টমাস আলভা এডিসন তার ৮৪ বছরের জীবনে স্রেফ যুক্তরাষ্ট্রেই এগারোশটি পেটেন্টের স্বত্ত্বাধিকারী হয়েছিলেন, অন্যান্য দেশ মিলিয়ে এ সংখ্যা দুই হাজার তিনশোরও বেশি। তবে তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত বৈদ্যুতিক বাতি উদ্ভাবনের জন্যে। কিন্তু এজন্য পুরো কৃতিত্ব তাকে দেওয়া যায় না। বাতিতে বায়ুশূন্য গ্লাসের ধারক বা ইনক্যান্ডেসেন্ট ফিলামেন্টের ব্যবহার- এর কোনোটিই তার আইডিয়া ছিল না। এডিসনের সবচেয়ে মৌলিক উদ্ভাবন ছিল ফোনোগ্রাফ। এটি তার নিজেরও সবচেয়ে পছন্দের প্রযুক্তি ছিলো। এটিই ছিল সর্বপ্রথম প্রযুক্তি, যা শব্দ রেকর্ড করে তা পুনরায় শোনাতে সক্ষম হয়।
শব্দ রেকর্ড করার বিষয়টি আমাদের কাছে এখন আর দশটি বিষয়ের মতোই স্বাভাবিক ঠেকে। অবসর সময়ে মিউজিক প্লেয়ারে গান ছেড়ে দেওয়ার সময় আমরা ভেবে অবাক হই না যে, অনেক আগে কোনো এক শিল্পীর গাওয়া গানটি কীভাবে আমাদের ফোনের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে থাকলো? কারণ এটি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। আমরা প্রথম থেকেই শব্দ জমা থাকতে দেখে এসেছি। কখনো ক্যাসেট প্লেয়ারে, কখনো সিডি/ডিভিডি ক্যাসেটে আর এখন দেখছি আধুনিক মেমোরি কার্ডে। আমরা দেখেছি কীভাবে একের পর এক নতুন প্রযুক্তি এসে হটিয়ে দিচ্ছে আগেরটিকে। ফোনোগ্রাফের মাধ্যমে সাউণ্ড-রেকর্ডিং প্রযুক্তির এ যাত্রার সূচনাই করেছিলেন এডিসন।
যেভাবে আসলো ফোনোগ্রাফের আইডিয়া
ফোনোগ্রাফের আইডিয়া এডিসনের মাথায় আসে টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। টেলিগ্রাফ প্রযুক্তিকে উন্নত করতে এডিসন বছরের পর বছর ধরে কাজ করেছেন। ১৮৭৭ সালের দিকে তিনি এমন একটি টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছিলেন, যাতে টেলিগ্রাফে পাঠানো মেসেজকে কাগজের মধ্যে খাঁজ কেটে প্রিন্ট করা যেত, পরবর্তীতে সেটি আবার পাঠানো যেত। এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার মনে হলো, টেলিফোনে পাঠানো মানুষের কথাকেও এমনভাবে কাগজের মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব কি না, যা থেকে পরবর্তীতে আবার সেই কথা শোনা যাবে। এ আইডিয়া থেকেই জন্ম হয় ফোনোগ্রাফের।
আমরা জানি, শব্দ হচ্ছে কোনো মাধ্যমে কণার কম্পনের ফলে তৈরি হওয়া একধরনের তরঙ্গ। আমরা যখন কথা বলছি তখন আমাদের সামনে বাতাসে উৎপন্ন হচ্ছে শব্দ তরঙ্গ। বাতাসের কণার কম্পনের মাধ্যমে এ তরঙ্গ পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের কানে। বিভিন্ন শব্দের জন্য এ তরঙ্গ বিভিন্ন রকম হয়। এডিসন এ তরঙ্গগুলোকে সংরক্ষণের পরিকল্পনা করেন, যাতে পরে এ তরঙ্গ আবার উৎপন্ন করা যায়, তৈরি হয় আগের সেই শব্দ। চলুন দেখি তিনি এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন।
ফোনোগ্রাফের কাজের কৌশল
এডিসনের ফোনোগ্রাফে শব্দকে সংগ্রহ করা হয় একটি হর্নের মাধ্যমে। কারো কথা রেকর্ড করতে হলে তিনি সেই হর্নের সামনে গিয়ে বেশ জোরে কথা বলেনন। এরপর বক্তার মুখ থেকে নিঃসৃত শক্তিশালী শব্দতরঙ্গ হর্ন হয়ে পৌঁছে যায় একটি পাতলা পর্দায় বা ডায়াফ্রামে। শব্দতরঙ্গের ফলে ডায়াফ্রামে কম্পন সৃষ্টি হয়। ডায়াফ্রামটি যুক্ত থাকে একটি সূঁচালো সুইয়ের সাথে। সুইটি আবার একটি পাতলা টিনের পাতের ওপর চাপ দেওয়া অবস্থায় আছে। যখন শব্দতরঙ্গের সাথে ডায়াফ্রামটি কাঁপে, কাঁপে সুইটিও। সুঁইয়ের কম্পনের ফলে এটি দাগ কেটে যায় টিনের পাতে। এভাবেই সংরক্ষিত হয়, তরঙ্গের তথ্য।
টিনের পাতটি পেঁচানো থাকে একটি সিলিন্ডারে। হাতে ঘোরানো একটি হ্যান্ডেলের সাহায্যে সিলিন্ডারটি খুব ধীরে ঘোরানো যায় ও পাশাপাশি সরানো যায়। এভাবে একে ঘুরিয়ে, পুরো পাতটিতে শব্দ রেকর্ড করা হয়। এভাবে বিভিন্ন রকম শব্দ, টিনের পাতে বিভিন্ন রকম খাঁজ হয়ে জমা থাকে। এরপর এ শব্দকে পুনরায় উৎপন্ন করার জন্যও সুই ও ডায়াফ্রামের ব্যবহার করা হয়। সুইটি খাঁজগুলোর সাহায্যে ডায়াফ্রামে কম্পন তৈরি করে। এরপর হর্ন হয়ে সে কম্পন পরিণত হয় শব্দে।
কৌশলটি কিন্তু তেমন জটিল কিছু নয়, বেশ সরল ডিজাইন। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন সবকিছু একদম সূক্ষ্মভাবে নিখুঁত করে তোলার প্রয়োজন হয়েছিল এজন্য। পুরো প্রক্রিয়ায় একটু বিচ্যুতির জন্যে ভুলভাল শব্দ চলে আসার সম্ভাবনা ছিল। এজন্যই প্রকৌশলগত দিক থেকে ফোনোগ্রাফ ছিল একটি অসাধারণ অর্জন। প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দরকার হয়েছিল এজন্য।
মেরি হ্যাড অ্যা লিটল ল্যাম্ব
১৮৭৭ সালের আগস্ট মাসে এডিসন ফোনোগ্রাফের ডিজাইন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি স্কেচটি দেন জন ক্রুজি নামের একজন মেকানিককে। ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই যন্ত্রটি তৈরি করে নিয়ে আসেন ক্রুজি। উৎসাহী এডিসন তৎক্ষণাৎ হর্নটিকে সামনে এনে আবৃত্তি করেন বিখ্যাত ‘মেরী হ্যাড অ্যা লিটল ল্যাম্ব’ ছড়াটি। তাকে মুগ্ধ করে দিয়ে মেশিনটি পুনরায় ছড়াটি আবৃত্তি করে শোনায় তাকে। একই বছরের ডিসেম্বরের ২৪ তারিখের দিকে এডিসন ফোনোগ্রাফের পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন। পেটেন্ট আবেদনের এত দেরি দেখে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, ফোনোগ্রাফ আসলে আগস্ট মাসে নয়, ডিসেম্বরের দিকেই তৈরি করা হয়েছিল।
১৮৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফোনোগ্রাফের পেটেন্ট ইস্যু করা হয়। এটি ছিল সম্পূর্ণ মৌলিক একটি উদ্ভাবন। একই ধরনের আর কেবল একটি কাজের সন্ধান পাওয়া যায়। চার্লস ক্রস নামের একজন ফরাসি বিজ্ঞানী ১৮৭৭ সালের এপ্রিলের দিকে এমন একটি বিষয়ে লিখেছিলেন। কিন্তু এডিসনের কাজটি তার থেকে অনেকটা ব্যতিক্রম ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ক্রসের কাজটি স্রেফ তত্ত্বকথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর এডিসন তার যন্ত্রটি সফলভাবে তৈরি করেছিলেন।
টমাস এডিসনের ‘ফাইনাল এচিভমেন্ট’
অসাধারণ ইঞ্জনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি এডিসন ছিলেন একজন জাত ব্যবসায়ী। তিনি জানতেন কীভাবে তার পণ্যের প্রচার করতে হয়। প্রচারণার জন্যে প্রথমেই তিনি যন্ত্রটিকে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ এর অফিসে নিয়ে যান। তাদের দেখান ফোনোগ্রাফের কাজের কৌশল। ১৮৭৭ সালের ২২শে ডিসেম্বর ম্যাগাজিনটিতে ছাপা হয়- “মি. এডিসন কিছুদিন আগে আমাদের অফিসে এসেছিলেন। তিনি ছোটখাট একটি যন্ত্র দেখালেন আমাদের। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের খবরাখবর নিয়েছিল ও জিজ্ঞেস করেছিল আমরা তাকে পছন্দ করছি কি না। সবশেষে ভদ্রতার সাথে বিদায়ও জানিয়েছিল।”
এরপর ফোনোগ্রাফ সাড়া ফেলতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়। এডিসনও এর ব্যাপক প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। বিজ্ঞাপনে ‘Thomas Edison’s Final Achievement’ শিরোনামে প্রচার করা হয় একে। এডিসন বলেছিলেন, তিনি আমেরিকার প্রত্যেকটি ঘরে ঘরে ফোনোগ্রাফের স্বপ্ন দেখেন।
এসময় ফোনোগ্রাফের প্রদর্শনী করে এডিসনের ভালো আয় হচ্ছিল। কিন্তু প্রথমদিকে এর বিক্রি বাড়ানো সম্ভব হয়নি, কারণ প্রথমদিকের ফোনোগ্রাফগুলো ব্যয়বহুল ছিল, দক্ষ অপারেটর ছাড়া অন্যদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিলো। তাছাড়া যে টিনের পাতটি ব্যবহার করা হতো তা অল্প কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করলেই নষ্ট হয়ে যেত। তবে বাস্তবমুখী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এডিসন ভবিষ্যতে ফোনোগ্রাফের বহুল ব্যবহারের স্বপ্ন দেখেছিলেন। গান, বক্তব্য, অন্ধদের জন্য ফোনোগ্রাফিক বই, শিক্ষাখাতে ও নিজেদের কন্ঠে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ রেকর্ড করা সহ বিভিন্ন খাতে ফোনোগ্রাফের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন তিনি।
একপর্যায়ে যখন এ প্রযুক্তিটি পরিচিত হয়ে পড়ে, তখন এটি থেকে মনোযোগ সরে যায় তার। তিনি লেগে যান তার বৈদ্যুতিক বাতির উন্নয়নের কাজে। তিনি কাজ না করলেও এসময় আরো অনেকে সাউন্ড রেকর্ডিং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেলসহ বেশ ক’জন বিজ্ঞানী ফোনোগ্রাফকে আরো উন্নত করে তোলেন। এসময় অন্যন্য কয়েকটি কোম্পানিও ফোনোগ্রাফ তৈরি শুরু করেছিলো।
সফলভাবে বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির পর এডিসন আবার ফোনোগ্রাফের দিকে মনোযোগ দেন। ১৮৯৮ সালের দিকে এডিসন ২০ ডলারে স্ট্যান্ডার্ড ফোনোগ্রাফ বিক্রি করতে শুরু করেন, বর্তমান বাজারের হিসেবে এ মূল্য প্রায় ৫৪০ ডলার। এর এক বছর পরেই তিনি ফোনোগ্রাফের আরো একটি উন্নত সংস্করণ বাজারে আনেন, যার বিক্রয়মূল্য ছিল মাত্র ৭.৫০ ডলার। এডিসন তখন ব্যাপক হারে ফোনোগ্রাফ তৈরি করতে শুরু করেন।
ফোনোগ্রাফের বাজার কমে আসে ১৯১২ সালের দিকে। এ সময় বাজারে আসে গ্রামোফোনের শেলাক ডিস্ক। খুব দ্রুতই এটি ফোনোগ্রাফকে হটিয়ে বাজার দখল করে নেয়। প্রযুক্তি জগতের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে এরপর আরো নতুন প্রযুক্তি এসে বাজার দখল করতে থাকে। পুরনো প্রযুক্তিকে হটিয়ে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে থাকে সাউন্ড রেকর্ডিং ব্যবস্থাকে, যার ধারাবাহিকতায় আজকে আমাদের কাছে সাউন্ড রেকর্ডিং একদমই স্বাভাবিক একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।