মিলিয়নিয়ার হতে কী লাগে? অপরিসীম ধৈর্য, কঠোর অধ্যাবসায়, হার-না-মানা মানসিক দৃঢ়তা এসব তো আছেই, সেই সাথে প্রয়োজন মোটা অংকের মূলধনও। কিন্তু অনেক সময় খুব সীমিত মূলধনের মাধ্যমেও মিলিয়নিয়ার হওয়া সম্ভব, যদি আপনার কাছে থাকে খুব ভালো একটি আইডিয়া। ওই যে কথায় আছে না, একটি আইডিয়াই পারে আপনার জীবনকে বদলে দিতে, তা কিন্তু স্রেফ কথার কথা নয়। বাস্তবে এমন অজস্র দৃষ্টান্তের দেখা মিলবে। সেরকমই একটি দৃষ্টান্তের কথা আজ জানাব আপনাদেরকে।
আমাদের এই কাহিনীর নায়ক অ্যালেক্স টিউ। ২০ বছর বয়সে, ৫০ ইউরো বিনিয়োগ করে, মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে মিলিয়নিয়ার বনে গিয়েছিলেন তিনি। শুনতে অদ্ভুত ঠেকতে পারে, কিন্তু বাস্তবেই এমনটি ঘটেছিল, যার বদৌলতে অ্যালেক্স আজ ইন্টারনেট জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী। চলুন, আর দেরি না করে জেনে আসি তার কাহিনী।
২০০৫ সালের গ্রীষ্মকাল। ইংল্যান্ডের উইলশায়ারে নিজের (বাবা-মায়ের) বাসায় বসে আছেন অ্যালেক্স । তার মাথায় তখন ঘুরছে কেবল অর্থের চিন্তা। নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে তিন বছরের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হতে চান তিনি। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ, যা তার সাধ্যের বাইরে। তাই হাল ছেড়ে দেয়া, কিংবা নিজের লক্ষ্যমাত্রাকে কিছুটা নিচে নামিয়ে আনাই হতো তার বয়সী অন্য অধিকাংশ তরুণের পরবর্তী পদক্ষেপ। কিন্তু অ্যালেক্স তা করলেন না। বরং তিনি সামনে থাকা প্যাডের উপর লিখলেন, “How to become a millionaire.” এবং এরপর ভাবতে বসলেন, আসলেই কীভাবে একজন মিলিয়নিয়ার হয়ে যাওয়া যায়, যাতে করে তার আর কোনো অর্থকষ্টই থাকবে না।
মিনিট বিশেকের মধ্যেই অ্যালেক্স পেয়ে গেলেন তার প্রশ্নের উত্তর। তিনি একটি ওয়েবসাইট বানাবেন, আর সেটিই তাকে এনে দেবে এক মিলিয়ন ডলার। আজকের দিনে একটি ওয়েবসাইট থেকে মিলিয়ন ডলার আয় করা হয়তো তেমন ব্যাপারই না। কিন্তু ভুলে যাবেন না, আমরা বলছি ২০০৫ সালের কথা, যখন ইন্টারনেট দুনিয়া এখনকার মতো এত বেশি লাভজনক হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া অ্যালেক্স ছিলেন একা। একা একজন মানুষের পক্ষে ওয়েবসাইট থেকে মিলিয়ন ডলার উপার্জন করা কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু অ্যালেক্স বাস্তবিকই সেই উদ্যোগ শুরু করলেন। যে ওয়েবসাইটটি তিনি তৈরি করলেন, সেটির নাম দিলেন দ্য মিলিয়ন ডলার হোমপেজ।
সাইটটির নকশা ছিল খুব বেশিই সহজ: সাইটের হোমপেজে থাকবে এক মিলিয়ন পিক্সেলের অ্যাড স্পেস। ১০×১০ পিক্সেল তথা ন্যূনতম ১০০ পিক্সেল ব্লকে অ্যাড স্পেসগুলো বিক্রি করা হবে, যেখানে প্রতি পিক্সেলের জন্য ধরা হবে ১ ডলার করে। অর্থাৎ একজন বিজ্ঞাপনদাতা সর্বনিম্ন ১০০ ডলারের বিনিময়ে আজীবনের জন্য অ্যালেক্সের ওয়েবসাইটের হোমপেজে নিজের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করতে পারবে। শুধু একটাই শর্ত, প্রতিষ্ঠানটি পর্নোগ্রাফির হলে চলবে না। আর এভাবে যখন এক মিলিয়নতম পিক্সেলটি বিক্রি হয়ে যাবে, অ্যালেক্সও তখন বনে যাবেন একজন মিলিয়নিয়ার।
এমন পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে চললেন অ্যালেক্স। ৫০ ইউরো খরচ করলেন তিনি সাইটের ডোমেইন নিবন্ধন এবং হোস্টিং সেটিংয়ের পেছনে। এবং ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল মিলিয়ন ডলার হোমপেজ। ওয়েবসাইট চালুর তিনদিন পর অ্যালেক্সের এক বন্ধু ২০×২০ তথা ৪০০ পিক্সেল ব্লকের অ্যাড স্পেস কিনলেন তার মিউজিক ওয়েবসাইটের জন্য। মূলত তিনি যা করলেন তা হলো, ক্রয়কৃত পিক্সেলের জায়গাটুকুতে নিজের ওয়েবসাইটের একটি লোগোসদৃশ ছবি বসালেন, সেটির সাথে নিজের ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসের হাইপারলিংক জুড়ে দিলেন, এবং সাথে যোগ করলেন সামান্য কিছু কথা লেখা টেক্সটও, যা ছবির উপর কার্সর আনলে দেখানো হবে। প্রথম দুই সপ্তাহে অ্যালেক্সের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা মিলে তার কাছ থেকে কিনলেন সর্বমোট ৪,৭০০ পিক্সেলের অ্যাড স্পেস।
শুরুতে অ্যালেক্স তার এই ওয়েবসাইটের জন্য কোনো প্রচারণার ব্যবস্থাই করেননি। স্রেফ মুখের কথার জোরে কাছের মানুষজনের কাছে পিক্সেল বিক্রি করছিলেন তিনি। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে কিছু হচ্ছে না। তাই বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ৪,৭০০ ডলার কাজে লাগিয়ে তিনি একটি পিআর এজেন্সি ভাড়া করলেন গণমাধ্যমে পাঠানোর জন্য একটি প্রেস রিলিজের ব্যবস্থা করতে। এবং কী সৌভাগ্য, প্রেস রিলিজটি প্রকাশ করে দিল বিবিসি ও গার্ডিয়ানের মতো ওয়েবসাইট। যেদিন প্রেস রিলিজটি প্রকাশিত হলো, শুধু সেদিনই অ্যালেক্স আয় করে ফেললেন ৩,০০০ ডলার। অর্থাৎ পিআর এজেন্সির পেছনে ব্যয় করা অর্থ বৃথা গেল না। এছাড়া প্রযুক্তি সংবাদ বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য রেজিস্টারও মিলিয়ন ডলার হোমপেজকে নিয়ে দুটি আর্টিকেল প্রকাশ করল। সেগুলোর মাধ্যমে প্রযুক্তি দুনিয়ায় অ্যালেক্সের নাম আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল।
সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই অ্যালেক্স তার ওয়েবসাইট থেকে আয় করে ফেললেন আড়াই লক্ষ ডলার। অক্টোবরের মধ্যে তার আয় ছাড়াল ৫ লক্ষ ডলার, এবং ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত তিনি বিক্রি করলেন ৯ লক্ষ ৯৯ হাজার পিক্সেল। ততদিনে তার গ্রাহক তালিকায় যোগ হয়েছে যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস পত্রিকা, ট্র্যাভেল সার্ভিস চিপফ্লাইটস ডট কম, রক ডুয়ো টেনাসিয়াস ডি, এমনকি অনলাইন পোর্টাল ইয়াহুও।
২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি অ্যালেক্স ঘোষণা দিলেন, তার ওয়েবসাইটের শেষ এক হাজার পিক্সেলের জন্য প্রচুর আগ্রহী ক্রেতা দেখা যাচ্ছে। তার পক্ষে সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। যদি তিনি তা করতে চান, তাহলে তাকে দ্বিতীয় একটি মিলিয়ন ডলার হোমপেজ খুলতে হবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে মিলিয়ন ডলার হোমপেজ কনসেপ্টটিই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। তাই সবচেয়ে যৌক্তিক বিষয় হবে নিলামের মাধ্যমে ওয়েব সাইটের শেষ এক হাজার পিক্সেল কোনো একজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করা। সে অনুযায়ী ইবে-তে নিলামের আয়োজন করলেন তিনি। দশদিন ধরে চলল সেই নিলাম, যেখানে অংশ নিল ৯৯ জন বৈধ বিডার। শেষ পর্যন্ত নিলামে জিতে ৩৮,১০০ ডলারে শেষ এক হাজার পিক্সেল কিনে নিল মিলিয়ন ডলার ওয়েট লস ডট কম নামক একটি ওয়েবসাইট।
সব মিলিয়ে সাড়ে চার মাসে মিলিয়ন ডলার হোমপেজ থেকে অ্যালেক্স আয় করলেন ১০,৩৭,১০০ ডলার। কর বাবদ কর্তন এবং দ্য পিন্স’স ট্রাস্ট নামক একটি দাতব্য সংস্থাকে কিছু অনুদানের পর, অ্যালেক্সের হাতে অবশিষ্ট থাকল ৬,৫০,০০০ থেকে ৭,০০,০০০ ডলারের মতো।
এরপর ১৩ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু অ্যালেক্সের মিলিয়ন ডলার হোমপেজ ওয়েবসাইটটি কিন্তু এখনো আছে। এখনো ওয়েবসাইটটিতে দৈনিক ঢুঁ মারে কয়েক হাজার ভিজিটর, এবং তারা দেখতে পায় হাজার হাজার বিজ্ঞাপন। অবশ্য মিলিয়ন ডলার হোমপেজে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনসমূহের ৪০% লিংকই এখন মৃত। সেসব লিংকে ক্লিক করলে এখন ব্রাউজারে ব্ল্যাঙ্ক পেজ প্রদর্শিত হয়। হয়তো সেসব লিংকের ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন পরিবর্তিত হয়েছে, কিংবা প্রকৃত ইউআরএল নতুন মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এমনও হতে পারে যে অনেকগুলো বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান হয়তো এতদিনে বন্ধই হয়ে গেছে।
তবে সে যা-ই হোক, অ্যালেক্সের লক্ষ্য ছিল মিলিয়নিয়ার হওয়া, এবং মাত্র ৫০ ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমে, অসাধারণ একটি আইডিয়ার বদৌলতে তিনি কিন্তু ঠিকই সেই লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়েছেন, আয় করেছেন এক মিলিয়ন তথা ১০ লক্ষ ডলার। আরো অনুপ্রেরণাদায়ী বিষয় হলো, অ্যালেক্স কোনো ‘ওয়ান হিট ওয়ান্ডার’ ছিলেন না। অর্থাৎ তার পথচলা একটি অবিশ্বাস্য সাফল্যেই শেষ হয়ে যায়নি। তিনি এখনো বেশ ভালোভাবেই আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন অনলাইন জগতে। তবে এর আগে একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পার করতে হয়েছে তাকে।
যে ইউনিভার্সিটি কোর্সের জন্য মিলিয়নিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অ্যালেক্স, সেই কোর্স সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ড্রপ-আউট হয়েছিলেন তিনি। এরপর পিক্সেলোট্টো, ওয়ান মিলিয়ন পিপল, পপজ্যাম প্রভৃতি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি, যেগুলো প্রতিটিই ছিল কোনো না কোনোভাবে মিলিয়ন ডলার হোমপেজের আইডিয়ার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এসব নতুন উদ্যোগে সফল হতে পারেননি তিনি। এরপর তিনি চলে যান স্যান ফ্রান্সিসকোতে এক বন্ধুর কাছে।
ঐ সময়টা খুব বাজে গেছে অ্যালেক্সের জন্য। তিনি ঠিকমতো খেতে পারতেন না, ঘুমাতে পারতেন না, এমনকি মেডিটেশনও করতে পারতেন না। একের পর এক ব্যর্থতায় প্রচন্ড রকম ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেছিলেন তিনি। মানবজীবনের প্রাত্যহিক এসব হতাশা ও বিষাদ দূর করতেই এরপর তিনি প্রথমে শুরু করেন ডু নাথিং ফর টু মিনিটস নামক একটি ওয়েবসাইট, এবং তারপর মোটামুটি মরিয়া হয়ে, দেড় মিলিয়ন ডলার জোগাড় করে ২০১২ সালে চালু করেন Calm ওয়েবসাইটটি। পরের বছর এটির অ্যাপও প্রকাশ করেন। অ্যাপটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও ২০১৩ সালে অ্যাপটি আয় করেছিল মাত্র ১ লক্ষ ডলার, কিন্তু ২০১৫ সালের মধ্যেই অ্যাপটির লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ মিলিয়ন (২০ লক্ষ) ডলারে।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও সে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষ আরো বেশি করে ব্যবহার শুরু করে অ্যাপটি। ফলে ঐ বছর অ্যাপটি থেকে আয় হয় ৭ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে অপ্রত্যাশিতভাবেই অ্যাপটি জিতে নেয় অ্যাপলের বর্ষসেরা অ্যাপের খেতাব, যার ফলে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত অ্যাপটি মোট লাভ করে ৩৭ মিলিয়ন ডলার। অ্যাপটির এই তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে প্রচুর নতুন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসতে থাকে, এবং ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর মূল্যমান দাঁড়ায় এক বিলিয়ন ডলারে।
আধুনিক সময়ে প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা বেড়ে চলেছে, আর তার কার্যকরী সমাধান হিসেবে কাজ করছে Calm। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এই অ্যাপটি যে জনপ্রিয়তা হারাবে না, সে কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। আর এভাবেই, মাত্র সাড়ে চার মাসে মিলিয়নিয়ার বনে যাওয়া তরুণটি হয়তো একদিন বিলিয়নিয়ারদের তালিকায়ও নাম লেখাবেন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/