প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কালের বিবর্তনে মানুষ তথ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে নানারকম নতুন নতুন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। অতীতে একটি পুরো রুম নিয়ে কম্পিউটার স্থাপন করতে হতো, যা আজ একটি ছোট হ্যান্ডব্যাগে শোভা পায়। একইভাবে ব্যক্তি ও কর্মজীবনের নানাবিধ তথ্য সংরক্ষণ করতে একটি বড়সড় কম্পিউটার নিয়ে ঘুরতে হয় না। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের যুগান্তকারী উন্নয়নে যে কেউ তার যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখন কোনোপ্রকার বহনযোগ্য যন্ত্রপাতি ছাড়াই ইন্টারনেট সার্ভারে সংরক্ষণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রয়োজনে সেই সব তথ্যকে ব্যবহারও করা যায়।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির এই সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে শত শত আইটি ফার্ম। ছোট্ট একটি শপ থেকে শুরু করে বহুজাতিক কোম্পানি, প্রায় সবখানেই এখন তথ্য সংরক্ষণ করা হয় ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সাহায্যে। মূলত প্রযুক্তিবিদরা বহু আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন কীভাবে সমস্ত তথ্যকে এক করে তা মানুষের সেবায় পৌঁছানো যায়। তারই ধারাবাহিতায় ক্লাউড কম্পিউটিং এখন প্রযুক্তির দুনিয়ায় বিপ্লব সৃষ্টি করতে পেরেছে।
মেঘ যেমন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে, তেমনই মানুষের কোটি কোটি তথ্য, সফটওয়্যার, অ্যাপ্লিকেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শূন্যে ভাসছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, মেঘ খালি চোখে দেখা যায়, আর ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কিছুই খালি চোখে দেয়া যায় না, শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। আর এই ক্লাউড কম্পিউটিং সম্পর্কে জানতে ফিরে যেতে হবে সুদূর অতীত, খতিয়ে দেখতে হবে এই বিপ্লবের শুরুটা কোথায় থেকে। সেই সাথে আলোচনা করতে হবে, ভবিষ্যতে এটি কেমন সহায়তা করতে পারে আমাদেরকে। আর সমস্ত বিষয় নিয়েই সাজানো হয়েছে পুরো লিখাটি।
কম্পিউটিং পাওয়ারের অভ্যুদয়
সাধারণ দৃষ্টিতে ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’ বলতে খুব সহজভাবে তথ্য সংরক্ষণ পদ্ধতিকে বোঝায়। সংরক্ষণের এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির প্রথম ধারণা আসে ১৯৫০ এর দশকে। সেই সময় একেকটি কম্পিউটার ছিল বিশাল আকৃতির। তখন শুধুমাত্র আকৃতিই এটির মূল সমস্যা ছিল না। সেগুলোর দামও ছিল আকাশচুম্বী, যার কারণে একার পক্ষে একটি কম্পিউটার ব্যবহার করা ছিল অকল্পনীয়। আর সে কারণে ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশের তথ্য সংরক্ষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যদিও ব্যবহারকারীরা তখন একই কম্পিউটার দিয়ে একই সময়ে একাধিক ব্যক্তি তথ্য সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আর এই পদ্ধতির প্রথম ধারণা দেন জন ব্যাকউস। তিনি ১৯৫৪ সালে এমআইটি’র গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে এই পদ্ধতি উত্থাপন করেন।
সে সময় থেকে এই বিষয়টি নিয়ে একাধিক প্রযুক্তিবিদ গবেষণা শুরু করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে বব বের্নে অটোমেটিক কন্ট্রোল ম্যাগাজিনে এই বিষয়টি নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেন। এর এক বছর পর ডব্লিউ. এফ ব্যাউয়ের আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। যদিও তাদের প্রত্যেকের যুক্তি এক জায়গায় থমকে গিয়েছিল। আর সেটি হচ্ছে, একটিমাত্র কম্পিউটার যন্ত্র একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ ও হিসেবনিকেশ করতে পারবেন। আর পার্থক্য ছিল, শুধুমাত্র তারা তিনজন ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। সে যা-ই হোক, তখন তাদের কেউই পরিপূর্ণভাবে এর বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেননি।
১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত এমআইটি’র অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত CTSS (Compatible Time-Sharing System) পদ্ধতি উত্থাপন করেন জন ম্যাক্যার্টি। তার বাস্তবায়িত তথ্য আদানপ্রদান পদ্ধতিটি শুধুমাত্র IBM 704 এবং IBM 709 কম্পিউটারে সম্পাদন করা যেত। অতঃপর ১৯৬১ সালে প্রযুক্তিবিদ ডোনাল্ড ব্লিটজার প্লেটো দুই (PLATO II) পদ্ধতিটি প্রদর্শন করেন। কিন্তু পরিশেষে দেখা যায়, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক প্রদর্শিত পদ্ধতিগুলো গুটিকয়েক কম্পিউটার যন্ত্রের জন্য উপযোগী। আর সেটি গবেষকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রথম পদ্ধতিটি ছিল ডার্টমাউথ টাইম শেয়ারিং সিস্টেম (Dartmouth Time Sharing System)। এটি মূলত ১৯৬৪ সালে ছাড়পত্র পেয়েছিল। এই পদ্ধতি কম্পিউটারের গণনার শক্তিকে পণ্যে পরিণত করেছিল। বর্তমান সময়ে আমরা যেমন বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল ও পানির বিল পরিশোধ করে সেগুলো নির্দিষ্ট পরিমানে পাই, তেমনিভাবে তখন কম্পিউটারের গণনা শক্তিও কেনা যেত। গ্রাহক তার হিসেবনিকেশে যতটুকু কম্পিউটিং পাওয়ার দরকার মনে করবেন, ততটুকু কিনে ব্যবহার করতে পারতেন। যদিও এই পদ্ধতিটি আশির দশকে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ ততদিনে কম্পিউটার মোটামুটি সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছিল।
বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের বিপ্লব
১৯৫০ থেকে ৮০’র দশকে, পুরো সময়টাতে কম্পিউটারে তথ্য সংরক্ষণের বিপ্লবের মাঝে গ্লোবাল নেটওয়ার্কিংয়েরও ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল। মূলত সে সময় যারা নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করতেন, তারা তখনও ভাবেননি যে পরবর্তীতে এই নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েই ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের প্রথম ধাপ পুরোপুরি সম্পন্ন হবে।
বিভিন্ন তথ্যমতে পঞ্চাশের দশকে কয়েকটি জায়গায় নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছিল। যদিও প্রথমদিকে ব্যবহারকারীর বেশিরভাগ একই ভবনের বাসিন্দা ছিলেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে জে.সি.আর লিকলিডার নামক একজন গবেষক কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য আদানপ্রদান ও সংরক্ষণের জন্য একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের ধারণা দেন।
লিকলিডারের এই ধারণা প্রযুক্তিবিদদের আকৃষ্ট না করলেও মার্কিন প্রশাসনের নজরে ঠিকই পড়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন প্রতিষ্ঠান DARPA (Defense Advanced Research Projects Agency)-এর একজন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। মূলত তাকে দিয়ে পেন্টাগন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের নেটওয়ার্কগুলো শায়েন মাউন্টেন কমপ্লেক্স ও কৌশলগত এয়ার কমান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার কাজটি করিয়েছিল, এবং তিনি সফলও হয়েছিলেন।
কয়েক বছর পর ARPANET (The Advanced Research Projects Agency Network) নামক একটি প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতির পরিকল্পনা করেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রকল্পের কাজ ১৯৬৬ সালে শুরু হয়, এবং ১৯৬৯ সালে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মূলত এই ARPANET পদ্ধতিই আজকের ইন্টারনেটের স্তম্ভ, যা সময়ের পরিবর্তনে উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। প্রথমদিকে এটি মাত্র ৪টি নোড দ্বারা কার্যক্রম শুরু করলেও ১৯৮১ সালে এসে প্রকল্পের নোড সংখ্যা ২০০টির মতো দাঁড়ায়।
ARPANET প্রকল্পের মাধ্যমে ৯০’র দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারনেটের বিপ্লব ঘটেছিল, যা বাস্তব ধারণাকে পাল্টে দেয়। ইন্টারনেট সেই সময়ে প্রথমবারের মতো ব্যবহার উপযোগী হয়, যার ফলে কিছু সংখ্যক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন তৈরি হয়। কিন্তু সেগুলোকে কার্যক্ষম করতে সার্ভার এবং ডেটা সেন্টারের চাহিদা উপলব্ধি করেন গবেষকরা। এই পুরো কাজটি সম্পাদনের জন্য তাদেরকে কম্পিউটারের দ্বারস্থ হতে হয়, যার ফলে পূর্বের মতো আবারো পণ্যের ন্যয় কম্পিউটিং পাওয়ার ক্রয়বিক্রয় শুরু হয়। মূলত এটি ছিল আধুনিক ক্লাউড কম্পিউটিং পদ্ধতির যুগান্তকারী সূচনার দ্বিতীয় ধাপ।
ভার্চুয়াল যন্ত্রপাতি
ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের তৃতীয় প্রধান উপাদানটি ছিল ভার্চুয়ালাইজেশন। প্রথম পর্যায়ে ব্যবহারকারীদের অবশ্যই একটি স্বাধীন ভার্চুয়াল কম্পিউটার থাকা আবশ্যক ছিল। আর সেসব ভার্চুয়াল কম্পিউটারের অভ্যন্তরীণ হার্ডওয়্যার, প্রসেসিং ইউনিট এবং মেমোরি যেকোনো ক্লাউডে তথ্য আদান-প্রদানে সক্ষমতা থাকা আবশ্যক ছিল। এছাড়াও কম্পিউটারগুলো যেকোনো মুহূর্তে অন কিংবা অফ হতে পারত। আর এই পুরো কাজটি নিয়ন্ত্রিত হতো কম্পিউটারের কম্পিউটিং পাওয়ার এবং ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে।
আশ্চর্যজনকভাবে, তখনকার ভার্চুয়ালাইজেশনের ধারণাগুলো বর্তমান পদ্ধতির থেকেও ভিন্ন এবং অনুন্নত ছিল। প্রথম সম্পূর্ণ ভার্চুয়ালাইজেশনের ধারণাটি আসে ১৯৬৬ সালে। সেবার IBM CP-40 ও CP-67 অপারেটিং পদ্ধতিতে প্রযুক্তিবিদরা প্রাথমিকভাবে এর ধারণা দেন। এই পদ্ধতিতে কিছু অশোধিত অতিথি অপারেটিং সিস্টেমকে চালনার জন্য যথেষ্ট হার্ডওয়্যার সিমুলেট করে। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ভার্চুয়ালাইজেশনের প্রাথমিক ধারণা। যদিও এর কিছুকাল পরই সম্পূর্ণ হার্ডওয়্যার সহায়ক ভার্চুয়াল কম্পিউটার বাজারে আসে।
১৯৭২ সালে IBM 370 অপারেটিং সিস্টেম প্রথমবারের মতো বাজারে আসে। যন্ত্রটি সেই সময়ের কালজয়ী VM 370 সিস্টেমের এর অধীনে পরিচালিত হতো। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল, যাতে হার্ডওয়্যারের মাধ্যমে সহজে ভালোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। যদিও আধুনিক ভার্চুয়ালাইজেশন ফিচারগুলো ২০০৫ ইন্টেল (VT-X) এবং ২০০৬ সালে এ.এম.ডি (AMD-V) অপারেটিং সিস্টেমে সংযুক্ত করা হয়েছিল, আর এই পদ্ধতিটি x86 নামে সর্বাধিক পরিচিত।
অতঃপর ভার্চুয়ালাইজেশনের অপারেটিং সিস্টেমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ধিতাংশ প্রযুক্তিবিদদের নজরে আসে। আর এই বর্ধিতাংশের কারণে লাইটওয়েট কনটেইনারের উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবির্ভূত ‘ডকার’ এর একটি উদাহরণ। ডকারের কারণে সফটওয়্যারের উন্নতি ঘটে এবং একটি মাইক্রোসার্চ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। বর্তমানে আমরা সেগুলোর আগে ও পরের বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করছি। এই পদ্ধতিগুলোর মূল উৎস কিন্তু অনেক পুরোনোই বলা যায়।
ক্লাউডের খুব কাছাকাছি
আমরা ইতোমধ্যেই তিনটি ধাপে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে রূপান্তরের ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি। সেই সাথে কম্পিউটিং পাওয়ারের বিপণন, নেটওয়ার্ক বিপণন এবং ভার্চুয়ালাইজেশনের মতো বিষয়গুলো যে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সঙ্গে জড়িত, সেটি বুঝতে পেরেছি। তবে প্রযুক্তির এই খাতে ‘ক্লাউড’ শব্দটি প্রকৃতপক্ষে কখন সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল, তা বলা কঠিন। ধারণা করা হয়, ৯০’র দশকে ইন্টারনেটে অপারেটিং সিস্টেমের কোনো একটি ডায়াগ্রাম অঙ্কন কিংবা ব্যবহারকারীদের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে ক্লাউড শব্দের ব্যবহার হতো। কারণ সেই সময় ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবহারকারীরা সেগুলোকে ডাটা আকারে সংরক্ষণ ও অ্যাকসেস করার জন্য একটিমাত্র বোতাম চাপতেন।
অতঃপর ব্যবহারকারীরা তথ্য সংরক্ষণ এবং সেগুলো ডেস্কটপ থেকে আলাদা করতে বেশ কিছু সমস্যায় পড়েছিলেন। আর সেই সমস্যার সমাধানের জন্যেই সফটওয়্যার নামক শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছিল। ৯০’র দশকে সেলসফোর্স এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মূলত সেই সময় প্রযুক্তিবিদরা দুই রকমের সমস্যার মুখোমুখি হন।
প্রথমত, নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশন, স্টার্টআপ দিনকে দিন বেড়েই চলেছিল। আর সেগুলোকে পরিচালনা করার জন্য নতুন করে ওয়েভ অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রযুক্তিবিদরা কোডিং করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এরই মাঝে ‘ঝিমকি’ ইন্টারনেটের জগতে প্ল্যাটফর্ম সার্ভিস নিয়ে মাঠে নামে, যার ফলে অনেকগুলো তথ্য, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনকে ইন্টারনেটে এক করা সম্ভব হয়েছিল। অতঃপর, ২০০৮ সালে গুগল আরো বড় পরিসরে অ্যাপস ইঞ্জিন প্রবর্তন করে; আর সেটিই আজকের গুগল ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম।
তখন কয়েকটি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অল্প সময়ে অধিক বিনিয়োগ করে কম্পিউটিং পাওয়ার নিজেদের কাছে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। তাদের ধারণা ছিল, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কিং দিনকে দিন যতটা উন্নত হবে, কম্পিউটিং পাওয়ারের চাহিদা ততটাই বৃদ্ধি পাবে। তাদের নিকট সংরক্ষিত কম্পিউটিং পাওয়ার এতটাই বেশি ছিল যে, সেগুলোকে সংরক্ষণ কিংবা পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো আরো অধিক নিয়ন্ত্রকের প্রয়োজনবোধ করে। যদিও তাদের বিপণন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
কারণ, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কিং যতই উন্নত হচ্ছিল, কম্পিউটিং পাওয়ারের চাহিদা ততটাই কমেছিল। ফলে সেগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে কিছু সুবিধাবাদী প্রতিষ্ঠান স্বল্পমূল্যে সেই সব কম্পিউটিং পাওয়ার ক্রয় করে বিভিন্ন দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজে লাগিয়েছিল। এতে করে কম্পিউটিং পাওয়ারগুলো একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়নি। আর অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজে লাগাতে গিয়ে সেগুলো আবারও প্রযুক্তিবিদদের নাগালে চলে যায়।
সত্যিকারের ক্লাউড কম্পিউটিং
প্রযুক্তির বাজারে সত্যিকারের ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের আবির্ভাব ঘটে অ্যামাজনের হাত ধরে। আর এটি বর্তমানে প্রমাণিত, কারণ ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি SQS সহায়তায় ইন্টারনেটের বিভিন্ন সুবিধা বাজারে আনে। যদিও এই ধাপে সত্যিকারের বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল ২০০৬ সালে, তখন EC2 নামক ইলাস্টিক কম্পিউট ক্লাউড পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে। ব্যবহারকারীরা প্রতি সেকেন্ডের হিসেবে এটি ভাড়ায় ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানটি তাদেরকে সরাসরি সার্ভার থেকে ডাটা ক্রয়ের পরিবর্তে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবহার করতে দিতেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে মাইক্রোসফট একই পদ্ধতিতে একটি সেবা চালু করে। এর ঠিক ২ বছর পর গুগল তাদের গুগল কম্পিউটার ইঞ্জিন প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসে।
পরবর্তীতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভার্চুয়াল মেশিনের মাধ্যমে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের সেবা নিয়ে হাজির হয়েছিল। যদিও বর্তমান সময়ে অ্যামাজন, গুগল ও মাইক্রোসফটই প্রতিযোগিতায় টিকে রয়েছে। কারণ, মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেবার মান বাড়াতে পারেনি। অন্যদিকে, উল্লেখিত তিনটি প্রতিষ্ঠান সেবার মান বাড়িয়ে একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। ওরাকল, আই.বি.এম এবং আলিবাবা এই প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ভালো অবস্থানে থাকলেও এখন তারা ব্যবসা প্রায় গুটিয়ে নিয়েছে। বাস্তব চিন্তা করলেই বোঝা যায়, প্রযুক্তির শীর্ষস্থানীয় অ্যামাজন, গুগল ও মাইক্রোসফটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কতটা কঠিন।
ভার্চুয়াল যন্ত্রগুলো ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মূল হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন এগুলোর সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। আর এই সুবিধাসমূহের মধ্যে নেটওয়ার্ক, সুরক্ষা ব্যবস্থা, ফাংশন, অ্যাপ্লিকেশন, মেমোরি ইঞ্জিন, বিভিন্ন স্টোরেজ, ডাটাবেস, বিগ ডাটা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সময়ের পরিক্রমায় ক্লাউড কম্পিউটিং পদ্ধতি ভার্চুয়াল কম্পিউটার থেকে যেমন একাধিক ভার্চুয়াল যন্ত্রে স্থানান্তরিত হয়েছে, তেমনিভাবে শুরুর সময়ের তুলনায় এখন এর মাধ্যমে বেশি সুবিধা ও নিরাপত্তা উপভোগ করতে পারছেন ব্যবহারকারীরা। আর এটিই ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মূল বিপ্লব।
প্রত্যাশার তুলনায় বেশি সুবিধা
বর্তমানে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে যেভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে, সেটি প্রায় ছয় দশকের প্রচেষ্টার ফলাফল। আমরা দেখেছি যে, পঞ্চাশের দশকের প্রযুক্তিবিদরা আলাদা আলাদাভাবে কম্পিউটিং পাওয়ার ও নেটওয়ার্কিংয়ের উন্নয়ন শুরু করেন। অতঃপর, আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারনেটের আগমন বদলে দেয় কম্পিউটারের কাজের ক্ষেত্রগুলোকে। আমরা খুব অল্প সময়ে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়েছি, যার পেছনে রয়েছে প্রযুক্তিবিদদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি।
জগতের সিংহভাগ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন বড় প্রকল্পগুলোকে আজ সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। এর অভ্যন্তরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্লাউড কম্পিউটিং কাজ করছে। গুগল স্পেনার এর একটি বাস্তব উদাহরণ হতে পারে। এটি পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র নির্ভরযোগ্য ডেটাবেজ পরিসেবা পদ্ধতি। গুগল ক্লাউডে স্থাপন করা হলেও মূলত জি.পি.এস এবং অ্যাটমিক ক্লকের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। গুগল স্পেনারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী তাদের অনলাইন সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
তবে প্রযুক্তিবিদরা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মৌলিক গঠনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন। তারা সফটওয়্যার সিস্টেমের বিকাশ ঘটিয়েছেন, পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয় করেছেন, এবং কোডিংয়ের পরিমাণ কমিয়েছেন। আর এই গোটা কার্যক্রমটি পরিচালনা করতে শতগুণ কম সময় নিয়েছেন প্রযুক্তিবিদরা, যা রীতিমতো অভাবনীয়। শুধু তা-ই নয়, ক্লাউড কম্পিউটিং ডেভেলপারদের কাজের পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন, যা আশীর্বাদ বলা যায়। তা না হলে আজ যে কাজটি ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে বিনামূল্যে সম্পন্ন করা হচ্ছে, সেটি করতে হয়তো শত মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হতো।
ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ভবিষ্যৎ
প্রযুক্তির যুগান্তকারী আশীর্বাদ ‘ক্লাউড কম্পিউটিং’ সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যেই জানলাম। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে চলা ক্লাউডের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা দরকার, যেটি বদলে দিয়েছে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে গোটা ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে। স্বয়ং গুগলই ক্লাউডের ভবিষ্যৎ জানিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। গুগলের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ হবে প্রায় ২২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালে ছিলো ১৬০ বিলিয়নে। এছাড়াও ২০২৪ সালের মধ্যে বেশিরভাগ উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠান ক্লাউডের সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
আর ২০২৫ সালে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ব্যবহার বর্তমানের চেয়েও পাঁচগুণ বেড়ে যাবে বলে ধারণা গুগলের। বাস্তবেও এমনটা হওয়ারই কথা, কারণ এখন অবধি আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলের মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেনি। এর কারণ, বৈশ্বিক মন্দা এবং সেসব অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যা। কিন্তু আগামী পাঁচ বছরে ক্লাউডের অগ্রগতির সামনে এসব সমস্যাগুলো বাধা হয় দাঁড়াতে পারবে না বলেই আশা করা যায়। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো ভার্চুয়াল যন্ত্রপাতি দিন দিন সস্তা ও সহজলভ্য করে তুলেছে। আর ক্লাউডের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুগলেরও বড়সড় পরিকল্পনা রয়েছে, তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়।