প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে ফেক নিউজ তথা ভুয়া সংবাদ একটি বড় সমস্যা। ইন্টারনেটে হাজার হাজার ওয়েবসাইট আছে, যেগুলো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিয়মিত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে থাকে। ফটোশপ সহ ছবি সম্পাদনার সফটওয়্যারগুলো জনপ্রিয় এবং ব্যবহারবান্ধব হওয়ার পর থেকেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ভুয়া সংবাদকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য অনেক সময়ই তার সাথে ফটোশপ করা জাল ছবি জুড়ে দেওয়া হয়।
শুধু স্বার্থসিদ্ধির জন্য না, অনেক সময় মজা করার জন্য বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি লাইক পাওয়ার জন্যও অনেকে এ ধরনের ছবি এবং আর্টিকেল প্রচার করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন মানুষ সেগুলোকে সত্য ভেবে প্রচার করতে শুরু করে। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের সাথে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ছবিটি তারই একটি উদাহরণ। মূলত মজা করে ছবিটি তৈরি করা হলেও, অনেক নামকরা ওয়েবসাইট এবং পত্রিকাও সেটিকে সত্য ভেবে ভুলে করেছিল এবং ছবিটি প্রচার করেছিল।
এতদিন পর্যন্ত ভুয়া সংবাদ চিনতে পারার ক্ষেত্রে একটি সহজ নির্দেশক ছিল ভিডিওর উপস্থিতি। যদি সংবাদের সাথে প্রাসঙ্গিক ভিডিও থাকত, তাহলে আশ্বস্ত হওয়া যেত যে, সংবাদটি সঠিক। ভিডিওর উপর মানুষের অগাধ বিশ্বাসের কারণেই ভুয়া সংবাদের সাইটগুলো তাদের সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য শিরোনামে ‘ভিডিও সহ’ কথাটি উল্লেখ করে দেয়। কিন্তু এই নিশ্চয়তার দিনও বোধহয় শেষ হয়ে আসছে। সম্প্রতি কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এমন কিছু সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে সহজেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিডিও তৈরি করা সম্ভব, যার সাথে আসল ভিডিওর পার্থক্য খুবই সামান্য।
আপনি ইচ্ছে করলেই বারাক ওবামা অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিডিও তৈরি করতে পারবেন, যেখানে তাদেরকে আপনার ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তব্য দিতে দেখা যাবে! আপনি হয়তো ট্রাম্পকে দিয়ে এটাও বলিয়ে নিতে পারবেন যে, তিনি পদত্যাগ করছেন এবং আপনাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাইছেন! অথবা তারচেয়েও ভয়ংকর, আপনি ইচ্ছে করলে ট্রাম্পকে দিয়ে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ভিডিও পর্যন্ত তৈরি করে ফেলতে পারবেন!
কৃত্রিমভাবে তৈরি ভিডিওর ব্যবহার আলোচনায় উঠে আসে, যখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল Face2Face নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিডিও নকল করা যায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনি একটি ক্যামেরার সামনে যেরকম মুখভঙ্গি করবেন, সফটওয়্যারটি অবিকল সেই মুখভঙ্গি প্রয়োগ করবে তাদের ডেটাবেজে থাকা বিখ্যাত ব্যক্তিটির উপর। ফলাফল হিসেবে আপনি দেখতে পাবেন, পর্দার ব্যক্তিটি হু্বহু আপনার মতো মুখভঙ্গি করছে, ঠিক আপনার সাথে সাথেই।
গবেষণা দলটি Face2Face সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে জর্জ ডাব্লিউ বুশ, ভ্লাদিমির পুতিন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভিডিও প্রকাশ করে। তবে এটি ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের একটি সফটওয়্যার। ভিডিওগুলো দেখেই বোঝা সম্ভব ছিল যে, এগুলো সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি। তাছাড়া এতে শুধু ভিডিওই দেখা যেতো, কোনো কণ্ঠস্বর যোগ করা যেত না।
কিন্তু অঙ্গভঙ্গীই যেখানে নকল করা সম্ভব, সেখানে কণ্ঠস্বর নকল করা কি খুব কঠিন কিছু? বার্মিংহামের আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে কারো কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করা সম্ভব। মনে করুন, আপনি ওবামার কন্ঠস্বর নকল করতে চান। তাহলে আপনাকে শুধু ইন্টারনেট থেকে ওবামার বিভিন্ন বক্তব্যের ৫ মিনিটের মতো অডিও খুঁজে বের করে আপলোড করে দিতে হবে। তাহলেই সফটওয়্যারটি সেগুলো বিশ্লেষণ করে ওবামার বক্তব্যের ধরনটি রপ্ত করে ফেলতে পারবে। এরপর আপনি একটি মাইক্রোফোনের মাধ্যমে যা বলবেন, সেটাই হুবহু ওবামার কণ্ঠস্বরে শোনা যাবে!
এছাড়াও Lyrebird নামে কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানও একই ধরনের একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে। সফটওয়্যারটি মূলত অডিওবুকের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি যেকোনো লিখিত বার্তা বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির কণ্ঠস্বরের মতো করে পড়ে শোনাতে পারে। এই ব্যক্তিদের তালিকায় আছেন ওবামা, ট্রাম্প, হিলারি সহ আরো অনেকে। ফটোশপের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাডবিও প্রজেক্ট ভোকো নামে একই রকম একটি সফটওয়্যার তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু কেমন হবে, যদি ভিডিও এবং অডিও নকল করার পৃথক পৃথক সফটওয়্যারের পরিবর্তে দুই প্রযুক্তিকে একত্রিত করে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমেই অডিও-ভিডিও একসাথে নকল করা যায়?
ঠিক সে কাজটিই করেছে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দল Synthesizing Obama নামে একটি প্রকল্পের অধীনে ইন্টারনেটে থাকা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রায় ১৪ ঘণ্ঠার ভাষণ এবং সাক্ষাৎকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে ওবামার মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তির মানচিত্র তৈরি করে। এরপর ওবামার অনেক পুরানো একটি বক্তব্যের অডিও সফটওয়্যারটিতে প্রবেশ করানোর পর সফটওয়্যারটি সেই অডিওর প্রতিটি ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ওবামার মুখের আকৃতি কিভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তার একটি নকশা তৈরি করে।
এরপর ওবামার একটি নতুন ভিডিও প্রবেশ করানোর পর সফটওয়্যারটি ঐ ভিডিওর উপর পূর্বের অডিও থেকে তৈরিকৃত নকশা প্রয়োগ করে। চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে এমন একটি ভিডিও তৈরি হয়, যেখানে ওবামাকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভিডিওতে এমন প্রসঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়, যেটি আসলে তিনি অনেক আগে ভিন্ন কোনো প্রসঙ্গে বলেছিলেন!
এই প্রকল্পে জড়িত কর্মকর্তারা বলেন, তাদের এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে স্পেশাল ইফেক্ট এবং ভিডিও কনফারেন্সের ক্ষেত্রে। স্কাইপি বা গুগল হ্যাংআউট জাতীয় সফটওয়্যারগুলোতে ভিডিও কল করার সময় প্রায়ই দেখা যায় যে, অডিও শোনা যাচ্ছে, কিন্তু ভিডিও থেমে থেমে আসছে। এরকম ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সফটওয়্যারটি আটকে যাওয়া ভিডিও নিজেই তৈরি করে শূন্যস্থান পূরণ করে নিতে পারবে এবং ব্যবহারকারী হাই কোয়ালিটির ভিডিও সহ টেলিকনফারেন্সের অভিজ্ঞতা দিতে পারবে।
ভিডিও নকল করার প্রতিটি প্রকল্পই এখনও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তাছাড়া এখনো সবগুলো প্রযুক্তি শুধুমাত্র মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি এবং গলার স্বরই নকল করতে পারে। পুরো শরীরের নড়াচড়া বা শারীরিক ভাষা নকল করার মতো প্রযুক্তি এখনও তৈরি হয়নি। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এগুলো শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ ধরনের প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে মানুষ যে নকল ভিডিও তৈরি করে ভুয়া সংবাদ ছড়াবে, এ ব্যাপারে সফটওয়্যারগুলোর নির্মাতারাও অবগত আছেন। ফেসটুফেস সফটওয়্যারটির ডেভেলপারদের একজন, জাস্টাস থাইস বলেন,
এ ধরনের টুলস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণে আমরা আমাদের সফটওয়্যারের সোর্সকোড উন্মুক্ত করিনি।
সিন্থেসাইজিং ওবামা প্রজেক্টের একজন গবেষক, সুপাসর্ন সজানাকর্নও এমন কিছুর সম্ভাব্যতা স্বীকার করেন। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, মানুষ এখন যেরকম ফটোশপ সম্পর্কে জানে এবং এর ফলে কোনো ছবি সহজে বিশ্বাস করে না, সেরকম এই সফটওয়্যারগুলোও যখন সহজলভ্য হয়ে যাবে, তখন মানুষ ভিডিওর ব্যাপারেও একই রকম সচেতন হয়ে যাবে।
সন্দেহ নেই, এ ধরনের সফটওয়্যারগুলোর কারণে কিছু মানুষ সব সময়ই ধোঁকা খাবে। কিন্তু কোনো ভিডিও কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, সেটা একটু সচেতন থাকলে সহজেই বোঝা সম্ভব। এক্ষেত্রে ভিডিওর মূল ব্যক্তিটির আশেপাশে কী কী আছে, সেগুলো কতটুকু বাস্তবসম্মত, সবগুলো বস্তুর আপেক্ষিক আকার-আকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কিনা, সবগুলো বস্তুর ঔজ্জল্য কিংবা ছায়া একই রকম কিনা, এরকম অনেক বিষয়ই বিবেচনা করা যেতে পারে।
তাছাড়া নকল ভিডিও তৈরির প্রযুক্তির সাথে সাথে নকল ভিডিও শনাক্ত করার প্রযুক্তি আসতেও খুব বেশি দেরি হবে না। সিন্থেসাইজ ওবামা প্রজেক্টের কর্মর্তারা জানান, তাদের এই সফটওয়্যারটি শুধু যে ভিডিও তৈরি করতে পারবে তাই না, এটি একই সাথে কোনো ভিডিও বিশ্লেষণ করে বলে দিতে পারবে সেটি আসল, নাকি কোনো সফটওয়্যারের মাধ্যমে তৈরি। কাজেই খুব বেশি হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
ফিচার ইমেজ- Business Insider