো সেই প্রশ্ন পাঠকের জন্য তোলা থাক।
টেক্সট মেসেজে কথোপকথন স্বাচ্ছন্দ্যে হলেও মনের আবেগ প্রকাশ করা একরকম দুঃসাধ্য। মানুষ প্রায় ৪৩টি মুখের পেশি ব্যবহার করে প্রায় ১০,০০০ রকমের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ যখন টেক্সট মেসেজের উপর নির্ভরশীল, তখন অপর পাশের মানুষটির সাথে ভুল বোঝাবুঝি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কারণ কথোপকথনের সাথে সাথে ডিভাইসের পর্দার অন্য পাশে থাকা মানুষটি কেমন অনুভব করছে সেটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সমস্যার সমাধানেই ডিজিটাল যুগে ইমোজির আবির্ভাব হয়েছিল।
কিন্তু কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে- কারা তৈরি করে এই ইমোজিগুলো? প্রতি বছর নতুন নতুন ইমোজিগুলো কীভাবে আসে? কখনো কি এমন ইমোজির প্রয়োজন অনুভব করেছেন যা নিয়ে এখনও কোনো ইমোজিই আসেনি? সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো- চাইলে আপনিও এই ডিজিটাল সভ্যতার ইতিহাসে নিজের চিহ্ন রেখে যেতে পারেন নতুন ইমোজি তৈরির মাধ্যমে। আপনার তৈরি সেই ইমোজি ব্যবহার করবে বিশ্বব্যাপী সবাই। কিন্তু কীভাবে? শুরু করা যাক ইমোজি যাত্রা। তবে শুরুতে অত্যন্ত সংক্ষেপে এর ইতিহাস জেনে নেয়া যাক।
ইমোজি শব্দটি জাপানী শব্দ, যার অর্থ ক্ষুদ্র চিত্রলিপি। ইমোজির পথচলা শুরু ১৯৯৭ সালে সফটব্যাংকের হাত ধরে (সেসময় জে-ফোন নামে পরিচিত)। ৯০টি ইমোজি ক্যারেক্টার সেট সম্বলিত স্কাইওয়াকার মোবাইল ফোন জাপানের বাজারে আনে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এর ব্যবহার কেবল সেই মোবাইলেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে জাপানের একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি এনটিটি ডোকোমোতে কর্মরত থাকা সিগেতাকা কুরিতা ১৭৬ সেটের ইমোজি তৈরি করেন সেই কোম্পানির মোবাইল ইন্টারনেট প্লাটফর্ম আই-মোডের জন্য।
এর মাধ্যমেই ইমোজি জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০০৮ সালে জাপানের বাজারে অ্যাপল আইওএস ২.২ এর সংস্করণে ইমোজি যুক্ত করে, যদিও তা বিশেষ হ্যাকের মাধ্যমে চালু করতে হতো। পরবর্তীতে আইওএস ৫ সংস্করণে ইমোজি বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
কিন্তু তখনও অন্যান্য কোম্পানির ব্যবহারের জন্য ইমোজি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ কোনো কোড ছিল না। গুগল এবং অ্যাপলের কিছু ইঞ্জিনিয়ারদের আবেদনের পর ২০০৯ সালে আংশিকভাবে কিছু ইমোজি ইউনিকোড ৫.২ সংস্কণে যুক্ত করা হয়। এরপর ২০১০ সালে ৬.০ সংস্করণে সম্পূর্ণভাবে ইমোজি ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজ’ করে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম। সেই সংস্করণে যুক্ত করা হয় ৯৯৪টি ক্যারেক্টার। ফলে গুগল মাইক্রোসফট অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো তাদের ওএস বা প্লাটফর্মে ইমোজি ‘ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড’ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এই ‘ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম’ কী?
১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হলো পৃথিবীর সকল ভাষার প্রতিটি অক্ষরকে একটি নির্দিষ্ট ক্যারেক্টার সিস্টেমে এনকোড করা। যার ফলে একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম এনকোডিং পদ্ধতি ব্যবহার না করে, বিশ্বব্যাপী সকল কম্পিউটিং ডিভাইস সেই গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড এনকোডিং মেনে চলতে পারে। অর্থাৎ, সহজভাবে বললে প্লাটফর্ম আলাদা আলাদা, কিন্তু যেকোনো ভাষার জন্য কম্পিউটারের বোধগম্য ক্যারেক্টার এনকোডিং একই।
ইউনিকোড ৬.০ সংস্করণে ইমোজি যুক্ত হবার পর থেকে প্রতি বছর নতুন ইমোজি যোগ করে আসছে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম। এখন পর্যন্ত ২০২০ সালে আসন্ন ১১৭টি নতুন ইমোজিসহ মোট ৩,৩০৪টি ইমোজি ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী এনকোড করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে মজার বিষয় হলো নতুন কোন ইমোজি আসবে তা সরাসরি ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম নির্ধারণ করে না। চাইলে যে কেউ নতুন কোনো ইমোজির জন্য আবেদন করতে পারে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে। অনেক যাচাই-বাছাই আর বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করে সবচেয়ে ভাল প্রস্তাবগুলো নতুন সংস্করণের জন্য নির্ধারিত হয়।
এই আবেদন প্রক্রিয়া সবার জন্যই উন্মুক্ত। তবে নতুন ইমোজির প্রস্তাব আবেদনের নিয়ম এবং তা বাছাই করার প্রক্রিয়া বেশ কঠোরতার সাথে মেনে চলে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম। এছাড়াও পার করতে হয়ে অনেকগুলো ধাপ।
শুরুতে খুঁজে বের করতে হবে এমন কোনো অনুভূতি বা বস্তু যা এখনও ইউনিকোড ইমোজি লিস্টে নেই। শুরুর এই ধাপ অতিক্রম করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তবে এর জন্য ইউনিকোডকেই কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা এযাবৎকালের গৃহীত এবং বাদ যাওয়া উভয় ইমোজির তালিকা তৈরি করে রেখেছে। কোনো কারণে বাদ যাওয়া ইমোজির তালিকা থেকে পছন্দ করে পুনরায় সে প্রস্তাব জানাতে পারেন আপনি। কিন্তু আপনাকে প্রথমে ইউনিকোডের ১৩টি শর্ত বা ‘সিলেকশন ফ্যাক্টরস’ একবার পড়ে নিতে হবে, যাতে বর্ণিত আছে আপনার প্রস্তাবিত ইমোজিটি কী কী শর্তে গৃহীত বা বর্জিত হতে পারে।
প্রস্তাবের জন্য ইমোজি পেয়ে গিয়েছেন? এবারে পালা প্রোপোজাল লেটার তৈরির, যেটি ইমেইল করতে হবে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে। এই পর্বের কাজটি আরেকটু কঠিন। কারণ আনুমানিকভাবে দশ পাতার একটি প্রস্তাব তৈরি করতে হবে যেখানে থাকবে প্রস্তাবিত ইমোজিটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আর নাম, কেন সেই ইমোজি মানুষ ব্যবহার করবে তার বর্ণনা, ইমোজিটি দেখতে কেমন হবে তার নমুনা হিসেবে আপনার তৈরি ডিজাইন আর ছবি (সাদা-কাল এবং রঙিন) এবং তথ্য-উপাত্ত। তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন ইমোজিটি সার্বিকভাবে কতটা জনপ্রিয় হবে তা বোঝানোর এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য। এজন্য ব্যবহার করা যেতে পারে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের গুগল ট্রেন্ড এবং গুগল ইমেজ ট্রেন্ড ডাটাশিটের স্ক্রিনশট। প্রোপোজাল লেটার তৈরি করতে ইউনিকোডের গাইডলাইনটি পড়ে ফেলতে হবে শুরুতেই।
প্রতি বছর প্রায় হাজারখানেক প্রস্তাব জমা হয় ইউনিকোডে। কিন্তু প্রস্তাবিত ইমোজিগুলোর মধ্যে এই প্রথমধাপে গৃহীত হয় খুবই কম সংখ্যক। কারণ এই ধাপেই বাদ পড়ে বেশিরভাগ প্রস্তাব। এর কারণ হিসেবে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের প্রেসিডেন্ট মার্ক ডেভিস উল্লেখ করেন প্রোপোজাল লেটারের অসম্পূর্ণতা এবং ইমোজি ডিজাইনকে। আমরা এই ক্ষুদ্র ছবিগুলো ব্যবহার করবো টেক্সট আকারে, যার ফলে এর সেগুলোর ডিজাইন হতে হবে পরিষ্কার এবং সাধারণ যাতে ক্ষুদ্র অবস্থাতেও তা বোঝা যায়। এবং বেশিরভাগ আবেদনকারীই এই বিষয়টি মাথাই রাখেন না।
প্রথমধাপ পার করার পর এবারে পালা যাচাই-বাছাইয়ের। দীর্ঘ এই যাচাই-বাছাই পর্বে লেগে যায় প্রায় দেড় বছর। গৃহীত ইমোজির প্রোপোজাল লেটার পুনরায় কিছু সংশোধনের প্রয়োজন পড়লে আবেদনকারীকে ইমেইল করা হয় এ পর্যায়ে। এবারে প্রথম ধাপে গৃহীত প্রস্তাবগুলোর তালিকা চলে যায় ইমোজি সাব-কমিটির কাছে। এখানে মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তী ধাপে কোন ইমোজিগুলো যাবে সেই বিষয়ে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে এই মিটিং পরিচালনা করা হয়।
এই ধাপ পার করলে এবারে ইউনিকোড টেকনিকাল কমিটি গৃহীত ইমোজিগুলোর জন্য কাঙ্ক্ষিত ইউনিকোড স্ট্যান্ডার্ড কোড নির্ধারণ করবে প্রতিটি ইমোজির জন্য। প্রস্তুতকৃত নতুন ইউনিকোড ইমোজি তালিকা এরপর পাঠিয়ে দেয়া হয় অ্যাপল, ফেসবুক, টুইটার, গুগল, মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর কাছে যাতে তারা নিজেদের পছন্দ অনু্যায়ী ইমোজি ডিজাইন করতে পারে মূল ইউনিকোড ডিজাইনের আদলে, যা আপনি প্রস্তাব করেছিলেন ।
প্রতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের দিকে কোম্পানিগুলো নিজেদের পণ্যের আপডেট নিয়ে আসে বাজারে যাতে থাকে নতুন গৃহীত হওয়া ইমোজিগুলোর সাপোর্ট। আর এই তালিকায় যদি আপনার প্রস্তাবিত ইমোজিটি থাকে তবে তা পৃথিবীজুড়ে মানুষের প্রিয় ইমোজিগুলোর একটি হয়ে উঠতে পারে।