বর্তমানে জনপ্রিয় ব্রাউজারের নাম উল্লেখ করতে হলে গুগল ক্রোম, মজিলা ফায়ারফক্স, সাফারি, ইউসি ব্রাউজার, অপেরার মতো ব্রাউজারগুলোর নামই ঠোঁটের আগায় চলে আসে। আপনি এখন এই ফিচার আর্টিকেলটি উপরে উল্লিখিত কোনো এক ব্রাউজারের মাধ্যমেই পড়ছেন- সেই সম্ভাবনাও প্রবল। স্ট্যাটিস্টার এক জরিপ অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বে ৪.৬৬ বিলিয়ন সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৯.৫ শতাংশ, এবং এই সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ৯২.৬ শতাংশ (৪.৩২ বিলিয়ন) মানুষ মোবাইল দিয়ে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হচ্ছে।
এত শত চোখধাঁধানো ফিচারওয়ালা ওয়েব ব্রাউজারগুলো কিন্তু আমরা বিনামূল্যেই ব্যবহার করছি। তাহলে মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে, “যেহেতু আমরা বিনামূল্যে ব্রাউজারগুলো ব্যবহার করছি, সেটা থেকে কোম্পানি মুনাফা অর্জন করে কীভাবে?” সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
একটুখানি ইতিহাস
ব্রাউজারগুলোর আয় সম্পর্কে বিশদ বিশ্লেষণ করার আগে সেসবের ইতিহাস থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। প্রথমেই সামনে চলে আসে WWW এর প্রতিষ্ঠাতা টিম বার্নার্স লির কথা।
১৯৯১ ছিল প্রযুক্তি যুগের এক মাইলফলকর। সেই বছরই www নামে একটি ওয়েব ব্রাউজার তৈরি করেন বার্নার্স লি। এটিই বিশ্বের প্রথম ওয়েব ব্রাউজার। এর বৈশিষ্ট্য ছিল যে এটা দিয়ে ওয়েব ব্রাউজিংয়ের পাশাপাশি ওয়েবপেজ সম্পাদনা বা এডিট করা যেত কোনো ঝামেলা ছাড়াই। কিন্তু সমস্যা হলো ব্রাউজারটিতে শুধু টেক্সট দেখা যেত, কোনো ছবি দেখাত না। তখন আবার ‘world wide web’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘www’ এর সাথে ‘www’ ব্রাউজারকে মিলিয়ে ফেলত অনেকেই। গড়বড় এড়ানোর জন্য ব্রাউজারটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘Nexus’।
ব্রাউজারের ইমেজ সমস্যা দূরীকরণের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে এলেন তরুণ সফটওয়্যার ডেভেলপার মার্ক অ্যান্ড্রেসেন। ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অভ ইলিনয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সুপারকম্পিউটিং অ্যাপ্লিকেশন্সের সহযোগিতায় তিনি ‘Mosaic’ নামে একটি ব্রাউজার ডেভেলপ করেন। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে টেক্সটের পাশাপাশি ছবি দেখারও সুযোগ ছিল। ১৯৯৪ সালে তিনি ঐ কোম্পানির সাথে সকল সম্পর্ক চুকিয়ে ‘Netscape Communications’ নামে নতুন এক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বছরই মোজাইক ব্রাউজারের আদলে ‘Netscape Nevigator’ নামে এক ব্রাউজার বাজারে ছাড়েন অ্যান্ড্রেসেন।
শুরুর দিকেই তুমুল জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে নেওয়ায় ১৯৯৫ সালে ব্রাউজারটি মার্কেট শেয়ার গিয়ে ঠেকে ৯০% শতাংশে। গোড়ার দিকে নেটস্কেপ ন্যাভিগেটরের ডেভেলপাররা জানান, অবাণিজ্যিক সংস্থাগুলোকে এই ব্রাউজার বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হবে। বাকি সকলকে ব্রাউজারটি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হতো। এদিকে ১৯৯৪ সালে Spyglass Inc. মোজাইকের সোর্স কোড লাইসেন্সিংয়ের মাধ্যমে Spyglass Enhanced Mosaic নামে আরেকটি ব্রাউজার ডেভেলপ করে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সেটি বিক্রি করা হতো।
১৯৯৫ সালে মাইক্রোসফট ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ওই ব্রাউজারের লাইসেন্স কিনে নেয়। এর সোর্স কোড ডেভেলপের মাধ্যমে তা থেকে জন্ম দেয়া হয় ‘Internet Explorer’ ব্রাউজারের। এই ব্রাউজারের উত্থানই পাল্টে দেয় এতদিন ধরে চলা ব্রাউজারের লাভজনক ব্যবসায়িক পন্থার গতিপথ।
মাইক্রোসফট নিজেদের রাজস্ব বাড়ানোর জন্য তাদের অপারেটিং সিস্টেম Windows 95 থেকে শুরু করে উইন্ডোজের বাকি ভার্সনগুলোতেও ফ্রি করে দেয় ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার। এছাড়াও অ্যাপলের সাথে এক বিশেষ চুক্তিতে আবদ্ধ হবার কারণে ম্যাকিনটোশ ডিভাইসগুলোতে ডিফল্ট ব্রাউজার হিসেবে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার দেওয়া হতো। বিনামূল্যে বাজারে ছাড়ার পাশাপাশি, অ্যাপল ও মাইক্রোসফটের মতো দুই টেক জায়ান্টের ছায়াতলে থেকে, ১৯৯৯ সালে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের সকল সংস্করণই ব্রাউজার মার্কেটের ৭৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখল করতে সক্ষম হয়। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের এই বাধাহীন অগ্রগতির কাছে নতজানু হতে হয় নেটস্কেপ ন্যাভিগেটরকে। ফলশ্রুতিতে, ১৯৯৮ সালে সেই নেটস্কেপকে ওপেন সোর্স হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ওদিকে ২০০৩ সালে মাইক্রোসফট ও অ্যাপলের বিশেষ চুক্তির মেয়াদ ফুরিয়ে এলে অ্যাপল তাদের নিজস্ব ব্রাউজার বানানোর চিন্তা গুরুত্ব সহকারে আমলে নেয়। এর ফলেই আমরা পেয়েছি বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ব্রাউজার ‘সাফারি’। ২০০৪ সালে আমেরিকাভিত্তিক অনলাইন ওয়েব পোর্টাল ও সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি AOL নেটস্কেপ কিনে নেয়। পরবর্তীতে এর ওপেন সোর্স কোড কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয় ‘Mozilla Firefox’। ওই বছর নভেম্বরে বাজারে আসে ব্রাউজারটি। এদিকে ১৯৯৬ সালে নরওয়ের অসলোতে তৈরি করা ব্রাউজার ‘অপেরা’ও ফ্রি করে দেয়া হয় ২০০৫ সালের ১২ জানুয়ারি। ২০০৮ সালে সর্বশেষ চমক দেখায় গুগল। তারা ‘আইসোলেটেড ট্যাবস’ এবং ‘ফাস্ট ব্রাউজিং ফিচার’সহ তাদের নিজস্ব ওয়েব ব্রাউজার ‘Google Chrome’ নিয়ে আসে। ব্রাউজারটি নির্মাণ করা হয়েছিল গুগলের ক্রোমিয়াম ওপেন সোর্স কোডের উপর ভিত্তি করে। উন্নতমানের সিকিউরিটি ও গতিতে সাফল্য দেখিয়ে এই ফ্রি ব্রাউজারগুলো রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
যেভাবে আয় করে ওয়েব ব্রাউজার
২০১৮ সালে মজিলা ফায়ারফক্সের প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩৬ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বিশাল অংকের এই অর্থের ৯৫ শতাংশ এসেছে রয়্যালটি থেকে। আরও খোলাসা করে বললে ফায়ারফক্স ব্রাউজারে বিল্ট-ইন সার্চ ইঞ্জিনের অ্যাডভার্টাইজিং রেভিনিউর একটি অংশ থেকে। এছাড়াও মজিলা ফায়ারফক্স ইউজারদের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমেও আয় করে থাকে। যদিও এর পরিমাণ খুবই অল্প। Fossbyte এর এক তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে জুলাই পর্যন্ত মজিলা ফায়ারফক্সের সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রায় ২০৫ মিলিয়ন।
প্রশ্ন আসতে পারে- ফ্রি সার্ভিস দিয়ে আসা গুগল ক্রোমের আয়ের পন্থা কী? গুগল তাদের আয়ের সবচেয়ে বৃহৎ অংশটা উঠিয়ে নেয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে। যখন ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেট ব্রাউজ করার জন্য গুগল ক্রোম ইন্সটল দিচ্ছে, তখন তারা তাদের সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের দিকেও লোকজনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন- জিমেইল, গুগল অ্যাপস, গুগল ডকস ইত্যাদি। ‘একের ভেতর সব’ প্যাকেজের ফলে ইউজাররাও আর আলাদাভাবে অন্য অ্যাপলিকেশনের দ্বারস্থ হচ্ছে না। ওদিকে প্রতিটি সার্ভিস ব্যবহার, পেজ ভিউ তাদের অ্যাড রেভেনিউর থলে ক্রমশ ভারী করছে। গুগলের অ্যাডসেন্স প্রোগ্রাম আপনার ব্রাউজকৃত ডাটার প্রতি সর্বদা কড়া নজর রাখছে। ব্যবহাকারী গুগলে যা সার্চ দিল, সেই ডাটা সংগ্রহ করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াগুলো সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে ব্যবহাকারীর চাহিদা অনুযায়ী তার সামনে যথাযথ বিজ্ঞাপন করছে।
ব্রাউজারগুলো তাদের সার্চ ইঞ্জিন সার্ভিসের জন্য অনেকাংশে নির্ভর হলেও, গুগল সার্চ ট্রাফিকের জন্য পুরোপুরি ব্রাউজারের মুখাপেক্ষী। ২০১১ সালে প্রথম কয়েকমাসে গুগলের গ্রস রেভেনিউ ছিল ৮.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৯৭% তারা অর্জন করে বিজ্ঞাপন থেকে।
স্ট্যাটিস্টার এক তথ্যমতে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘গুগল ক্রোম’ ইন্টারনেট ব্রাউজারের ৬৩.৬৪ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখল করে রেখেছিল। ওবার্লোর এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৬৫.২৭% মার্কেটে ব্রাউজারের বাজারে শ্রেষ্ঠত্বের আসন ধরে রেখেছিল গুগল ক্রোম। ১৮.৩২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে এর পরের অবস্থানেই রয়েছে অ্যাপলের সাফারি ব্রাউজার। এজন্য ধন্যবাদটা পাবে অবশ্য আইফোন ও ম্যাক ইউজাররা। প্রতি বছর সাফারি ব্রাউজারকে ৯-১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফি দিতে হয় গুগলকে, শুধু রয়্যালটি চার্জ হিসেবে। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে মজিলা ফায়ারফক্স এবং স্যামসাং ইন্টারনেট ব্রাউজার, যাদের মার্কেট শেয়ার ৩.৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
প্রায় সব ওয়েব ব্রাউজারই ব্যবহারকারীদের ‘এক্সটেনশন’ নামে এক ভার্চুয়াল সুবিধা দিয়ে থাকে। এই এক্সটেনশনের অধিকাংশই থার্ড-পার্টি ডেভেলপারদের তৈরি, যারা বিভিন্ন সময় এক্সটেনশনের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন পরিমাণ চার্জ করে থাকে। যদি তারা এজন্য প্লাটফর্ম হিসেবে ‘Chrome Web Store API’ ব্যবহার করে, তবে গুগল তাদের থেকে ৫% ফি কেটে নেয়।
Google Adwords এর মতো Microsoft Edge ব্রাউজারের মূল রাজস্ব উঠে আসে সার্চ ইঞ্জিন বিং-এর হাত ধরে। তবে তারা যে অবস্থানে আছে, তা দিয়ে গুগল ক্রোম বা সাফারিকে ধরতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়াও, বিংয়ের অ্যাড রেভিনিউ ২০১৮ সালের দিকে ৭ শতাংশের মতো কমে যায়।
অপেরা ব্রাউজার খুললেই হোমপেজে শর্টকাট আইকন হিসেবে ফেসবুক, অ্যামাজন, ক্রিকবাজ ইত্যাদি ওয়েবসাইটের দেখা মেলে? অপেরা কি শখের বশে এসব সাইট হোমপেজে বুকমার্ক করে রেখেছে? না! ওই কোম্পানিগুলো অপেরাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিচ্ছে বলেই হোমপেজে এত আয়োজন।
রয়্যালটির পাশাপাশি ব্রাউজারের রেভিনিউর আরেকটি উৎস অ্যাড রেভিনিউ। যেমন, ব্রেইভ ব্রাউজারের ‘বেসিক অ্যাটেনশন টোকেন রিওয়ার্ড প্রোগ্রাম’। এর আওতায় ব্রেইভ ব্রাউজার তাদের ব্যবহারকারীদের অ্যাড দেখার বিনিময়ে যে রেভিনিউ জেনারেট করে, তার ৭০ শতাংশই তারা ব্যবহারকারীদের সাথে শেয়ার করে, বাকি ৩০% নিজেরা রেখে দেয়। প্রাইভেসি রক্ষা ও গতির দিক থেকে ব্রাউজারের দুনিয়ায় এই ব্রাউজার বিপুলভাবে সমাদৃত। তারা বিল্ট-ইন অ্যাড ব্লকার, এবং জিরো লগ পলিসির সুবিধাও প্রদান করে থাকে। যা-ই হোক, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদেরকেও তো আয় করতে হবে। এজন্য তারা ব্রাউজারে ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবস্থা করে রেখেছে, যেটা Basic Attention Tokens (BAT) নামে পরিচিত। ‘মাইক্রোসফট রিওয়ার্ড’ প্রোগ্রামের মতো তারা তাদের গ্রাহকদের BAT দিয়ে থাকে। এছাড়াও তারা বিশ্বের প্রথম ব্লকচেইন ফোন HTC Exodus এর সাথে এক চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যেখানে ওই ফোনে ডিফল্ট ব্রাউজার হিসেবে সেট করা আছে ব্রেইভ ব্রাউজার।
সাবস্ক্রিপশনের কাজও একইসাথে চুকিয়ে ফেলা হয়। যেমন: অতিরিক্ত স্টোরেজের জন্য গুগল ‘ক্লাউড স্টোরেজ’ এবং মাইক্রোসফট ‘ওয়ান ড্রাইভ’ এর বিজ্ঞাপন প্রদান করে থাকে। কোনো গ্রাহক যদি সেই সেবা ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তাকে অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হবে। এভাবে ব্রাউজার কোম্পানি মুনাফা অর্জন করতে পারে।
মূলত, এভাবেই আয় করে ব্রাউজারগুলো। পৃথিবী প্রযুক্তির উপর দিন দিন যত নির্ভরশীল হবে, ততই বাড়বে ব্রাউজারের সক্রিয় ব্যবহার। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্রাউজারগুলোও খুঁজে নেবে আয়ের নিত্যনতুন পন্থা, যাতে তাদের বার্ষিক আয় মিলিয়ন থেকে বিলিয়নের ঘরে লাফ দিতে পারে অনায়াসে।
ফিচার ইমেজ – Wallpaper Abyss