অ্যাপল বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সফল একটি কোম্পানি। তাদের পণ্যের সর্বব্যাপী চাহিদার পাশাপাশি রয়েছে একটি বিশ্বস্ত ভোক্তাশ্রেণী। তাই আমেরিকান শেয়ার মার্কেটে প্রথম ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানি হিসেবে অ্যাপলের নাম উঠে আসা একেবারেই বিস্ময়কর কোনো বিষয় নয়। কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর আগে অ্যাপল একসময় দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সবচেয়ে মজার কথা হলো, এই অবস্থা থেকে অ্যাপলকে তখন স্টিভ জবস বাঁচাতে পারেননি, বরং তখন অ্যাপলকে বাঁচায় তাদেরই ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী মাইক্রোসফট!
নব্বইয়ের দশকের চিত্র
১৯৯৭ সালের দিকে অ্যাপল শুধুমাত্র কম্পিউটার প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত ছিল, কেননা তখনও স্মার্টফোন আবিষ্কার হয়নি। অ্যাপল কোম্পানির নামই ছিল তখন ‘অ্যাপল কম্পিউটার’। তাদের কম্পিউটারগুলোর বাজারদর ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি, যার কারণে ব্যবহারকারীদের কাছে অ্যাপলের জনপ্রিয়তা তেমন ছিল না। অর্থাৎ সেসময়ে কোম্পানিটি ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল।
১৯৯০ এর দিকে বেশিরভাগ কম্পিউটার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হতো। কম্পিউটারগুলোর মূল ভিত্তি ছিল বড় বড় কোম্পানিগুলোর প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার যাতে সুন্দরভাবে চালানো যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম থাকা। অর্থাৎ আপনি যে সফটওয়্যারটি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কম্পিউটারে চালাতে চান, সেজন্য কম্পিউটারে যদি প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম তৈরি করা না থাকে, সেক্ষেত্রে বড় বড় কোম্পানিগুলোর জন্য আপনার কম্পিউটার কোনো উপকারে আসবে না।
১৯৯৭ সালে মাইক্রোসফটের শেয়ার বাজারদর অনেক বেশি ছিল এবং প্রায় সকল ধরনের সফটওয়্যার উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হতো। একটি কথা বলে রাখা ভাল যে, এই সময়ে স্টিভ জবস অ্যাপলের দায়িত্বে ছিলেন না। ১৯৮৫ সালে অ্যাপলের পরিচালনা পর্ষদ তাকে কোম্পানি থেকে বের করে দেয়। ১৯৯৭ সাল থেকে ক্রমেই অ্যাপলের বিক্রি কমতে থাকে এবং পাশাপাশি কমতে থাকে অ্যাপলের শেয়ারের বাজারদর। বার বার কোম্পানির সিইও পরিবর্তন করার পরও যখন অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না, তখনই অ্যাপল স্টিভ জবসকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিল।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্টিভ জবস ‘নেক্সট’ নামক কোম্পানিটি কিনে নেন। অ্যাপল ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি নিজেই এই কোম্পানি শুরু করেন। কিন্তু অ্যাপলের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন এতটাই শোচনীয় ছিল যে ‘নেক্সট’ কেনার জন্য তিনি কোনো নগদ অর্থ পাননি, পেয়েছিলেন অ্যাপলের ১.৫ মিলিয়ন মূল্যের শেয়ার। এতকিছুর পরও অ্যাপলের অস্তিত্ব সংকট প্রকট হয়ে উঠল জুলাইয়ের শেষের দিকে, কারণ তখন অ্যাপলের ব্যাংক একাউন্টে মাত্র ৯০ দিনেরও কম সময় চলার মতো অর্থ অবশিষ্ট ছিল। তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও মাত্র এক বছরেই কোম্পানিটি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
যে ঘোষণা সবাইকে হতভম্ব করে দেয়
আগস্ট মাসের ৭ তারিখ এক কনফারেন্সে স্টিভ জবস সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের জন্ম দেন। তিনি সেই কনফারেন্সে অ্যাপলের সাথে মাইক্রোসফটের অংশীদারিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। “যে কোম্পানি অ্যাপলকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে, তার সাথেই কীভাবে আবার অংশীদারিত্ব?“- এটাই ছিল সাধারণ মানুষের কাছে কোটি টাকার প্রশ্ন। তিনি কনফারেন্সে বলেন,
আজ আমি আমাদের প্রথম এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন অংশীদারের কথা বলব, যে হলো মাইক্রোসফট! অ্যাপল মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্রাউজারকে তাদের ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের ডিফল্ট ব্রাউজার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পাশাপাশি মাইক্রোসফট অ্যাপলের ১৫০ মিলিয়ন মূল্যের শেয়ার বাজারদরে কেনার ঘোষণা দিয়েছে। এই শেয়ারগুলো হচ্ছে নন ভোটিং শেয়ার। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মাইক্রোসফট তাদের অফিস পাঁচ বছরের জন্য অ্যাপলকে অবাধে ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে।
এখানে একটা বিষয় হচ্ছে- মাইক্রোসফট যে শেয়ারগুলো কিনেছে, সেগুলো ছিল নন-ভোটিং শেয়ার। অর্থাৎ মাইক্রোসফট অ্যাপলের অংশীদারিত্বে যাচ্ছে না, বরং তাদেরকে তহবিল দিচ্ছে শুধুমাত্র। সফটওয়্যারগুলোর অ্যাপলের ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে ব্যবহার-উপযোগীতা না থাকাই মূলত অ্যাপলকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিচ্ছিল। আর তখনই বিল গেটস ম্যাকিনটোশের এই সফটওয়্যারজনিত সমস্যা দূর করেন। কিন্তু কেন তিনি এটা করলেন? যেখানে মাইক্রোসফটের হাতে তাদেরই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যু হত, সেখান থেকে কেন বিল গেটস অ্যাপলকে বাঁচালেন?
কেন অ্যাপলকে সাহায্য করা?
এখন আমরা বিল গেটসকে একজন উদার এবং দানশীল ব্যক্তি হিসেবেই জানি। কিন্তু আজ থেকে ৩০ বছর আগে তিনি এমন ছিলেন না। ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য তিনি যেকোনো ধরনের উপায় গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন, যদিও সেটা অন্য কারো জন্য খারাপ কিছু বয়ে আনে।
ব্যবসায় সফলতার জন্য গেটসের গৃহীত পদক্ষেপগুলো মাইক্রোসফটকে সফলতা এনে দেয়। মাইক্রোসফট এতটাই সফল ছিল যে এটি তখন আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের উচ্চপদস্থ নীতি নির্ধারকদের চোখে পড়ে। ১৯৯৩ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে একটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস ‘শারমান এন্ট্রি-ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ ভঙ্গের জন্য মাইক্রোসফটের নামে মামলা দায়ের করে। তারা অভিযোগ করে, মাইক্রোসফট একচেটিয়া বাজার দখলের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা দমন করতে চাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে, মাইক্রোসফট সত্যিকার অর্থেই চাচ্ছিল তাদের তৈরি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সাথে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্রাউজারটি যুক্ত করে দিয়ে ওয়েব ব্রাউজার ব্যবসায় একচেটিয়া বাজার দখল করতে।
মাইক্রোসফটের একচেটিয়া মনোভাব
তখনকার সময়ে ওয়েব ব্রাউজার ফ্রি ছিল না। নেটস্কেপ নেভিগেটর, অপেরার মতো ওয়েব ব্রাউজারগুলো দোকান থেকে কিনে নিতে হত। এখন মাইক্রোসফট চাচ্ছিল তাদের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্রাউজারকে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সাথে যুক্ত করে দিতে, যাতে করে ব্যবহারকারীদের আলাদা কোনো ওয়েব ব্রাউজার কিনতে না হয়। আর এভাবেই মাইক্রোসফট বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করবে।
মাইক্রোসফটের জয়
দীর্ঘদিনের টানা আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে তার কোম্পানিটি ভেঙে পড়ুক তা বিল গেটস একদমই চাচ্ছিলেন না। অ্যাপলকে সাহায্য করার মাধ্যমে বিল গেটস প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে তারা একচেটিয়া ব্যবসায় বিশ্বাসী নয়, বরং তারা প্রতিযোগিতাকে সব সময় সমর্থন করে। শুনানির কিছু অংশ তুলে ধরা যাক।
প্রশ্ন: আপনি কি রিয়েল নেটওয়ার্ক এর কোন প্রতিনিধির সাথে কী ধরনের পণ্য তাদের বিতরণ করা উচিত বা উচিত নয় এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা করেছিলেন?
বিল গেটস: (প্রায় অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর) না।
প্রশ্ন: এটা একটা প্রোগ্রাম, যা সাধারণত হিসাব-নিকাশের কাজ অথবা মজুদপণ্যের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
বিল গেটস: আমি মনে করি সংজ্ঞায়নটা অস্পষ্ট।
প্রশ্ন: যতটুকু সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ততটুকু কি যথার্থ নয়?
বিল গেটস: যথার্থ হলেও আমি মনে করি এটা এখনও অস্পষ্ট।
এভাবেই আদালতে শুনানির সময় বিল গেটস তার উত্তরে যথাসম্ভব কৌশলী থাকার চেষ্টা করেন, যাতে করে জুরি বোর্ড সহজে কোনো কিছু বুঝতে না পারে। তিনি জানতেন, অ্যাপলকে সাহায্য করে তিনি প্রকৃত অর্থে মাইক্রোসফটকেই বাঁচিয়ে দিয়েছেন। অ্যাপলকে সাহায্য করে মাইক্রোসফট এটাই বোঝাতে চাচ্ছিল যে, তারা একচেটিয়া কোনো কোম্পানি নয়। তিন বছর পর আদালত মাইক্রোসফটকে সামান্য শাস্তি দিয়ে মামলা থেকে মুক্তি দেয়।
নন-ভোটিং শেয়ার রহস্য
আগেই বলা হয়েছে, মাইক্রোসফট অ্যাপলের ১৫০ মিলিয়ন মূল্যের নন-ভোটিং শেয়ার বাজারদর ক্রয় করে। মামলা থেকে মুক্তির সাথে সাথেই বিল গেটস তার নন-ভোটিং শেয়ারগুলোকে সাধারণ শেয়ারে রূপান্তর করেন। সব মিলিয়ে বিল গেটস অ্যাপলের ১৮.২ মিলিয়ন মূল্যের শেয়ার পান, যা তিনি ২০০৩ সালে বিক্রি করে দেন। যখন বিল গেটস শেয়ারগুলো বিক্রি করেন, তখনও অ্যাপলের শেয়ারমূল্য অনেক কম ছিল।
এরপর থেকে অ্যাপলের শেয়ারের বাজারমূল্য ২০০৫ সালে ২:১ অনুপাতে এবং ২০১৪ সালে ৭:১ অনুপাতে বেড়ে যায়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অ্যাপলের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ২২৭ ডলার, সেই হিসেবে বিল গেটসের বিক্রি করে দেওয়া শেয়ারের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৫৭ বিলিয়ন ডলারে!
যদিও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য বিল গেটস অ্যাপলকে সাহায্য করেছিলেন, তারপরও তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো যায়। নতুবা অ্যাপল নামের এই ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানিটি হয়তো দেউলিয়া হয়ে যেত।
অ্যাপল যেভাবে প্রতিষ্ঠা হয় জানতে “দ্য স্টোরি অব অ্যাপল” বইটি পড়ুন।