![](https://assets.roar.media/assets/axHfBc7hx6a2THaB_4790.jpg?w=1200)
বর্তমানে পদভ্রমণের জন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঘেরা কোনো স্থান বাছাই করা বেশ কষ্টকর। ব্রিটেনস লং ডিসটেন্স ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, পদভ্রমণের জন্য শুধুমাত্র ব্রিটেনেই রয়েছে ১,১০০টি স্থান। তবে কোনটা সবচেয়ে বেশি ভালো বা খারাপ, তা বলা মুশকিল। কেননা, প্রতিটি স্থানেরই আছে বিশেষ কোনো ইতিহাস বা সৌন্দর্য। আজকের এই আলোচনা মূলত ব্রিটেনের প্রধান ১০টি ঐতিহাসিক স্থানে পদভ্রমণ সম্পর্কে।
১. টোলকিয়েন ট্রেইল
টোলকিয়েন ট্রেইল শুরু হয় হার্স্ট গ্রিন গ্রাম থেকে। এখানে কোনো দোকান নেই। তবে এই পথে যাওয়ার সময় একজন পর্যটকের চোখে পড়বে তিনটি মদের দোকান এবং ৫০০ বছরের একটি পুরনো কলেজ স্টোনিহার্স্ট। এই কলেজ থেকেই স্যার আর্থার কোনান ডয়েল ও জিনার্ড মানলে হপকিন্স পড়াশোনা করেন। আর বিখ্যাত লেখক জে আর আর টোলকিয়েন তার জীবনের বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটিয়েছেন।
![](https://assets.roar.media/assets/DWHFmuFmdToLExyp_f4666744c6a8b2ec6696efc485d76374.jpg)
তিনি সবসময়ই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কদর করতেন। আর এই কলেজের মনোরম দৃশ্য ও ইতিহাস তাকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে তিনি তার জনপ্রিয় বই ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’-এ টোলকিয়েন ট্রেইলের বিভিন্ন স্থানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখও করেন। পাঁচ মাইলের এই ট্রেইল একসময় ‘ক্রোমওয়েল ব্রিজ’ নামে পরিচিত ছিল। টোলকিয়েন ট্রেইল দিয়েই ১৬৪৮ সালে নিউ মডেল আর্মি প্রেস্টনের রাজপরিবারের সাথে ঐতিহাসিক এক সাক্ষাৎকারে যান। এছাড়া এখানে রয়েছে কাল্পনিক ডাইনিদের জন্য পরিচিত পেন্ডেল হিল এবং ক্লিথেরো দুর্গ।
২. ওয়ার পোয়েট, গ্লৌচেস্টারশায়ার
‘ওয়ার পোয়েট’ বা ‘যুদ্ধকবি’ বলতে মূলত রবার্ট ফ্রস্ট, এডওয়ার্ড থমাস এবং উইলফ্রেড গিবসনসহ মোট ছ’জন কবিকে বোঝায়। আর ‘ওয়ার পোয়েট ট্রেইল’ এর নামের পেছনে দায়ী এই ছয় কবির ঐতিহাসিক ভ্রমণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ব্যাপকভাবে ছড়ানোর আগে দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের প্রদেশ গ্লৌচেস্টারশায়ারের গ্রাম ডাইমকে তারা সাহিত্যচর্চার জন্য একত্রে যান। ঘটনাটি ১৯১৪ সালের দিকের। তারা একসাথে এই সবুজ গ্রামটির মনভোলানো দৃশ্য উপভোগ করেন, এগুলো নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ করে তা নিয়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তবে থমাস এবং ফ্রস্টের প্রথম দেখা হয় ১৯১৩ সালে।
![](https://assets.roar.media/assets/SDqQVIe1Sq6soeqN_4104.jpg)
অবশ্য তখন কেউ সফল কবি ছিলেন না। পরবর্তীতে তারা একজন আরেকজনের সফল হওয়ার পেছনে বেশ অবদান রাখেন। ১৯৯০ সালে এডওয়ার্ড থমাসের একজন বংশধর যুদ্ধকবিদের উদ্দেশ্যে দুটি আট মাইলের পথ উন্মুক্ত করেন, যা ডাইমক গ্রাম থেকে শুরু হয় এবং কবি-লেখকদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কুঁড়েঘরের কাছে গিয়ে শেষ হয়। এই ওয়ার পোয়েট ট্রেইল সেই ঐতিহাসিক পদভ্রমণই নির্দেশ করে।
৩. টিন ট্রেইল, কর্নওয়াল
‘টিন ট্রেইল’কে ‘টিন কোস্ট ওয়াকস’ও বলা হয়। সেন্ট জাস্ট স্কয়ার থেকে পেন্ডিন ওয়াচ পর্যন্ত পুরো অংশই এই টিন ট্রেইলের অন্তর্ভুক্ত। ২.৮ মাইলের এই রাস্তাটি জ্যাকসন ঝর্ণার পাশেই অবস্থান করছে। কেনিডজ্যাক উপত্যকা দিয়ে যাওয়া এই ট্রেইল বোটালাক, লেভান্ট এবং গিওর খনির ইতিহাস এবং দুঃখের সাক্ষী। তাছাড়া একজন পর্যটক সেখানে গ্রানাইট ক্লিফাসাইড ক্র্যাগস এবং জাউনস (ক্ষুদ্র উপসাগর), ইঞ্জিনের ঘর এবং পেন্ডিন ওয়াচের লাইটহাউজও দেখতে পারবেন।
![](https://assets.roar.media/assets/5OER5UNLXONAJ5fa_Tin-Coast-Cycle-Trail-Bike-Hire-Cornwall-1024x680.jpg)
৪. এসচুয়ারি অ্যাম্বল, ফির্থ টু ফোর্থ
স্কটল্যান্ডের ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপ জানার জন্য এই ‘এসচুয়ারি অ্যাম্বল’ নিঃসন্দেহে একটি উপযুক্ত স্থান। ব্ল্যাকনেস দুর্গ থেকে উত্তর কুইনসফেরি পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথ বর্ণনা করে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন সময়ের ঘটনা। এখানে এসে দেখতে পারবেন ঐতিহাসিক ব্ল্যাকনেস দুর্গ, হোপটাউন হাউজ, কুইনসফেরি ও ফোর্থ ব্রিজ। ব্ল্যাকনেস দুর্গ ১৫ শতকের একটি ঐতিহাসিক নির্মাণ। আর হোপটাউন হাউজ ১৭ শতকে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ি ছিল এবং ফোর্থ ব্রিজ ১৮, ২০ এবং ২১ শতকের প্রকৌশলবিদ্যার নিদর্শন হিসেবে কাজ করে।
এসচুয়ারি অ্যাম্বল পুরো ঘুরে আসার জন্য প্রথমেই ট্রেন নিয়ে যাবেন এডিনবার্গ, এরপরে লিনলিথগো এবং সেখান থেকে বাস নিয়ে যেতে পারেন ব্ল্যাকনেস দুর্গে। তারপরই আপনার সামনে পড়বে সাত মাইলের একটি ফুটপাথ, যা আপনাকে নিয়ে যাবে কুইনসফেরিতে। আর এই পথে ফোর্থ ব্রিজের দেখাও পেয়ে যাবেন।
![](https://assets.roar.media/assets/OyxyMOTbP7yRCeVr_3600.jpg)
৫. ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেরিটেজ, সোয়ানসিয়া
১৭৭০ সাল থেকে ১৯ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত ওয়েলসের শহর সোয়ানসিয়া ছিল গলানো লোহা উৎপাদনের জন্য বিশ্বের অন্যতম মূল স্থান। তাউই নদীর উপরই মূলত অবস্থান এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেরিটেজ ট্রেইলের। চার মাইলের এই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাবেন শহরটির কিছু শিল্পানুরাগী স্মৃতিচিহ্ন এবং ধ্বংসাবশেষ। বিনষ্ট ঘাট, পরিত্যক্ত ভাঁটা এবং মূল ঘাটের কিছু অবশিষ্টও রয়েছে এখানে। বর্তমানে স্থানটিতে একজন পর্যটক যেকোনো সময় চাইলেই যাওয়া-আসা করতে পারবে না। কেননা, বর্তমানে জায়গাটি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। এমনকি একে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেরিটেজ পার্কে পরিণত করারও কাজ চলছে।
![](https://assets.roar.media/assets/JMbGQTfQubAPzHrT_3fd5c74872dfccf43e24c574b98002c5.jpg)
৬. মিলস বুন, ডার্বিশায়ার
ডার্বিশায়ারের টাইডসওয়েলের কাছে উই নদীর খাড়া উপত্যকায় গাছপালায় ঢাকা একটি সুন্দর ট্রেইল দেখা যায়। আর এটাই হলো মিলস বুন। ১৮ শতকের শেষের দিকে এই জায়গায় শিল্প বিপ্লব ঘটে। পাঁচ মাইলের পথটি শুরু হয় মোনসাল হেড কার পার্ক থেকে, যা অব্যবহৃত রেলওয়ে টানেল এবং ব্রিজের উপরের মনোরম দৃশ্য প্রদর্শন করে।
![](https://assets.roar.media/assets/gmaXlrMKv5WlB1TD_indexkk.jpg)
এরপরই দেখা যায় লিটোন মিল। এই মিলটি একসময় কুখ্যাত ছিল এই স্থানের কাজ করার খারাপ পরিবেশ এবং শিশুশ্রমের জন্য। আর এখানকার মিলারস ডেলের মিল নেসেলসে এখন অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। নতুন বিভিন্ন নির্মাণের পরও এখানে কেমন জানি এক অদ্ভুত পরিবেশ বিরাজ করে। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অন্যদিকে প্রযুক্তির পরিবর্তন একত্রে চোখের সামনে ভেসে ওঠে এই মিলস বুনে।
৭. পিলগ্রিমস প্রগ্রেস, কেন্ট
দ্য ডেভিলস নিডিং ট্রু এবং ওয়াই ক্রাউনের কাছে উত্তর ডাউনস চক পাহাড়ের উপর আকর্ষণীয় ওয়াই গ্রাম রয়েছে। এই গ্রামেই অবস্থিত পিলগ্রিমস প্রগ্রেস। এটি প্রায় চার মাইলের একটি পথ। যা অ্যাশফোর্ড থেকে কয়েক মাইল এবং লন্ডন থেকে এক ঘণ্টার ট্রেন যাত্রার দূরত্বে অবস্থিত। দ্য নর্থ ডাউনস ওয়ে ন্যাশনাল ট্রেইলের আরম্ভ ১৯৭৮ সালে। এর অবস্থান উইনচেস্টার এবং ক্যান্টারবারি ক্যাথেড্রালের মাঝের পথ দিয়ে। পিলগ্রিমস প্রগ্রেস ট্রেইলে অবস্থিত থমাস বেকেট মন্দিরে তীর্থযাত্রীরা প্রাচীনকালে প্রার্থনা করতো। রাজা দ্বিতীয় হেনরির হাতে থমাসের মৃত্যুর পর এই কার্যক্রমের শুরু হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/rn3a0mwQQQE63fqO_1000.jpg)
৮. অ্যা পিস অব পর্তুগাল, নিউ ফরেস্ট
লিনধার্স্টের মিলিফোর্ড ব্রিজ কার পার্কের কাছেই অবস্থিত ‘এ পিস অব পর্তুগাল’। তিন মাইলের শান্তিপূর্ণ পথটি মনে হয় যেন কোনো অপ্রত্যাশিত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। অনবরত বয়ে যাওয়া ঝর্ণার পাশ দিয়েই গেছে রাস্তাটি। এখান দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা মেলবে হরিণ ও নিউ ফরেস্টের ছোট আকারের ঘোড়ার। এরপর পর্যটকের নজরে আসবে পর্তুগিজ ফায়ারপ্লেস বা অগ্নিকুণ্ডের।
![](https://assets.roar.media/assets/awX89CUvFtiZEwrf_The_Portuguese_Fireplace_-_geograph.org.uk_-_43995.jpg)
এই চলন্ত ও অস্বাভাবিক কীর্তিস্তম্ভের পেছনেও ইতিহাসের পাতায় একটি গল্প আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলের বাসিন্দারা যুদ্ধ করা থেকে সরে আসলে পর্তুগিজ আর্মি কানাডার আর্মির সাথে সেখানে তাঁবু স্থাপন করে এবং কাঠ উৎপাদন করার কাজ শুরু করে, যা যুদ্ধে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এখানে যারা কাজ করতো, তাদের স্মৃতিতে এই স্থানটি পরবর্তীতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
৯. ম্যানচেস্টার আনলকড
রোচডাল খালের পাশ দিয়েই যাওয়া তিন মাইলের রাস্তাটি শহরটির ইতিহাসের অসাধারণ দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে। এটা দেখলে মনে হয় নদীপথের উপরে যেন জায়গাটি ভেসে আছে। ম্যানচেস্টার আনলকড ওয়াকসে অবস্থিত পিকাডিলি স্টেশনের কাছে একটি লম্বা টানেল রয়েছে, যেখান থেকে সহজেই যাওয়া যায় ক্যানেল স্ট্রিটে। ট্রেইলের উল্লিখিত স্থানগুলোতে বিনোদনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়ও এখানে বিথাম টাওয়ার দেখা যায়। এটি একটি ভিক্টোরিয়ান গ্রেড-২ লিস্টের সাবেক পাওয়ার স্টেশন এবং মডার্ন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। ট্রেইলের লক ৮২ এর পর পথচারীরা সম্মুখীন হবে জমকালো ‘রয়েল অ্যাণ্ড মুরায়ের’ তুলার কারখানা, যার অপর প্রান্তেই আছে নিউ ইসলিঙটন পুনরুৎপাদন এলাকা।
![](https://assets.roar.media/assets/Bc2hd1DE4Bsfd0qs_4395.jpg)
১০. ফেলিক্সটো ফোর্টস, সাফোক কোস্ট
ফেলিক্সটো ফোর্টস ইংল্যান্ডের সর্বশেষ সামুদ্রিক আক্রমণের প্রতিরোধকারী স্থান। ১৬৬৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজ পরিবারের নৌবাহিনী ডাচ বাহিনীকে তাদের নিজ ভূমি থেকেই বিতাড়িত করে। দুর্গ থেকে বোডসে ম্যানর পর্যন্ত ছয় মাইলের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আপনি উপভোগ করতে পারবেন সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য, আধুনিক ঘাট এবং চায়ের জমি ও তাদের উজ্জ্বল ইতিহাসের ছোঁয়া। ফেলিক্সটোর দিকে যাওয়ার সময় হালকা জলখাবারের জন্য যাওয়া যেতে পারে ‘দ্য অ্যালেক্স’-এ। উপযুক্ত সময়ে সেখানে ঘুরতে গেলে সমুদ্রের তীরে আরামে হেঁটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগও করতে পারবেন। ছবির মতো কুঁড়েঘর ও চারটি মার্টেলো টাওয়ারও দেখা যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/v2XweEGhrs9JSQks_Walks-And-Walking-Languard-Fort-Felixstowe-Walking-Route.jpg)
এই টাওয়ারগুলো নেপোলিয়নের সময় তৈরি করা হয়, যা ১৮০৫ থেকে ১৮১২ সালে শত্রুপক্ষের বিভিন্ন আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়। এখানে এসে খাওয়া-দাওয়ার কাজটা করতে পারবেন ফেলিক্সটো ফেরিতে। আর নাহলে চলে যাবেন ডেবান নদী পার করে বোডসে ম্যানরে, যেখানে ১৯৩০ সালে রবার্ট ওয়াটসন-ওয়াট তার একটি গবেষণা সম্পন্ন করেন। আর এই গবেষণাই ইংল্যান্ডের যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় রাডার তৈরিতে সহায়তা করে। এসকল ঘটনার কারণে ফেলিক্সটো ফোর্ট যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে, তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।