
মঙ্গল গ্রহে যেতে মানুষের এখনো অনেক দেরি। আর সেখানে বসবাসের চিন্তা? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা বসে নেই। যদি কখনো সত্যি সত্যিই মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপন করতে হয়, তাহলে কেমন হতে পারে সে বাসস্থানগুলো? কী সব পদার্থ দিয়ে নির্মিত হতে পারে বাড়িঘরগুলো? কেমন হতে পারে তার নকশা? কী কী সুযোগ সুবিধা থাকতে পারে তাতে? এসব নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা।
২০১৫ সালে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের Centennial Challenges এর অধীনে 3D-Printed Habitat Challenge শিরোনামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সর্বমোট ২৫ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কারের এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য হচ্ছে মঙ্গল গ্রহে বসবাসের উপযোগী এমন ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ বাসস্থানের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করা, যা মঙ্গল গ্রহে পাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক পদার্থকে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে সম্পূর্ণ থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে নির্মাণ করা সম্ভব হবে।

একাধিক ধাপে বিভক্ত প্রতিযোগিতাটির প্রথম ধাপে ছিল সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের উপযোগী বাসস্থানের স্থাপত্য মডেল উপস্থাপন করা। দ্বিতীয় ধাপে ছিল বাসস্থানে নির্মাণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, যেখানে বাসস্থানের মূল কাঠামো নির্মিত হবে থ্রিডি প্রিন্টারের সাহায্যে। আর সেটি হবে মহাশূন্যে সুলভ এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যায় এমন খনিজ পদার্থ ব্যবহার করে। সর্বশেষ আয়োজন করা হয় তৃতীয় ধাপের, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্থপতি ও প্রকৌশলীদের বিভিন্ন দলকে আহ্বান জানানো হয়, তাদের প্রস্তাবিত বাসস্থানের একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার মডেল উপস্থাপন করার জন্য এবং একইসাথে বাসস্থানের প্রকৃত আকারের এক তৃতীয়াংশের সমান একটি ক্ষুদ্র মডেল তৈরি করে দেখানোর জন্য।

তিনটি ধাপের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় আয়োজনের। তৃতীয় ধাপে আবার পাঁচটি লেভেল আছে, যার মধ্যে দুটি মডেলিং সংক্রান্ত এবং তিনটি নির্মাণ সংক্রান্ত। সম্প্রতি নাসা এর মডেলিং সংক্রান্ত একটি লেভেলে পাঁচটি বিজয়ী দলের নাম এবং তাদের প্রস্তুতকৃত মডেলের ভিডিও প্রকাশ করেছে। বিজয়ী দলগুলো সবাই মিলে মোট ১ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার পাবে। নাসার সেন্টেনিয়াল চ্যালেঞ্জের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনসি রোমানের ভাষায়, এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র কাঠামো নির্মাণের প্রতিযোগিতা না, বরং এটি বাসস্থান নির্মাণের প্রতিযোগিতা, যেখানে নভোযাত্রীদের বসবাস এবং কাজ করার উপযোগী পরিবেশ থাকবে।
১ম স্থান অধিকারী মডেল: টিম জোফেরাস
নাসার থ্রিডি বাসস্থান প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসের টিম জোফেরাস। তাদের প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী, মানুষ যাওয়ার আগেই মহাকাশযানের মাধ্যমে একটি ল্যান্ডার রোবট মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করবে এবং তা থেকে একাধিক ক্ষুদ্রাকৃতির রোভার রোবট নিয়োগ করবে, যাদের কাজ হবে মঙ্গলের পৃষ্ঠে বিচরণ করে বাসস্থান নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থ সংগ্রহ করে নিয়ে আসা। এরপর ল্যান্ডার রোবটটি উপযুক্ত স্থানে সংগৃহীত পদার্থের মাধ্যমে থ্রিডি প্রিন্টিং পদ্ধতিতে বাসস্থান প্রিন্ট করবে। একটি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন হলে সেটি নিজেকে স্থানান্তরিত করে আরো এক বা একাধিক ঘর নির্মাণ করতে পারবে।
এখানে প্রস্তাবিত বাসস্থানটির মূল কাঠামো নির্মিত হবে বিশেষ একধরনের পদার্থ দিয়ে। এর নাম রাখা হয়েছে মার্শিয়ান কনক্রিট। এটি মূলত মঙ্গলের পৃষ্ঠে সুলভ বরফ, ক্যালসিয়াম অক্সাইড এবং অন্যান্য পদার্থের মিশ্রণে গঠিত কনক্রিট সদৃশ একটি পদার্থ। মূল কাঠামোর বাইরে বাসস্থানের অন্যান্য অংশ পৃথিবী থেকে নির্মাণ করে প্রিন্ট চেম্বারে করে মঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হবে এবং উপযুক্ত স্থানে বসানো হবে। সমগ্র প্রক্রিয়াটি হবে মানুষের হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং এতে সময় লাগবে ১০ থেকে ২৬ সপ্তাহের মতো।
২য় স্থান অধিকারী মডেল: টিম এআই স্পেস ফ্যাক্টরি
নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টিম এআইয়ের (Team AI.) প্রস্তুতকৃত বাসস্থানটির নাম মার্শা। এটি বিশেষ একধরনের পদার্থ দ্বারা মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে নির্মিত হবে। এটি মূলত শক্তিশালী একধরনের থার্মোপ্লাস্টিক, যা মঙ্গলে পাওয়া পদার্থ থেকে এবং পরবর্তীতে প্রকল্পের অধীনস্থ বিভিন্ন আবর্জনা থেকেও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে নির্মাণ করা সম্ভব।
মিশন এআই গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, মঙ্গলের পৃষ্ঠে সবচেয়ে উপযোগী বাসস্থান হবে সিলিন্ডার আকৃতির কোনো ক্ষেত্র। এর ব্যাস হবে ৬.৫ একক এবং উচ্চতা হবে ১২ একক। সিলিন্ডার আকৃতির হওয়ার কারণে স্বল্প ভূমির উপরেই বাসস্থানটির মধ্যে বিভিন্ন তলায় সবচেয়ে বেশি ফ্লোর এরিয়াকে কাজে লাগানো যাবে। তাছাড়া সিলিন্ডার আকৃতির হলে থ্রিডি প্রিন্টারটি একই স্থানে থেকে সম্পূর্ণ বাসস্থানটি নির্মাণ করতে পারবে। কাঠামোগত দিক থেকেও এ বাসস্থানটি হবে অত্যন্ত মজবুত এবং মঙ্গলের আবহাওয়ার সাথে মানানসই।
৩য় স্থান অধিকারী মডেল: টিম কান-ইয়েট্স
যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির টিম কান-ইয়েট্সের (Team Kahn-Yates) প্রস্তাবিত মডেল অনুযায়ী মঙ্গল গ্রহে বাসস্থান নির্মিত হবে মঙ্গলের পৃষ্ঠে অবতরণ করা স্পেস মডিউলকে কেন্দ্র করে। স্পেস মডিউলটি উপযুক্ত স্থানে অবতরণ করার পর মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে সংগৃহীত পদার্থ দ্বারা এর নিচে এবং চারপাশের ভূমিতে ফাউন্ডেশন প্রিন্ট করার কাজ শুরু করবে। এরপর ধীরে ধীরে নিজের চারপাশে চারতলা বিশিষ্ট পুরো ভবনটি প্রিন্ট করবে। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরেও ল্যান্ডারটি ভবনের অভ্যন্তরেই অবস্থান করবে এবং ভবনটির প্রিফ্যাব্রিকেটেড সেন্ট্রাল কোর হিসেবে কাজ করবে।
ভবনটির বহিরাবরণ হবে মার্শান কনক্রিট দ্বারা নির্মিত, যার উভয় পাশেই উচ্চ ঘনত্বের পলিইথিলিনের আবরণ থাকবে। সেন্ট্রাল কোরটিতে থাকবে ভবনটির বিভিন্ন সেবামূলক অংশ, যেমন বাথরুম, রান্নাঘর, পানির পাইপ, আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা প্রভৃতি। মঙ্গলের তীব্র ধুলোঝড় সহ্য করার জন্য ভবনটির নকশার ক্ষেত্রে বক্রতলবিশিষ্ট অনন্য আকৃতি বাছাই করা হয়েছে। এই আকৃতি ভবনটিকে দৃষ্টিনন্দনও করে তুলবে।
৪র্থ স্থান অধিকারী মডেল: টিম সার্চ প্লাস/অ্যাপিস কোর
নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সার্চ প্লাস এবং অ্যপিস কোর-এর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলাফল এক্স-হাউজ। এটি নির্মাণে ব্যবহার করা হবে রিগোলিথ নামক পদার্থ, যা মূলত মঙ্গলের পৃষ্ঠে অবস্থিত ধূলাবালি এবং নুড়ি পাথরের আস্তরণ। এক্স-হাউজের প্রস্তাবিত মডেলটিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাসস্থানকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেন নভোচারী, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা সেখানে কোনো প্রকার ঝুঁকির সম্মুখীন না হয়েই দীর্ঘ সময় বসবাস করতে পারেন। এটি একইসাথে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকার উপযোগী হবে।
৫ম স্থান অধিকারী মডেল: টিম নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের টিম নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি কর্তৃক প্রস্তাবকৃত মডেলটি উপবৃত্তাকার গম্বুজাকৃতির। ফাউন্ডেশনের উপর থ্রিডি প্রিন্টারের সাহায্যে মূল প্রেশার ভেসেলটি প্রিন্ট করে তার উপর বহিঃস্থ খোলস স্থাপন করা হয়, যা ভেতরের পরিবেশকে বাইরের আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দেয়। এখানে প্রতিটি পড স্বয়ংসম্পূর্ণ, যাদের একাংশে গবেষণার জন্য রয়েছে হলরুমের মতো স্থান, এবং অন্য অংশে গবেষক, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের বসবাসের জন্য ব্যক্তিগত শয়নকক্ষ ও বাথরুম।
সর্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও সেই সাথে প্রকৌশলী ও স্থপতিদের উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি এই মডেলগুলো নিঃসন্দেহে মহাকাশে ভবিষ্যতের বাসস্থান নির্মাণে অনুপ্রেরণা এবং পথিকৃত হিসেবে কাজ করবে।
ফিচার ইমেজ- NASA