
১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ সাল, পুরো প্রযুক্তি জগত অধীর উত্তেজনায় অপেক্ষা করছে সর্বপ্রথম ডিজিটাল কম্পিউটারটি দেখার জন্য। সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সামনে আসলো ENIAC (Electronic Numerical Integrator And Computer)। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অর্থায়নে এ যন্ত্রটি নির্মিত হয়েছিল অস্ত্র প্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় গাণিতিক হিসাব নিকাশের জন্য। এটি ছিল রীতিমতো দৈত্যাকার একটি যন্ত্র।
এক লাখেরও বেশী যন্ত্রপাতির দ্বারা গঠিত এই মেশিনটির ওজন ছিল তিরিশ টনেরও বেশী। আর আয়তনের কথা শুনলে তো রীতিমতো ভিরমি খেতে হয়, এটি প্রায় ১০০ ফুট লম্বা, ৩ ফুট চওড়া আর ১০ ফুট উচ্চতার একটি বস্তু ছিল। ইনিয়াক যখন প্রথম চালানো হয়, গোটা পশ্চিম ফিলাডেলফিয়ার বাতিগুলা তখন টিমটিমে হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় দুইশ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হত এটি চালানোর জন্য।

ইনিয়াক; Image Source: pinimg.com
এখন আপনার কোলে থাকা যে ল্যাপটপে বা আপনার হাতের তালুতে থাকা যে স্মার্ট ফোনে আপনি এ পোস্টটি পড়ছেন, ইনিয়াকের সাথে তার কিছু মেলাতে পারছেন কি? এ ত্রিশ টনের দৈত্যাকার কম্পিউটারের সাথে আজকের স্রেফ ১ থেকে ২ কেজি ওজনের ল্যাপটপের তুলনা করা সম্ভব! আর প্রসেসিং ক্ষমতার তুলনা করলে তো বিস্ময় আরো বেড়ে যায়।
এ দানবীয় যন্ত্রটি প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ৫,০০০ নির্দেশ কার্যকর করতে পারতো, যেখানে আজকের আইফোন-৬ স্মার্টফোনই প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫ বিলিয়ন নির্দেশ সম্পাদন করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হলো? সেই সময়কার এ অবস্থা থেকে আজ প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় আসলো কীভাবে? উত্তর হলো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা সেমিকন্ডাক্টর চিপ।

সেমিকন্ডাক্টর চিপ; Image Source: datacenterdynamics.com
সেমিকন্ডাক্টর আজকের এই ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। এই আধুনিক যুগে লাখো সেমিকন্ডাক্টর চিপ প্রতিনিয়ত কাজ করে চলছে আমাদের চারপাশে। আমাদের কম্পিউটারে, মোবাইল ফোনে, টিভিতে, সিডি প্লেয়ারে, গাড়িতে, বিমানে; বলা যায় প্রায় সব ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রই গঠিত এই সেমিকন্ডাক্টর চিপ দ্বারা। তাহলে চলুন সেমিকন্ডাক্টর চিপের হাত ধরে, প্রযুক্তির বিবর্তনের এ পথে একটু ঘুরে আসা যাক।
ইন্টিগ্র্যাটেড সার্কিট আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে ইলেক্ট্রনিক্স খাতে আধিপত্য ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের। ১৯০৪ সালের দিকে স্যার জন এমব্রোস ভ্যাকুয়াম টিউব আবিষ্কার করেন। এটি বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে বিবর্ধিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যন্ত্র। এছাড়াও সুইচিং এর ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার রয়েছে।

ভ্যাকুয়াম টিউব; Image Source: staticflickr.com
আবিষ্কারের পর থেকে ধীরে ধীরে ভ্যাকুয়াম টিউবের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে রেডিও এবং টেলিফোন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে এটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পাশ্চাত্যে প্রতি বছর প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ভ্যাকুয়াম টিউব তৈরি হতো। আর বিশ্বযুদ্ধ শেষে এ সংখ্যা গিয়ে ঠেকে এক মিলিয়নে। ভ্যাকুয়াম টিউবের দ্বারা সবচেয়ে অসাধারণ সৃষ্টিটি ছিল ইনিয়াক কম্পিউটার, যার কথা আগে বলা হয়েছে।
ভ্যাকুয়াম টিউব অসাধারণ কার্যকর একটি ডিভাইস হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন- এর জন্য অস্বাভাবিক রকমের বেশী বৈদ্যুতিক শক্তি খরচ হতো। এছাড়াও কিছুদিন পরপরই বিকল হয়ে পড়ায় এটিকে বদলাতে হতো নিয়মিতই। তাই ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝিতে AT&T বেল ল্যাবের বিজ্ঞানীরা ভ্যাকুয়াম টিউবের বিকল্প খোঁজায় সচেষ্ট হলেন। তাদের বাজি ছিল সেমিকন্ডাক্টরের উপর।

ট্রানজিষ্টর আবিষ্কারক দল; Image Source: wired.com
সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের বৈশিষ্ট্যগুলো তখন বিজ্ঞানীদের কাছে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া শুরু করেছে কেবল। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর এর দিকে বেল ল্যাবের বিজ্ঞানীরা সেই সোনার হরিণের সন্ধান পেলেন, সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ দিয়ে তারা তৈরি করলেন ট্রানজিস্টর। এ ক্ষুদ্র ডিভাইসটি ভ্যাকুয়াম টিউবের মতোই সুইচ হিসেবে এবং অ্যামপ্লিফায়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। আর এটি ব্যবহারের ফলে বিশাল পরিমাণে কমে যায় বিদ্যুৎ শক্তির ব্যয়।
তবে এক্ষেত্রে কোনো সার্কিট তৈরি করতে অনেকগুলো ট্রানজিস্টরকে বিভিন্ন উপাদানের সাথে তার বা সল্ডারিং এর মাধ্যমে সংযোগ দিতে হয়। আর কোনো একটি সংযোগে ঝামেলা হলে বিকল হয়ে পড়তো গোটা সার্কিটটিই। বড় ও জটিল সার্কিটের ক্ষেত্রে এটি ছিল বেশ ঝামেলার ব্যাপার। এ সময় জ্যাক কিলবী একটি বৈপ্লবিক আইডিয়া নিয়ে হাজির হন। তিনি ধারণা দেন যে, একটি ক্ষুদ্র সেমিকন্ডাক্টরের টুকরোর থেকেই যদি সার্কিটের বিভিন্ন উপাদানগুলো তৈরি করা যায় এবং এর মধ্যেই যদি সার্কিট সাজানো যায় তবে কানেকশনের এ সমস্যাটা আর থাকে না।

জ্যাক কিলবী; Image Source: imur.info
জ্যাক কিলবী তার আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করেন। প্রথম পরীক্ষামূলক প্রদর্শন করেন ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। এটি সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে কাজ করে আর উদ্ভাবিত হয় ইন্টিগ্র্যাটেড সার্কিট বা সেমিকন্ডাক্টর চিপ। এ চিপ শুধুমাত্র তার সংযোগের ঝামেলা থেকেই মুক্তি দেয়নি, এছাড়াও এটি সার্কিটকে আরো নিবিড় ও সুসংহত করে তোলে। এর ছয় মাস পর রবার্ট নয়েস নামে অন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার স্বতন্ত্রভাবে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট উৎপাদনের অন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। বিশাল সংখ্যক চিপ প্রস্তুত এর জন্য তার পদ্ধতিটি অধিক উপযোগী ছিল। সেসময়ে সদ্য গড়ে উঠা ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি ইন্টেল লুফে নেয় তাকে। এরপরই শুরু হয় সেমিকন্ডাক্টর চিপের ইতিহাস গড়ার গল্প।
সেমিকন্ডাক্টর চিপের সক্ষমতা সর্বপ্রথম ভালোভাবে প্রকাশিত হয় পকেট ক্যালকুলেটরের ক্ষেত্রে। আগেকার ক্যালকুলেটরগুলো বেশ গাবদা গোবদা টাইপ ছিল আর কাজ করার সময় প্লাগে চার্জে লাগিয়ে রাখতে হতো। সেসময় টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস নামে একটি কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর চিপ ব্যবহার করে চমৎকার পকেট ক্যালকুলেটর উদ্ভাবন করে। তখনকার সময়ে হাতের তালুতে রাখার মতো ছোট একটি যন্ত্র জটিল সব গাণিতিক হিসেব করে ফেলছে, তার ওপর আবার প্লাগে চার্জে লাগানোর বদলে ভিতরে ছোট্ট একটি ব্যাটারির মাধ্যমেই এটা কাজ করছে, এসব রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার ছিল। সেমিকন্ডাক্টর চিপ এসব কিছু সম্ভব করে চমকে দিয়েছিল সবাইকে।

সেসময়ের পকেট ক্যালকুলেটর; Image Source: hnf.de
এরপরের সময়ে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির হার ছিল অস্বাভাবিক রকমের বেশী। বর্তমানে আঙ্গুলের নখের সমান একটি সেমিকন্ডাক্টর চিপে সাজানো থাকে বিলিয়ন বিলিয়ন উপাদান। সেমিকন্ডাক্টরের অগ্রগতির বিষয়ে ইনটেল এর সহ প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর এর বেশ জনপ্রিয় একটি তত্ত্ব আছে। তার মতে, “প্রতি দুই বছরে সেমিকন্ডাক্টর চিপের প্রসেসিং ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়তে থাকে, অন্যদিকে দাম কমে নেমে যায় প্রায় অর্ধেকে।”।মুর এর এ তত্ত্ব প্রায় চার দশকের বেশী সময় ধরে ধরে এখনো বহাল আছে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে।
আর এ অগ্রগতির উপমা দিতে গিয়ে গর্ডন মুর একবার বলেছিলেন “যদি অটো ইন্ডাস্ট্রিও সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির মতো এত এগোতে পারতো, তবে আজ রোলস রয়েস প্রতি গ্যালন জ্বালানীতে অর্ধ মিলিয়ন পথ যেতে পারতো। আর পার্ক করার ঝামেলায় যাওয়ার চেয়ে একটা রোলস রয়েসকে ফেলে দেয়াই বেশী উপযোগী হতো।”

Image Source: indiesemi.com
বর্তমানের প্রযুক্তি জগত এ চিপ ছাড়া কল্পনা করাই যায় না। এই ক্ষুদ্র চিপের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের সিলিকন ভ্যালী আর বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি। এটি ছাড়া আইফোন, আইপড থাকতো না, এন্ড্রয়েড থাকতো না; সম্ভব হতো না ল্যাপটপ থেকে শুরু করে এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনও। অস্তিত্ব থাকতো না গুগল, মাইক্রোসফট, স্যামসাং কিংবা অ্যাপল এর মতো টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও।
তাই আজ যখন আপনি আপনার টেলিভিশনটি চালু করছেন বা কথা বলছেন আপনার মোবাইলে অথবা আপনার কম্পিউটার নিয়ে বসছেন ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে। এক মুহূর্তের জন্য থামুন এবং অনুভব করুন সেই ক্ষুদ্র চিপটিকে যার ফলে আজ এসব কিছু সম্ভবপর হয়ে উঠেছে।