সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে মোবাইলটা হাতে নিয়েই ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রাম ঘাটাঘাটি করা শুরু করলেন। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলেন যে, আপনার সাথে পড়ে এমন এক বন্ধুর বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর বেড়ে গেছে। এমনকি আপনার চেয়ে ছোট মেয়েটিও হঠাৎ বুড়ো হয়ে গেছে। ব্যাপারটা রীতিমতো আপনাকে ভীত করে ফেলল। তাহলে কি আপনি এক বা দুই যুগ ধরে গভীর কোনো ঘুমে ছিলেন? নাকি টাইম মেশিনে করে চলে এসেছেন ভবিষ্যতে?
না, এতটা উদ্ভট ঘটনাও আপনার সাথে ঘটেনি। আপনি আসলে এমন একটা সময়ে বাস করছেন যেখানে ‘ফেসঅ্যাপ’ নামক একটি অ্যাপের প্রচলন রয়েছে, যা কিছুটা উদ্ভট হলেও বেশ মজার। সাধারণ মানুষও বেশ উৎসাহের সাথে এটি ব্যবহার করছে। সত্যি বলতে, অতিরিক্ত ব্যবহার করছে। অ্যাপটা নিতান্তই মন্দ নয়। বুড়ো হলে আপনাকে দেখতে কেমন লাগবে বা আপনার বন্ধুকে দেখতে কেমন লাগবে তা এখনই দেখে নিচ্ছেন। স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো এই অ্যাপের ব্যবহার কিংবা জনপ্রিয়তার কারণও একই। অন্যরকম একটি অ্যাপ যা আগে কখনো দেখা যায়নি। বিনোদন বা সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের ভিন্নরূপের ছবি আপলোড দেওয়ার জন্যও অ্যাপটা বেশ ভালোই। সেজন্য খুব কম সময়ের মধ্যে ‘অতিরিক্ত পরিচিতি’ লাভ করে ফেসঅ্যাপটি। তবে গণ্ডগোল তখনই বাঁধে, যখন আমজনতা জানতে পারে যে এই অ্যাপ বিনোদনের মাধ্যম সেজে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ নকল বুড়ো সাজার পর সত্যি সত্যি বয়স না বাড়লেও এখন আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে কী করা হবে তা ভাবতে ভাবতে বয়সটা ঠিকই বাড়বে।
সম্প্রতি ফেসঅ্যাপ খ্যাতি কিংবা কুখ্যাতির তুঙ্গে থাকলেও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আরো দুই বছর আগে। অর্থাৎ ২০১৭ সালে। তখন যে অ্যাপটির শুধু খ্যাতি ছিল ব্যাপারটা কিন্তু সেরকমও নয়। ফেসঅ্যাপের প্রতিটা ফিল্টার প্রথমদিকে অ্যাপটির জন্য জনপ্রিয়তা এনে দিলেও পরবর্তীতে কুখ্যাতিই বয়ে নিয়ে এসেছে। অ্যাপটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি কোম্পানি ‘ওয়্যারলেস ল্যাব’ তৈরি করে। মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অ্যাপটি মানুষের চেহারার পরিবর্তন দেখাতে সক্ষম হয়।
পুরুষের চেহারা নারীদের মতো এবং নারীদের চেহারা পুরুষদের মতো পরিবর্তন করে নিতে পারবেন। অবশ্য কিছু বিতর্কিত ফিল্টারও চালু করেছে ফেসঅ্যাপ। যে বছর এটি চালু করা হয় সেই বছরই অ্যাপে বর্ণবাদী ফিল্টার অন্তর্ভুক্ত করার কারণে ফেসঅ্যাপকে জনগণের সমালোচনার স্বীকার হতে হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই কয়েক মাসের মাথায় ‘এথনিসিটি চেঞ্জ’ ফিল্টার চালু করে।
এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ‘কৃষ্ণাঙ্গ’, ‘ভারতীয়’ কিংবা ‘এশিয়ান’ এর রূপ ধারণ করতে পারবে। জাতিগত ভাবানুভূতিতে আঘাত লাগার কারণে আবারও কঠোরভাবে সমালোচিত হয় ফেসঅ্যাপ। এসব নিন্দার গণ্ডি পার করে এবার বেশ খ্যাতি লাভ করতে শুরু করলেও তা আর স্থায়ী হলো না। সম্প্রতি বুড়ো হওয়ার ফিল্টার চালু করেই বাজিমাত করে ফেলে ফেসঅ্যাপ। অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন না করে চেহারায় শুধুমাত্র বয়সের ছাপটাই দেখায়। অতিরিক্ত এবং অবাস্তব কোনো রুপ দেখায় না বলে সবার কাছে ভালোই লাগে অ্যাপটি।
প্রথম প্রথম ফিল্টার ব্যবহার করে সবাই বুড়ো সেজে খুশি থাকলেও ব্যক্তিগত তথ্য চুরির ব্যাপার সামনে আসলে আবারও জনপ্রিয়তা হারায় ফেসঅ্যাপ। ১২১টি দেশের আইওএস অ্যাপ স্টোরের প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে অ্যাপটি। এর মধ্যেই ফেসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ছবি এডিট করা হয়েছে। আর অনেকেই ধারণা করছেন, এসব ছবি নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করবে অ্যাপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে এই দাবি করেন অ্যাপ ডেভেলপার জোশুয়া নোজি। তিনি টুইট করে জানান, ফেসঅ্যাপ একজন ব্যক্তির অনুমতি ছাড়াই তার স্মার্টফোনে জমা থাকা ছবিগুলো ব্যবহার করছে। এলিওট অ্যালডারসন নামক ছদ্মনামধারী ফরাসি সাইবার সিকিউরিটি রিসার্চার জোশুয়া নোজির দাবি খতিয়ে দেখা শুরু করে। এতে তার প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক আপলোড করা ছবি ছাড়া মোবাইলে থাকা অন্য ছবির অ্যাক্সেস পায় না ফেসঅ্যাপ। কিন্তু এর মানে এই না যে ফেসঅ্যাপ পুরোপুরি নিরাপদ।
ফেসঅ্যাপ নিয়ে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো আপনি আপনার ছবি ব্যবহারের জন্য চিরকালের অনুমতি দিয়ে দিচ্ছেন কোম্পানিটিকে। এমন এক অনুমতি দিয়ে দিলেন যা আপনি পরবর্তীতে প্রত্যাহারও করতে পারবেন না। বিশ্বব্যপী তথা বিশ্বের যেকোনো দেশে ছবি ব্যবহারের অনুমতিই মূলত দিচ্ছেন। আর আপনি হয়তো জানতেও পারবেন না যে আপনার ছবি কোন কাজে এবং কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসঅ্যাপের নিজস্ব তথ্য মোতাবেক ৯৯% ফেসঅ্যাপ ব্যবহারকারীকে লগ ইন করতে হয় না। ফলে কোন ছবি কার তা চট করেই বের করা সম্ভব নয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ফেসঅ্যাপ ব্যবহার করে আপনি আপনার যে ছবি এডিট করছেন তা যে আপনার সেটা খুঁজে বের করারই মাধ্যম নেই। ফলশ্রুতিতে, বেনামী ছবিকে নিজেদের প্রয়োজনে তথা বাণিজ্যিক কাজে আপন মনেই ব্যবহার করার লাইসেন্স পেয়ে যাবে ফেসঅ্যাপ।
আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, আপনি যে ছবি এডিট করার জন্য অ্যাপটি ব্যবহার করছেন সেই ছবি স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ না করে ক্লাউডে জমা করা হচ্ছে। যদিও ফেসঅ্যাপ দাবি করেছে যে এই কাজটি শুধুমাত্র এর উন্নতি বা বিস্তৃতি দেখার জন্যই ব্যবহৃত হয় এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বেশিরভাগ ছবি ক্লাউড থেকে ডিলিট তথা মুছে ফেলা হয়। তবে আসলেই ছবিগুলো গুগল ক্লাউড এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভার থেকে ডিলিট হয় নাকি তার কোনো স্বচ্ছ প্রমাণ নেই। ডিলিট না করলেও জানার উপায় নেই। অনেকের ধারণা, শুধু এডিট করার নিমিত্তে ব্যবহৃত ছবিই নয়, বরং মোবাইলের গ্যালারিতে থাকা সব ছবিই গোপনে নিয়ে নিচ্ছে ফেসঅ্যাপ। বলা হচ্ছে, ফেসঅ্যাপ ইনস্টল করা মাত্রই আপনার নাম, ইউজার নাম কিংবা যেকোনো মিডিয়া ফরম্যাটে থাকা আপনার তথ্য চলে যায় অ্যাপটি পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। টেকক্রাঞ্চের মতে, অ্যাপলের আইওএস প্লাটফর্মে ইউজার ফটো পারমিশনে ‘নেভার’ অপশন ক্লিক করলেও ইউজারের গ্যালারিতে অ্যাক্সেসটা আপনাআপনি পেয়ে যায় ফেসঅ্যাপ। অর্থাৎ আপনি কী চান তা নিয়ে বেশি একটা মাথাব্যথা নেই তাদের। আপনার তথ্য যে ব্যবহার করছে তার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণও পাবেন না।
ফেসঅ্যাপের প্রাইভেসি পলিসিতে বলা হয়েছে যে, এটি ‘থার্ড-পার্টি অ্যানালাইটিক টুল’ ব্যবহার করে যা আপনার বিভিন্ন তথ্য, যেমন- কোন কোন ওয়েবপেইজ আপনি ভিজিট করেছেন তা কোম্পানির কাছে পৌঁছে দেয়। কোম্পানির মতে নিজেদের সার্ভিস আরো উন্নত করতে ইউজারের কিছু তথ্য তাদের প্রয়োজন হয়। তারা দাবি করেছে, এসব তথ্য তৃতীয় কোনো পক্ষকে ধার দেওয়া হয় না কিংবা বিক্রি করা হয় না। আর এখানেই মূল গণ্ডগোল। দুই রকম কথা বলার কারণে পলিসির স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ফরাসি সিকিউরিটি রিসার্চার ব্যাপ্টিস্ট রবার্টও এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তবে তিনি এটাও বলেন যে, মোবাইলের গ্যালারির ছবি আসলেই তারা নিজেদের সার্ভারে আপলোড করে নাকি তা নিয়ে স্বচ্ছ কোনো প্রমাণ নেই। রবার্টের মতে, সন্দেহের আরেকটা কারণ হলো অ্যাপটি ‘জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন’ (জিডিপিআর) এর অনুবর্তী নয়। কোনো চিন্তার বিষয় না থাকলে কোন অ্যাপটি জিডিপিআর এর সাথে সংযুক্ত নয় তা ভাবার বিষয়। এজন্য এই অ্যাপের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় জাগছে সবার মনে।
অবশ্য নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার বিষয় আসলে তো শুধু ফেসঅ্যাপ না, বরং ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট সবকিছু নিয়েই সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রবার্টের মতে, যেকোনো অ্যাপেই ছবি আপলোড করা বিপজ্জনক। তবে ফেসঅ্যাপের ব্যাপার-স্যাপার একেবারেই অস্পষ্ট। এর সাথে থাকা ঝুঁকিও অস্পষ্ট। তাই এই বিষয়ে চিন্তা করাটাও স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে সিনেটের মাইনরিটি লিডার চাক শুমার এফবিআই এবং এফটিসিকে ফেসঅ্যাপ বিষয়ে তদন্ত করতে বলেছেন। এখন দেখা যাক এর ফলাফল কী দাঁড়ায়। ১৫০ মিলিয়ন ছবি দিয়ে আসলেই কিছু করা হচ্ছে নাকি সেই রহস্য জানা এখনও বাকি।