২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ thefacebook.com ওয়েব এড্রেসটি রেজিস্ট্রেশন করে নিলেন এক বছরের জন্য। তার বন্ধু-বান্ধবরা একে আলাদা করে গুরুত্ব দেয়নি তেমন। মার্কের ওয়েব-প্রোগ্রাম তৈরির অভ্যাসের সাথে তারা আগে থেকেই পরিচিত। ফেসম্যাশ নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরির কারণে একবার বেশ ভালো রকমের ঝামেলায়ও পড়েছিলেন তিনি (সে গল্প পড়ুন এখানে)। এই নতুন ‘দ্য ফেসবুককেও তাই তার বন্ধুরা সেরকমই কোনো প্রজেক্ট ভেবে রেখেছিল।
‘ফেসবুক’ নামটি মূলত ছিল হার্ভার্ডের প্রত্যেক হাউজে রাখা ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ছবির তালিকার। ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকদিন ধরেই কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করে এসেছিল, ফেসবুকের একটি অনলাইন সংস্করণ তৈরি করার জন্যে। যাতে তারা সবার প্রোফাইল ঘুরে দেখতে পারে। কিন্তু হার্ভার্ড বারবার আশ্বাস দিয়েও দাবিটি পূরণ করছিল না। ছাত্র-ছাত্রীরা জানতো এটি তেমন কঠিন কিছু নয়। কারণ ফ্রেন্ডস্টার, মাইস্পেসের মতো যোগাযোগ মাধ্যম ততদিনে চলে এসেছিল ইন্টারনেটে।
মার্ক নিজেও ফ্রেন্ডস্টার ব্যবহার করতেন। তার নতুন রেজিস্ট্রেশন করা সাইটে ফ্রেন্ডস্টারের থেকে বেশ কিছু আইডিয়া ধার করার চিন্তাও করেছিলেন তিনি। ফ্রেন্ডস্টার ছিল মূলত ডেটিং ওয়েবসাইট। ব্যবহারকারীরা নিজেদের মিউচুয়াল ফ্রেন্ডদের মধ্য থেকে সঙ্গী খুঁজে নিতে পারতেন। এসব দেখে শুনে হার্ভার্ডের ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্য ছিল, “স্যান ফ্রান্সিসকোর একজন ব্যক্তি যদি ফ্রেন্ডস্টার বানিয়ে ফেলতে পারে, তবে হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ কি একটি সাধারণ অনলাইন ফেসবুক বানাতে পারে না?”
এ বিষয়ে একটি আর্টিকেল ছাপা হয় হার্ভার্ডের পত্রিকা ‘ক্রিমসন’-এ। সেখানে অনলাইন ফেসবুক বানানোর তাগিদই দেওয়ার পাশাপাশি সেটি কীরকম হওয়া উচিৎ সে বিষয়ক দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের প্রোফাইলে নিজের ছবি, তথ্য নিজের মতো করে যুক্ত করার সুযোগ দেওয়ার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল।
ক্যাম্পাসে সবাই যখন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব দাবি জানাতে ব্যস্ত, মার্ক তখন নিজেই একটি ফেসবুক বানিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে বসলেন। কর্তৃপক্ষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর এ সুযোগটি হারাতে চাইলেন না তিনি। ক্রিমসনের আর্টিকেলটি বেশ কাজে আসলো তার। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের প্রোফাইল নিজে তৈরি করা ও ফ্রেন্ডস্টারের মতো অন্যের সাথে যুক্ত হওয়ার সুবিধা নিয়ে হাজির হলো তার ‘দ্য ফেসবুক’।
আরেকটি প্রোগ্রাম থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন জাকারবার্গ। তখনকার দিনে AIM নামের একটি মেসেজিং সার্ভিস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এতে কেউ অনলাইনে না থাকলে তার প্রোফাইলে কয়েক লাইনের একটি বার্তা দেখানোর অপশন ছিল। ব্যবহারকারীরা সেখানে নিজেদের সৃজনশীলতার ছাপ রাখতেন। কেউ ছোট কাব্যিক লেখা বা হাস্যরস যোগানো কোনো বার্তা, কেউ আবার রাজনৈতিক বার্তাও লিখে রাখতেন। বর্তমান ফেসবুকের স্ট্যাটাস আপডেটের যে সুবিধাটি আছে, তার অনুপ্রেরণা জাকারবার্গ সেখান থেকেই পেয়েছেন।
মার্কের তৈরি করা আগের ওয়েবসাইটগুলো সব তার ব্যক্তিগত ল্যাপটপ থেকেই হোস্ট করা হতো। হার্ভার্ডের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেগুলো চালাতেন তিনি। কিন্তু ‘দ্য ফেসবুক’কে তিনি হার্ভার্ডের আওতার বাইরে রাখতে চাইছিলেন। তাই Manage.com নামের একটি হোস্টিং কোম্পানির কাছ থেকে মাসিক ৮৫ ডলারের বিনিময়ে কম্পিউটার সার্ভারের সুবিধা নেন তিনি।
ওয়েবসাইটটি মূলত শুরু হয়েছিলো হার্ভার্ডের ছেলেমেয়েদের নিজেদের মধ্যে তথ্যাদি শেয়ার করার সুযোগ করে দিতে। ছেলে-মেয়েরা যাতে আরো সহজে জানতে পারে কী ঘটছে তাদের শিক্ষায়তনে। এটি এদিক দিয়ে একদম নতুন ছিল, অন্যগুলোর মতো ডেটিংয়ের জন্যে সঙ্গী খোঁজার জন্য নয়, বরং সাধারণ যোগাযোগের সুবিধা করে দেয়।
জাকারবার্গের মনে সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল যে, এটি হয়তো একসময় আরো বড় কিছু হয়ে উঠতে পারে। এজন্যই তিনি চুক্তি করেছিলেন তার সহপাঠী এডুয়ার্ডো স্যাভেরিনের সাথে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে জানাশোনা ছিল স্যাভেরিনের। তাকে ফেসবুকে বিনিয়োগ করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান মার্ক। এছাড়া ফেসবুক সফল হলে একে কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান করে তোলা যায় সে উপায় খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। তারা দুজনেই ১,০০০ ডলার করে বিনিয়োগ করেন ফেসবুকে।
২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, মার্ক জাকারবার্গ তার ম্যানেজ ডট কম-এর লিঙ্কে ক্লিক করেন। ‘দ্য ফেসবুক’ জীবন্ত হয়ে ওঠে অনলাইনে। এর চার নাম্বার ব্যবহারকারী হিসেবে নিবন্ধন করেন তিনি। প্রথম তিনটি একাউন্ট ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। পাঁচ নাম্বারে তার রুমমেট হিউজেস, ৬ নাম্বারে তার স্যুট-মেট মস্কোভিস ও সাত নাম্বারে স্যাভেরিনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে ওয়েবসাইটটি।
তার বন্ধু অ্যান্ড্রু ম্যাককলাম একটি লোগো ডিজাইন করেন ফেসবুকের জন্য। ইন্টারনেট থেকে আল পাচিনোর একটি ছবি নামিয়ে সেটিকে বাইনারি অঙ্ক ‘ওয়ান ও জিরো’র মেঘে ঢেকে দিয়ে তৈরি হয় এর প্রথম লোগো। এরপরে শুরু হয় প্রচারণা চালানো। হার্ভার্ডে মার্কের আবাসস্থল কার্কল্যান্ড হাউসের তিনশ ছাত্রের মেইলে ফেসবুকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ চলে যায়। শুরু হয় যায় এর বিস্তার, যা আজও চলছেই।
চারদিনের মধ্যে ৬৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ফেসবুকে যোগ দেয়। পরের দুই দিনে খোলা হয় আরো তিনশটি একাউন্ট। শীঘ্রই হার্ভার্ডের খাওয়ার টেবিলে, ক্লাসের ফাঁকে সবার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে মার্কের ফেসবুক। তারা এটি ব্যবহার করা থামাতেই পারছিল না যেন। এক সপ্তাহ পেরিয়ে যেতে না যেতে হার্ভার্ডের অর্ধেক শিক্ষার্থীই ফেসবুক ব্যবহারকারী হয়ে ওঠে। যুক্ত হয় অনেক প্রাক্তন ছাত্র ও কর্মকর্তারাও।
সেসময়ের ফেসবুকের প্রোফাইলও ছবি, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস, পছন্দের বই, সিনেমার তালিকা ও কে কোন ক্লাবে আছে সেসব তথ্যাদি যুক্ত করা যেত। এছাড়া নিজের রাজনৈতিক ঘরানা ও যোগাযোগ বিষয়ে তথ্য যোগ করা যেত। আরো যোগ করা যেত কে কোন কোর্স নিচ্ছে সে তালিকা, এটি জাকারবার্গের আগের একটি জনপ্রিয় প্রজেক্ট ‘কোর্স-ম্যাচ’-এর থেকে অনুপ্রাণিত ছিল।
প্রথম থেকেই প্রাইভেসির বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে নেন জাকারবার্গ। একাউন্ট খুলতে বাধ্যতামূলকভাবে Harvard.edu- এর ইমেইল এড্রেস, ব্যবহার করতে হতো। প্রয়োজন হতো আসল নামেরও। তখনকার ইন্টারনেটে ছদ্মনামের যুগে এটি ফেসবুককে সম্পূর্ণ আলাদা করে তোলে। কে কার তথ্যাদি দেখতে পারবে তা-ও নিয়ন্ত্রণ করা যেত তখন। এখনকার ‘ফ্রেন্ডস/ফ্রেন্ডস অব ফ্রেন্ডস/পাবলিক’ ইত্যাদির বদলে তখন ছিল- ‘সকল ছাত্ররা/কেবল নিজ ক্লাসের ছাত্ররা/কেবল নিজ হলের ছাত্ররা’ ইত্যাদি অপশন।
ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ স্রেফ বিনোদনের জন্যে ফেসবুককে কাজে লাগাতে থাকে। কেউ আবার একে কাজে লাগাতে থাকে ভিন্ন প্রয়োজনে। সবাইকে কোনো নোটিস জানানো, পড়াশোনার জন্যে গ্রুপ তৈরি করা, ক্লাবের মিটিং সারার জন্যে ব্যবহৃত হতে থাকে ফেসবুক। এছাড়া এর কোর্স যুক্ত করার অপশনটিও বেশ কাজে আসে ছাত্র-ছাত্রীদের। কোর্স বাছাই করার সময় কে কোন কোর্সে আছে তা জানার জন্যে ফেসবুক বেশ ভালো মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এভাবে হার্ভার্ডের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র মিলিয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে ফেসবুকের সদস্য সংখ্যা ছয় হাজারে গিয়ে পৌঁছায়। জাকারবার্গ বুঝতে পারেন, প্রযুক্তিগত দিকটা তার একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে না আর। তার বন্ধু মস্কোভিস এগিয়ে এলেন। অর্থনীতির ছাত্র মস্কোভিস প্রোগ্রামিং করতে জানতেন না। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। রাতদিন লেগে থেকে প্রোগ্রামিং শিখতে থাকলেন। মার্ক মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন তাকে নিয়ে। কিন্তু মস্কোভিস প্রচণ্ড রকমের অধ্যবসায়ী ছিলেন। অবশেষে তাকে ফেসবুকে নিয়ে নতুন চুক্তি হয়। এটি অনুসারে ফেসবুকের মালিকানার ৬৫ শতাংশ থাকে জাকারবার্গের কাছে, ৫ ভাগ মস্কোভিস ও বাকি ৩০ ভাগ থাকে স্যাভেরিনের কাছে।
মস্কোভিসের মূল কাজ ছিল অন্য ক্যাম্পাসে ফেসবুকের সম্প্রসারণ করা। শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে আবেদন আসছিল তাদেরকেও ফেসবুকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। জাকারবার্গও আগ্রহী ছিলেন এ বিষয়ে। একটা সময় ফেসবুককে বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডির বাইরে নিয়ে যাবারও স্বপ্ন ছিল তার।
নতুন একটি শিক্ষায়তনকে যুক্ত করার জন্য তাদের ইমেইল এড্রেস, তাদের কোর্সের তালিকা ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন মস্কোভিস। তারপর সে অনুযায়ী ফেসবুকের কোডকে পরিবর্তন করে সে ক্যাম্পাসকে দিতেন ফেসবুক আসার সুবিধা। ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পরের দিন স্ট্যানফোর্ড যুক্ত হয় ফেসবুকে, ২৯ তারিখে আসে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়। ফেসবুক সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে স্ট্যানফোর্ডে। এক সপ্তাহ পরে স্ট্যানফোর্ডের পত্রিকায় লেখা হয়, “ক্যাম্পাস দিয়ে thefacebook.com ঝড় বয়ে গেছে।” সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্ট্যানফোর্ডের ২,৯৮১ জন ছাত্র-ছাত্রী ফেসবুকে যুক্ত হয়েছিলো।
মার্ক এ সময় বেশ সেলিব্রেটি হয়ে যান। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের পত্রিকাগুলো তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্যে ধর্না দিতে থাকে। এসব সাক্ষাৎকারে ফেসবুক বিষয়ে তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভাবনা জানান মার্ক। তখন ফেসবুকের খরচ বলতে ছিল মাসিক ৮৫ ডলার। তাই তখনই এর থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো তাগিদ ছিল না তার। একবার ভেবেছিলেন, তিনি ছাত্র/ছাত্রীদের সিভি আপলোড দেওয়ার ব্যবস্থা রাখবেন, পরে কোম্পানিগুলো তাদের নিয়োগ দিতে চাইলে, একটি ফি দিয়ে সেসব সিভি দেখতে পারবে। পরে সে পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়, কারণ এতে ফেসবুক একটা সিরিয়াস জায়গা হয়ে উঠতো, আর স্রেফ বিনোদনের মাধ্যম থাকতো না। তার কাছে এ বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিতে দিতে মার্ক যেন কিছুটা অতিষ্ঠই হয়ে উঠেছিলেন। তাই তার আরেক রুমমেট ক্রিস হিউজেসকে নিয়োগ দেন দ্য ফেসবুকের মুখপাত্র হিসেবে। এভাবেই মার্ক ও তার বন্ধুরা মিলে শুরু করে দিয়েছিলেন দ্য ফেসবুকের পথ চলা। দ্য ফেসবুক থেকে একসময় সেটি স্রেফ ফেসবুক হয়ে ওঠে, আর সেই পথ চলতে চলতে ফেসবুক আজ কোন পর্যায়ে এসেছে তা তো আমাদের জানাই।