Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের অতুলনীয় প্রতিভার কথা

বিজ্ঞানে এ যাবৎকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ কোনগুলো? আপনার মাথায় হয়তো ঘুরছে নিউটনের গতিসূত্র ও অভিকর্ষের সমীকরণগুলো কিংবা আইনস্টাইনের বিখ্যাত E = mc² এর কথা। বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ফিজিক্স ওয়ার্ল্ডের পাঠকদের মতামত কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা। তারা সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ হিসেবে নির্বাচিত করেছেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের চারটি সমীকরণকে।

ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের প্রভাব কতটা তা অনুধাবন করতে চাইলে আশেপাশে একটু নজর বুলান- রেডিও, টেলিভিশন, রাডার, মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, থেকে শুরু করে এই গোটা বৈদ্যুতিক পৃথিবীর মূলেই আছে তড়িৎচুম্বকের খেলা। আর তড়িৎচুম্বকের তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোর উপর ভর করে। আজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সমীকরণগুলোর প্রবক্তা, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে থাকবে আলোচনা।

ম্যাক্সওয়েল ও তার সমীকরণ; Source: schuetky.com

গণিতকে বলা হয়ে থাকে ‘বিজ্ঞানের ভাষা’। গণিতের সাহায্য ছাড়া বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো কষ্টকর। এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল তড়িৎচুম্বক নিয়ে করা ফ্যারাডের গবেষণার ক্ষেত্রেও। বিদ্যুৎ ও চুম্বক নিয়ে ফ্যারাডে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন। তার অসাধারণ গবেষণাকর্মের পরেও এদেরকে ব্যবহারিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। কারণ, সেখানে ছিল যথাযথ গাণিতিক মডেলের অভাব। ফ্যারাডে পদার্থবিজ্ঞানে খুব দক্ষ হলেও গণিতে তার দখল ছিল কম। তিনি তার তত্ত্বগুলোর গাণিতিক সমীকরণ দাঁড় করাতে পারেননি।

প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। কেউ যদি একদম নিখুঁতভাবে না জানে একটি বিষয়ের পরিবর্তন হলে অন্যটির কী পরিবর্তন ঘটবে, তাহলে সেটি সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। এই কাজটি করার জন্য দরকার গণিত। তাই এ কাজগুলোর গাণিতিক মডেল দাঁড় করানো ছিল খুবই জরুরী। জরুরী এ দায়িত্ব ন্যাস্ত হয়েছিল ম্যাক্সওয়েলের ওপর।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল জন্মেছিলেন স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে; ১৮৩১ সালে, ঠিক যে বছর ফ্যারাডে তার জেনারেটর তৈরি করেন। অল্প বয়স থেকেই গণিতে তার তুখোড় প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বিশেষত গণিতকে ভাষার মতো ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে ব্যাখ্যা করতে তিনি খুবই পারদর্শী ছিলেন। ২৮ বছর বয়সে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামব্রিজে।

গণিতে তার প্রতিভা কতটা অনন্য তার প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় শনি গ্রহের বলয় নিয়ে তার গবেষণার সময়। সেসময়ের টেলিস্কোপ তেমন উন্নত ছিল না। সেসব টেলিস্কোপ দিয়ে বলয়ের সঠিক বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা সম্ভব ছিল না। তাই এ বলয়ের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের কৌতূহল মেটানোর সুযোগও ছিল না। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল হচ্ছেন গণিতের জাদুকর। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অঙ্ক কষে তিনি জানিয়ে দেন, শনির বলয় নিরেট কঠিন কিংবা অবিচ্ছিন্ন তরল পদার্থ দিয়ে গঠিত হওয়া সম্ভব নয়। এটি বরং অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণার সমন্বয়ে গঠিত। তার বিশ্লেষণ এতটাই যৌক্তিক ছিল যে, তিনি এর জন্য এডাম’স প্রাইজ অর্জন করেন। এর এক শতাব্দী পর ভয়েজার মহাকাশযান যখন শনির বলয়ের ছবি পাঠাল পৃথিবীতে, তখন প্রমাণ হলো ম্যক্সওয়েল আসলেই সঠিক ছিলেন।

শনির বলয়; Source: Youtube/Space Telescopes

ম্যাক্সওয়েলের পরিবারিক আত্মীয় ছিলেন প্রফেসর উইলিয়াম থমসন। তিনি পরবর্তীতে লর্ড কেলভিন নামে পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাপ-গতিবিদ্যা, তড়িৎচুম্বকত্ব ও টেলিকমিউনিকেশনে তার কাজের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। ম্যাক্সওয়েল যখন কেমব্রিজের ছাত্র তখন গণিতে তার মেধা দেখে থমসন মুগ্ধ হন ও তাকে ফ্যারাডের কাজ নিয়ে পড়াশোনা করতে উৎসাহ দেন। থমসন বুঝতে পেরেছিলেন, ফ্যারাডের পরীক্ষাগুলো থেকে প্রাপ্ত ফলাফলকে গাণিতিক রূপ দেয়ার জন্য ম্যাক্সওয়েলের মতো তুখোড় গাণিত প্রতিভারই প্রয়োজন।

তড়িৎচুম্বকত্বে সম্পূর্ণ মগ্ন হবার পূর্বে অন্যান্য দিকেও ম্যাক্সওয়েল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তার মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান, নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব, পরিসংখ্যান বলবিজ্ঞান, তাপগতিবিদ্যা ও রং মিশ্রণের বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর সর্বপ্রথম রঙ্গিন ছবিও ছাপিয়েছিলেন তিনি। ১৮৬২ সালে উইলিয়াম থমসনের সুপারিশক্রমে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি থেকে তাকে তড়িৎচুম্বকত্বের গাণিতিক ভিত্তি দাঁড় করানোর দায়িত্ব দেয়া হয়।

লর্ড কেলভিন; Sourece: Wikimedia Commons/Hubert von Herkomer

দায়িত্ব নেবার পর ম্যাক্সওয়েল সর্বপ্রথম দেখা করলেন মাইকেল ফ্যারাডের সাথে। তখন ৭১ বছর বয়সী ফ্যারাডে তার সকল জ্ঞান ও ভাবনা যুবক ম্যাক্সওয়েলকে জানালেন, আর আশায় রইলেন শীঘ্রই প্রতিভাধর এ গণিতবিদ তড়িৎচুম্বকত্বের নানা দিকগুলোর মধ্যে একটি শৃংখলা নিয়ে আসবে। ম্যাক্সওয়েলও কাজে নেমে পড়লেন। ফ্যারাডের তত্ত্বের পাশাপাশি অ্যাম্পিয়ার, গাউস, লর্ড কেলভিন সহ আরো অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণা একত্র করলেন। তড়িৎ ও চুম্বকত্বের জটিল সম্পর্কের গাণিতিক মডেল তৈরি করার জন্য নিউটনিয়ান মেকানিক্স, প্রবাহী বলবিদ্যা ও তাপ গতিবিদ্যার নীতিগুলো প্রয়োগ করতে লাগলেন।

এগারো বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি সফল হলেন। ১৮৭৩ সালে তিনি প্রকাশ করলেন তার অনন্য গবেষণাপত্র,  A Treatise on Electricity and Magnetism। দেখতে সহজ সরল চারটি সমীকরণের মাধ্যমে তিনি প্রকৃতির সকল তড়িৎচুম্বকীয় আচরণকে একত্রিত করলেন। অবশ্য তিনি বিশটি সমীকরণ দাঁড় করিয়েছিলেন, পরবর্তীতে বৃটিশ পদার্থবিদ অলিভার হেবিসাইড এগুলোকে চারটিতে নিয়ে আসেন। এ সমীকরণগুলোর কল্যাণে তড়িৎচুম্বকীয় যেকোনো আচরণ সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ কিংবা অনুমান করা সম্ভব হয়। উনিশ শতকের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভিত্তি ছিল এ চারটি সমীকরণ।

ম্যাক্সওয়েল ও ফ্যারাডে, তড়িৎচুম্বকের দুই দিকপাল; Source: thequantumx.com

বিজ্ঞানীরা ততদিনে জানতেন, মানুষের রেটিনায় থাকা সংবেদী কোষগুলো একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের মধ্যেই কেবল কেবল সাড়া দেয় এবং মানুষ তাতে দেখতে পায়। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো বলছে এ নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বাইরেও এর চেয়ে চেয়ে ছোট কিংবা বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আরো অনেক তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ রয়েছে। এ বিষয়টির সাথে অনেকেই তখন একমত হতে পারেননি।

 

তখন ম্যাক্সওয়েলিয়ান্‌স নামে পরিচিত একদল বিজ্ঞানী নেমেছিলেন এ ধরনের অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের খোঁজে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, পনের বছর ধরে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরও তারা এমন কোনো তরঙ্গের সন্ধান পাননি। অবশেষ ১৮৮৮ সালে এসে ম্যাক্সওয়েলের এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, যখন হাইনরিখ হার্জ নামক একজন জার্মান পদার্থবিদ রেডিও ওয়েভ বা বেতার তরঙ্গ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন।

হাইনরিখ হার্জ; Source: famousscientists.com

হার্জ যে তরঙ্গ উৎপন্ন করেছিলেন তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক মিটার। দৃশ্যমান আলোর চাইতে প্রায় এক মিলিয়ন গুণ বেশি দীর্ঘ। তবে এর বৈশিষ্ট্য আলোর মতোই, ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোও সম্পূর্ণরূপে মেনে চলে। হার্জের আবিষ্কারের পর এক্স-রে, গামা রে, মাইক্রোওয়েভ সহ একের পর এক নতুন নতুন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হতে থাকে। অতিবেগুনী রশ্মিও যে একধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সেটিও প্রমাণ হলো ম্যাক্সওয়েলের সূত্রের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য। ম্যাক্সওয়েল দেখে যেতে পারেননি হার্জের উদ্ভাবন। তার সিদ্ধান্ত যে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে তা জানবার আগেই ১৮৭৯ সালে পাকস্থলীর ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

সেই ১৬০০ সালে গিলবার্টের চুম্বকত্ব নিয়ে গবেষণা দিয়ে শুরু হয়েছিল তড়িৎচুম্বকত্বের পথচলা। হার্জ ও ম্যাক্সওয়েলের অবদানে তা শক্ত ভিত্তি পায়। এরপর শুধু প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত প্রস্ফুটিত হওয়ার গল্প। প্রায় তিনশ বছরের এই সময়টাকে একটু দীর্ঘ মনে হতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে তারা শুরু করেছিলেন একদম শূন্য থেকে। যে ভিত তারা দিয়ে গেছেন, আধুনিক পৃথিবী এখনো সেই আদলেই গঠিত। আজকে আমরা যে যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছি সেগুলো তৈরিতে প্রথমেই আসে ম্যাক্সওয়েলের সে চারটি সমীকরণের কথা।

ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যুর আরো বহু বছর পর পৃথিবীর আরেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার অফিসের দেয়াল সাজিয়েছিলেন তার সবচেয়ে পছন্দের তিনজন বিজ্ঞানীর ছবি দিয়ে। সে তিনজন ছিলেন, আইজ্যাক নিউটন, মাইকেল ফ্যারাডে এবং জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।

তথ্যসূত্র

Conquering the Electron by Derek Cheung , Eric Brach , page (29-35)

ফিচার ইমেজ: fizikakademisi.com

Related Articles