ধরুন, আপনি কোনো বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আপনার প্রতিষ্ঠান এমন পণ্য বা সেবা উৎপাদন করতে পারে, যেগুলো পৃথিবীর যেকোনো দেশেই জনপ্রিয়তা লাভ করার সামর্থ্য রাখে। আপনি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও আপনার প্রতিষ্ঠানকে পরিচিত করতে চান। বিশ্বায়নের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ থেকে অধিক মুনাফা তৈরির পথও আপনার সামনে খোলা আছে। এখন কথা হচ্ছে, আপনার প্রতিষ্ঠানকে বিদেশের বাজারে পরিচিত করার আগে সবার আগে কোন দিকটি খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন আপনি? এই প্রশ্নের একেবারে সহজ উত্তর হচ্ছে– বাজার। আপনার উৎপাদিত পণ্যের বাজার যদি নিশ্চিত না থাকে, তাহলে বাইরের দেশ তো দূরের কথা, নিজ দেশেও আপনার প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না।
প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চীনের বাজার খুবই আকর্ষণীয়। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায়, পুরো আমেরিকায় যত মানুষ আছে, তার দ্বিগুণ মানুষ চীনে নিয়মিত ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে। যেহেতু ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে, তাই আপনাকে বুঝে নিতে হবে চীনে আমেরিকার মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ মানুষের হাতে এমন ডিভাইস রয়েছে, যাতে ইন্টারনেট সেবা উপভোগ করা যায়। এছাড়াও আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, চীনে যে হারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাড়ছে, তা এশিয়ায় সর্বোচ্চ। খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছে, চীন তার দেশের কিংবা বিদেশের যেকোনো প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত চমৎকার একটি বাজার। যদি কোনোভাবে চীনা নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে গুণগত মানসম্পন্ন প্রযুক্তিপণ্য বা প্রযুক্তিসেবা সরবরাহ করা যায়, তাহলে বিশাল অংকের মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা আছে। সেই মুনাফা দিয়ে পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ সম্ভব।
উৎপাদিত পণ্য কিংবা সেবার বাজার থাকলেও সেখানে টিকে থাকা কিন্তু একেবারে সহজ নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেকোনো বাজারেই একাধিক প্রতিষ্ঠান থাকে, তাই টিকে থাকতে হলে অন্যদের চেয়ে ভালো পণ্য ও সেবা উৎপাদন করতে হয়। এছাড়া উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভোক্তার পরিবর্তনশীল চাহিদার প্রতি মিল রেখে বাজারে পণ্যের সরবরাহ করতে হয়। সের্গেই ব্রিন ও ল্যারি পেইজের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া গুগলও চীনের বাজারে এসে শুরুতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৯৮ সালে গুগল প্রতিষ্ঠা হয় আর এর দুই বছর পরেই চীনের দুই প্রযুক্তিবিদ রবিন লি ও এরিক জু এ হাত ধরে চীনা সার্চ ইঞ্জিন ‘বাইডু’ (Baidu) যাত্রা শুরু করে। আমেরিকার উদ্ভাবনের খুব অল্প সময়ের মধ্যে চীনের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন তৈরির ঘটনা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীনের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বেরই পরিচয় বহন করে।
মজার বিষয় হলো, চীনের বাজারে এসে বাইডু ও গুগল মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সার্চ ইঞ্জিন গুগল চীনের বাজারে প্রবেশ করেছিল বাইডুর মাধ্যমেই। শুরুর দিকে বাইডুর আড়াই শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিল গুগল, মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলারে। পরবর্তীতে নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন (google.cn) বাজারে আনার অল্প সময় আগে তারা ষাট মিলিয়ন ডলারে সেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ২০০৬ সালে চীনে গুগলের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন বাজারে আসে। বাইডুর সমপরিমাণ না হলেও চীনে গুগলের জনপ্রিয়তায় কখনও ভাটা পড়েনি। ২০০৯ সালে চীনের সার্চ মার্কেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। বাইডুর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে হিমশিম খেলেও চীনা নেটিজেনদের মধ্যে গুগলের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছিল, সেই সাথে বাড়ছিল তাদের শেয়ারের দাম। যেহেতু চীনের বিশাল বাজারে গুগল নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল, তাই হঠাৎ করেই তারা নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবে– এরকমটা কেউ ভাবতে পারেনি।
২০১০ সালের দিকে গুগলের চীনা সার্চ ইঞ্জিনে বড় ধরনের সাইবার অ্যাটাক পরিচালনা করা হয়। ‘অপারেশন অরোরা’ কোডনেমের আড়ালে চীনা হ্যাকাররা সেই সাইবার অ্যাটাকের মাধ্যমে অসংখ্য চীনা মানবাধিকার কর্মীর তথ্য হাতিয়ে নেন, গুগলের নানা রকমের ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’র উপর নগ্ন আক্রমণ পরিচালনা করেন। গুগল এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে যায় এবং তদন্ত শুরু করে। তদন্তের রিপোর্টে দেখা যায়, সাইবার অ্যাটাক চীন থেকেই পরিচালনা করা হয়েছে। পরবর্তীতে সেন্সরশিপ নিয়ে চীনা সরকারের সাথে গুগলের বড় ধরনের ঝামেলা শুরু হয়। চীনা সরকারের যেকোনো বিরুদ্ধমত দমন কিংবা বাইরের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গুগলের সার্চকৃত ফলাফলের উপর সেন্সরশিপ আরোপ করে, যেটি গুগলের কর্তাব্যক্তিদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। শুধু গুগলই নয়, বাইডুর সাথেও চীনা সরকারের সেন্সরশিপ ইস্যুতে ঝামেলা হয়েছিল।
পৃথিবীর যে ক’টি দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে হ্যাকারবাহিনী পরিচালনা করে, তাদের মধ্যে চীন অন্যতম। চীনা হ্যাকারদের কুখ্যাতি রয়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে অর্থনৈতিকভাবে পরাশক্তি হওয়া জরুরি। আর অর্থনীতি ঠিক রাখার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি বড় শর্ত। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই চায় না তাদের একদলভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কোনো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হোক। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তারা মুক্তবাজার পদ্ধতিকে গ্রহণ করলেও রাজনৈতিকভাবে তারা কখনই বিরুদ্ধ মত বা কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের বাইরের কোনো কিছুকে সহ্য করা হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে চীনা হ্যাকাররা তাদের নিজ দেশের বিরুদ্ধমতকে দমনে বিশাল সহায়তা করে। চীনা মানবাধিকার কর্মীদের জি-মেইল থেকে তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যে চীনা হ্যাকারদের সাইবার অ্যাটাক ক্যাম্পেইনের অংশ ছিল– এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চীনের বাজারেও বাইডুর সাথে পেরে উঠতে গুগলকে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছিল। বাইডু প্রতিষ্ঠার পেছনে যারা ছিলেন, তারা চীনের নাগরিক হিসেবে চীনা সমাজের চাহিদার বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝতেন। এজন্য দেখা যায়, ২০০৫ সালের দিকেই বাইডু চীনের প্রায় ২০০টি শহরে ই-কমার্সের ধারণা নিয়ে হাজির হয়, অথচ সেসময় গুগলের সে-ধরনের কোনো উদ্যোগ ছিল না। চীনা সার্চ ইঞ্জিনের জন্য প্রথমদিকে গুগল সিলিকন ভ্যালির সেই প্রযুক্তিবিদদের উপরই নির্ভরশীল ছিল। মান্দারিন ভাষার কোডিংয়ের ক্ষেত্রে সিলিকন ভ্যালির মানুষেরা খুব বেশি দক্ষ ছিল না, সার্চের ক্ষেত্রে চীনা নেটিজেনরা প্রথমদিকে খুব বেশি সুবিধা পাননি গুগল থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে চীনের নাগরিকদের মধ্য থেকে গুগলে অসংখ্য কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়, যারা মান্দারিন ভাষার কোডিংয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। বাইডুর সাথে পেরে না উঠলেও বিশাল বাজারের কল্যাণে গুগল ঠিকই লাভবান হচ্ছিল। কিন্তু সাইবার আক্রমণের কারণে তাদের ভাবমূর্তি প্রচন্ডভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং চীনে ২০১০ সালে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলে।
অনেকেই বলে থাকেন চীনে গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের কার্যক্রম ছিল একটি ‘ছোটখাট পরীক্ষা’। চীনের বাজার হারিয়েছে বলে গুগল মুনাফাবঞ্চিত হয়েছে, কিন্তু সেটি বিশ্বের অন্যান্য বাজারের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি। চীনের সাইবার আক্রমণ তাদেরকে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক পদ্ধতি অবলম্বন করতে বাধ্য করেছে। বিশ্বজুড়ে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, কিন্তু চীনে বাইডু তাদেরকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল। গুগলের প্রস্থানের পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করতে গেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অন্ধকার দিকগুলোর দিকেই বারবার আঙুল তাক করতে হয়।
চীনে তথ্য-প্রযুক্তিখাতে ব্যবসা করা খুব সহজ নয়, কমিউনিস্ট পার্টির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা খুবই কঠিন। চীনা বাজার থেকে গুগলের প্রস্থান আমাদের বার্তা দেয়– চীনে ব্যবসা করতে গেলে কমিউনিস্ট পার্টির বেধে দেয়া নিয়মে করো, না হয় চলে যাও।