প্রিয় কাজ কিংবা শখের কাজের জন্য যারা সময় বের করতে পারেন না, তাদের কিন্তু এই কোয়ারেন্টিনের সময়টা বেশ কাটছে! মুভি কিংবা সিরিজ দেখা, বই পড়া, লেখালেখি, কুকিং-বেকিং সহ নিজেদের পছন্দের কাজে ডুব দিতে পারছেন অনেকেই। কিন্তু যাদের শখের ঝুলিতে জমা থাকে ট্যুর ডেসটিনেশন, তাদের জন্য এই বছরটা যুতসই নয়। পড়াশোনা, কাজ আর ব্যস্ততার ফাঁকে এ বছর জুড়েও ভ্রমণপিপাসুদের ছিল নানান পরিকল্পনা। কিন্তু বিধিবাম!
তাই ভ্রমণপিপাসুদের সময় কাটছে ফ্রেমে বাঁধানো পুরনো ছবি দেখে, কিংবা ড্রাইভের ফোল্ডারগুলো ঘেঁটে। এর সাথে নতুন যোগ ফেইসবুক মেমরি। আর সেই মেমরি লেন ধরেই আমার আজকের এই লেখার সূত্রপাত। মেমরিতে আসা ছবিটি ছিল আমার ভারত ভ্রমণের ষষ্ঠতম দিন, আর জায়গাটি ছিল দার্জিলিং। মেঘালয়, আসাম ঘুরে দার্জিলিংয়ের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল শিলিগুড়ি জিপ স্টেশন থেকে। যারা এর আগের পর্বটি পড়েননি, তারা এই লিংক ক্লিক করে পড়ে নিতে পারেন।
ভোর তখন প্রায় ৬টা। সমরেশ মজুমদার কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসখ্যাত সেই শিলিগুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমরা। জিপ স্টেশনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি দার্জিলিংগামী গাড়ির জন্য। উপন্যাসের সুবাদে স্টেশনটাকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছিল। হিমহিম ঠাণ্ডায় অপেক্ষা করছিলাম। ট্যুরিস্ট গাড়ি হিসেবে এখানে টাটা সুমোর বেশ চল রয়েছে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি আসল। ৭ সিটের টাটা সুমোটাই আমাদের পরবর্তী দু’দিনের সফর সঙ্গী। ব্যাগ সব বাঙ্কারে ভরে রওনা দিলাম দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। জিপ স্টেশন থেকে দার্জিলিংয়ের ড্রাইভিং দূরত্ব প্রায় ২ ঘণ্টা। সকাল তখন প্রায় ৮টা।
গাড়ি চলার কিছুক্ষণের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্য একটু একটু করে সামনে আসছিল। গাড়ি থেকে বহু দূরে পাহাড় দেখা যায়, ধীরে ধীরে সেই দূরের পাহাড় স্পষ্ট হয়, আবার সেই পাহাড়ের বাঁক থেকে আরেক পাহাড়ের দেখা মেলে। এভাবেই অনেকটা পথ পেরুনো শেষে আমাদের গাড়ি থামল এক রেস্তোরাঁর সামনে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো রেস্তোরাঁ আর পর্যটক বাসের সারি। দার্জিলিংয়ে রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে চায়ের দোকান- সবকিছুর সাথেই গাড়ির ড্রাইভারদের চুক্তি করা থাকে। চুক্তি অনুযায়ী, নির্ধারিত রেস্তোরাঁ কিংবা হোটেল ছাড়া গাড়িগুলো অন্য কোথাও থামায় না। হয়তো এটাই পর্যটন এলাকার বিজনেস পলিসি!
যা-ই হোক, ঢুকে পড়লাম রোডিস ক্যাফেতে। খাবার অর্ডারের কাজ আগেই শেষ। একটু ফ্রেশ হয়ে বসে পড়লাম ক্যাফের বারান্দাতে। রেস্তোরাঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মেঘে ঢাকা পাহাড়ি রাস্তার দারুণ এক দৃশ্য। এর মাঝে আমাদের অর্ডার করা খাবার চলে এসেছে। ব্রেড আর অমলেট। স্বাদ আহামরি না হলেও ঐরকম দৃশ্যের কারণেই হয়তো খাবারটাকে সুস্বাদু মনে হচ্ছিল।
তারপর খেলাম চা। এই প্রথম দার্জিলিংয়ের চায়ের স্বাদ পেলাম। চা আসতেই শুরু হয়ে গেল ইন্সটাগ্রাম গাম্ভীর্যের ছবি তোলা। বিভিন্ন ধরনের ছবি তুলতে তুলতে চা প্রায় ঠাণ্ডা। শেষমেশ শেষ হলো চা-নাস্তা পর্ব। আবার রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশে।
সকাল ১১টার দিকে পৌঁছে গেলাম হোটেলে। চেক-ইন করলাম হোটেল ব্রডওয়েতে। রুম বণ্টনের সাত-পাঁচ শেষে লাগেজ নিয়ে চলে গেলাম নিজ নিজ রুমে। ব্যাগপত্র ফেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছি। এরই মধ্যে দেখছি কারো ওয়াই-ফাই এর পাসওয়ার্ড খোঁজার দৃশ্য দেখছি, কেউ খুঁজছে লিপজেল, তো কারো আবার গিজার না চলার অভিযোগ।
কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে গেলাম রুমের বারান্দায়। বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছিল ব্রিটিশ বাবুদের বানানো ঐতিহাসিক সেই ক্লক-টাওয়ারটি। চারদিকের হোটেল-মোটেল আর পর্যটক দিয়ে এলাকাটি তখন বেশ চাঙ্গা।
তখন দুপুর ২টা। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুপুরের খাবার সেরে কিছু স্পট ঘুরে দেখার কথা। তাই নিচে নেমে সবাই দুপুরের খাবার খেতে একটি রেস্তোরাঁয় চলে গেলাম। বাঙালি খাবার অর্ডার করলেও স্বাদটা ঠিক তেমন ছিল না।
এরপর খাওয়া শেষে আমাদের সেই গাড়িতে চেপে বসলাম। রওনা দিলাম কিছু স্পট ঘুরে দেখতে।
আমাদের গাড়ি চলল জাপানিজ পিস প্যাগোডার দিকে। জাপানি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু তৈরি করেছিলেন শ্বেতশুভ্র এই পিস প্যাগোডা। প্যাগোডার মূল অংশ সেখানে বুদ্ধের মূর্তি রাখা আছে, সেখানে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যেতে হয়। সিঁড়িতে পা দেয়ার সাথে সাথেই ঠাণ্ডায় পা কেটে যাওয়ার উপক্রম। সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে গেলাম। টেম্পলের কিছু দূরে পাইন গাছের সারি। আর তার বাঁদিকে তাকালেই পাহাড় আর পাহাড়। আকাশে মেঘ না থাকলে সেখান থেকে নাকি বরফের পাহাড়চূড়া দেখা যায়।
পুরো প্যাগোডা দেখা শেষে রওনা দিলাম রক গার্ডেনের উদ্দেশে।
এখানে স্পটগুলো বেশ কাছাকাছি। গাড়িতে ওঠার ৫ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়লাম রক গার্ডেনে। ফুল, ঝর্ণার এই বাগানটি পাহাড় কেটে বানানো। রক গার্ডেনের গেটের বাইরে অসংখ্য টুরিস্ট গাড়ি আর এর পাশে বেশ কিছু চায়ের দোকান। গাড়ি থেকে নেমে অনেকে চা খাচ্ছি, কেউ আবার পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে ব্যস্ত। চা খেয়ে আমরাও রওনা দিলাম ওপরের দিকে। গিয়ে দেখি সেখানকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। দার্জিলিংয়ের এই ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলো আপনি পরতে পারবেন ৫০ রুপির বিনিময়ে। আমরাও পোশাকের লাইনে দাঁড়িয়ে নিয়ে নিলাম সেই পোশাক আর বাহারি মালা। তিন আস্তরণের জামা আর জ্যাকেটের ওপর রঙিন এই জামাগুলো পরে সবাইকে বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লাগছিল। ক্যামেরা বন্দি করে রাখলাম মুহূর্তগুলো।
তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। স্পটগুলোতে সেদিনের মতো ঘোরাঘুরি শেষ। এবার রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। ঘুরে দেখব রাতের দার্জিলিং।
গাড়িতে চেপে রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। প্রায় অর্ধেক রাস্তা যাবার পরে আমাদের মাঝে একজন দেখল, তার ক্যামেরাটা আর নেই! এমন অবস্থা যেকোনো ট্যুরের বারোটা বাজাতে একাই একশো। কোথায় কোথায় ঘুরেছি, সেই হিসাব-নিকাশ সেরে গাড়ি চলল আগের জায়গায়। ড্রাইভার নিয়ে গেলেন আগের সব স্পটে। চলে গেলাম সবার প্রথমে যাওয়া পিস প্যাগোডায়। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। প্যাগোডায় প্রবেশ দরজা আটকানো। আমরা সবাই গাড়িতেই অপেক্ষা করছি। গাড়ি থেকে দু’জন নেমে গেল গেটের ওখানে। দায়িত্বে থাকা একজন প্রহরীর কাছ থেকে পেলাম ক্যামেরা ফেরত পাবার শুভ সংকেত। পরে ভেতরে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সব তথ্য নিয়ে ক্যামেরা ফিরিয়ে দিলেন। এক জাপানি নাগরিক নাকি ক্যামেরা পেয়ে জমা দিয়েছিলেন। অবশেষে ক্যামেরা নিয়ে আবার রওনা দিলাম শহরের উদ্দেশে। আর ভাবতে থাকলাম, এমন কিছু যদি আমাদের দেশে হতো, ফিরে পেতাম কি? বা ফিরিয়ে কি দিতাম?
সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন আকাশ অন্ধকার। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চলেছে। দূর-দূরান্তে গাড়ির হেডলাইট ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাকি গাড়িগুলো হোটেল পৌঁছে গেছে। কেউ আবার হোটেল থেকে ঘোরাঘুরির জন্য বের হয়েছে। আমরা এবার চলে এলাম সিটি সেন্টার রোডে। ক্ষুধায় বেশ কাহিল। পাহাড়ি রাস্তা আর আলো ঝলমলে সব ফুড ফ্র্যাঞ্চাইজ রোডের পাশে। তাই ক্যামেরা ফেরত পাবার ট্রিট আদায়ে দেরি না করে চলে গেলাম পিজ্জা হাটে। খাওয়াদাওয়া আর সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এবার বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে।
সেখান বের হয়ে সিটি লেন ধরে হাঁটছি। রাস্তার ধারে বেশ কিছু অ্যান্টিক গয়না আর শো-পিসের দোকান। ঘুরতে ঘুরতে ঢুকলাম মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে। এখানে ডলারের রেট শিলংয়ের তুলনায় কিছুটা কম। তাই যারা যাবেন, তাদের জন্য আগে থেকে ভাঙিয়ে নিলে বেশ সুবিধা হয়। ডলার ভাঙানো শেষে কিছু দূর এগিয়ে দেখলাম, শাল আর গরম কাপড়ের দোকানে সয়লাব সিটি লেনের এপার ওপাড়। তখন রাত প্রায় ৮টা। দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। এখানে রাত ৯টার মধ্যেই সব বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমরাও হোটেলের দিকে এগোতে থাকলাম। ঘোরাঘুরি সেদিনের মতো শেষ।
হোটেলে ফিরে গেলাম সবাই। ফ্রেশ হয়ে গেলাম বারান্দায়। সেখান থেকে যতদূর দেখা যায়, মনে হয় যেন- পাহাড়ের গায়ে তারাগুলো মিটমিট করছে। আর ক্লক টাওয়ারটি দিচ্ছে সাহেবিয়ানার সাক্ষী। এরই মাঝে কেউ গল্পে ব্যস্ত, কেউ মুঠোফোনে, কেউবা বাসায় যোগাযোগ করতে।
এভাবেই রাত পার হলো।
পরের দিনের পরিকল্পনা ছিল টাইগার হিলে ভোরের সূর্যোদয় দেখা। এর মধ্যে শোনা গেল, টাইগার হিলে উঠতে নাকি ২২০০ সিঁড়ি পাড়ি দেওয়া লাগে! রাত ৩টায় সেখানকার ট্যুরিস্ট গাড়িগুলো এসে পড়ে টাইগার হিলে রওনা দেয়ার জন্য। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর ২২০০ সিঁড়ির কথা ভাবতে ভাবতে সেদিন একটু আগেই ঘুমাতে গেলাম আমরা।
টাইগার হিলে যাত্রা
রাত তখন ৩টা। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম সবাই। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ততক্ষণে চলে এসেছে। সাড়ে ৩টার পরপর রওনা দিলাম টাইগার হিলের উদ্দেশে।
আকাশভরা তারাগুলো যেন আকাশ থেকে মাটি অব্দি সাজানো ছিল। আমাদের টাটা সুমো ছুটছে আর পাল্লা দিয়ে ছুটছে রাশি রাশি তারা। রাত তখন সাড়ে ৩টা হলেও পর্যটন এলাকা হওয়াতে রাস্তা বেশ জমজমাট। আমাদের মতো অনেকেই ছুটছে টাইগার হিলের দিকে। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম স্পটের কাছে। সেখানে সারি সারি গাড়ি রাখা। গাড়ি থেকে নেমে এবার সেই ২২০০ সিঁড়ি ওঠার পালা!
পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে শুরু করলাম। বাঙালি থেকে ফিরিঙ্গি শত শত পর্যটকের গন্তব্য হিলে পৌঁছানো। ভিড়। ঠাণ্ডা আর অন্ধকার ঠেলে ২২০০ সিঁড়ির কথা ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের মধ্যে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। তখনই বুঝলাম, ২২০০ সিঁড়ি আসলে গুজব ছাড়া কিছুই নয়! সেখানে পৌঁছে দেখলাম পর্যটকেরা অপেক্ষা করছে সূর্যের দেখা পাবার। টাইগার হিলের উঁচু অংশ থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ! এর মধ্যে ক্যামেরা, মোবাইল আর সেলফি স্টিকের ভিড়ে সামনের দৃশ্য দেখা প্রায় দুঃসাধ্য। দিক সম্পর্কে প্রায় জ্ঞানশূন্য হওয়াতে সূর্য আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলবার অবস্থান নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। তাই ভিড় এড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম সূর্য ওঠার।
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম, টাইগার হিলের এক কোণা থেকে পর্যটকদের করতালির আওয়াজ। চলে গেলাম সেদিকটায়। মেঘের ফাঁকে তখন সূর্যের আভা দেখা যাচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণ পর এল সেই মুহূর্ত। সূর্যের আলো ঠিকরে কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র চূড়া তখন সোনালি রঙ ধারণ করেছে। কিছু মুহূর্তের জন্য দেখা মিলল অবিশ্বাস্য এই সৌন্দর্যের। এর মধ্যে কেউ ক্যামেরাবন্দি করছে এর সৌন্দর্য, আবার অনেকে পূজারি প্রণাম জানাচ্ছে সূর্যদেবকে। ধীরে ধীরে আলো ফুটল। সেখানে বিভিন্ন নামিদামি পোর্ট্রেট, তৈলচিত্র আর সুভ্যেনিয়র পাওয়া যায়। উপহার হিসেবে এসব বেশ দারুণ। কেনাকাটা শেষে আমরা ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলাম।
সেদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী দার্জিলিংয়ের বাকি ট্যুরিস্ট স্পটগুলো দেখার পালা। গাড়ি খুঁজে রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। আমাদের ড্রাইভার সাহেব খানিক বাদে বাদে গাড়ি থামালেন ঘুম মনাস্ট্রি ও বাতাসিয়া লুপ দেখবার জন্য। কিছুক্ষণ এখানে থেকে রওনা দিলাম সেভেন পয়েন্টসের দিকে।
প্রথমেই গেলাম পদ্মজা নাইডু জুলজিক্যাল পার্কে। কিন্তু পার্কের দিকে না গিয়ে সবাই নিশপিশ করছে রোপ-ওয়েতে চড়ার জন্য। তাই পার্কের আশপাশ ঘুরে সেদিকে রওনা দিলাম। পার্ক থেকে একটু দূরেই বেশ কয়েকটা মোমোর স্টল রয়েছে। সকালের নাস্তাটা সেরে ফেললাম সেখানেই। ২০ থেকে ৩০ রুপির বিনিময়ে খেতে পারবেন দার্জিলিংয়ের অথেনটিক ভেজিটেবল কিংবা চিকেন মোমো। এখানকার দোকানিরা বেশ শিক্ষিত ও কর্মঠ। গ্র্যাজুয়েশন শেষে এরা দোকানের হাল ধরতে দ্বিধাবোধ করেন না। বরং, মা-মেয়ে মিলে বেশ সুন্দরভাবে দোকান চালিয়ে যায়, যে মনোভাবটা আমাদের মাঝে একেবারেই নেই!
যা-ই হোক, চা-নাস্তা শেষে রওনা দিলাম রোপওয়ের দিকে। সেখানে উঠতে পর্যটকদের লাইন। ২০০ রুপি দিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ঘণ্টার জন্য শূন্যে ভাসতে পারবেন আপনি। আর পাখির চোখে দেখতে পারবেন পুরো দার্জিলিংকে।
যাদের উচ্চতাভীতি আছে, তাদের কাছে ব্যাপারটি সুবিধার নয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই চলে গেল রোপওয়েতে চড়তে। আমরা কয়েকজন গাড়ির আশেপাশে ঘুরছি। আশেপাশেই কয়েকটি স্কুল রয়েছে। সাদা জামা আর লাল-হলুদ-সবুজ কানটুপিতে ঢাকা বাচ্চাগুলোর ছুটোছুটি দেখছি। এর মাঝে আবার কেউ গাড়িতে ঘুমাচ্ছে, তো কেউ ড্রাইভারের কাছ থেকে তার ড্রাইভিংয়ের প্রশংসা শুনছে! ঘণ্টা দুয়েক পর সবাই রোপওয়ে থেকে ফিরে এল।
গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম আবার। ড্রাইভার গাড়ি থামালেন তেনজিং রকের সামনে। এখান থেকেই তেনজিং তার হিমালয় যাত্রা শুরু করেছিলেন। যাদের পাহাড় চড়ার শখ আছে, তারা ৫০ রুপি খরচ করে চড়তে পারবেন বিখ্যাত এই পাহাড়ে। এর পাশেই গড়ে উঠছে দোকান। আমরা গেলাম সেদিকটায়, অনেকে তখন পাহাড় চড়ায় ব্যস্ত। দার্জিলিংয়ের সুভ্যেনিয়র, শাল, চা পাতা সহ আরও বিভিন্ন জিনিসের পসরা। সেখানে খেলাম আমার জীবনের সেরা পাপড়ি চাট। ভারতের বেশ কয়েক জায়গায় খাওয়া হলেও এটাই ছিল সবচেয়ে মজার। ২০ রুপিতে পেয়ে যাবেন সুস্বাদু এই জিনিস। সেখান থেকে চা পাতা কিনলাম ৫০ রুপি করে। পর্বতারোহীদের পাহাড় বিজয় শেষে আবার বসলাম গাড়িতে।
এবার এলাম ‘হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট’-এ। আগেই বলেছিলাম পর্যটন এলাকার বিজনেস পলিসির কথা। সে অনুযায়ী অনেক দোকান রেখে আমাদের গাড়ি থামল নির্দিষ্ট দোকানটির সামনে। দোকানে ঢুকলাম। তাদের তালিকায় আছে বিভিন্ন স্বাদের চা এবং চা-পাতা দুটোই। সেখানে চা পাতার নাকি কয়েক রকমের গ্রেড আছে। বাসার জন্য আর উপহারের জন্য সবাই ব্যাগ বোঝাই করল চা-পাতা কিনে। কেনা শেষে গেলাম চা-বাগানের ভেতর। যত দূর চোখ যায়, শুধুই চা-বাগান। দেশপ্রেম না আবহাওয়ার প্রভাব তা জানি না, কিন্তু হ্যাপি টি ভ্যালি চা বাগানের চেয়ে আমাদের সিলেটের চা-বাগানই আমার কাছে ঢের সুন্দর ও সতেজ মনে হয়েছে। বাগান ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম বাগানের আশেপাশে স্থানীয়দের বাসা। বাসাগুলো খুব রঙিন। বারান্দায় বাহারি রঙের টব আর সেখানে রঙিন সব ফুল। দুপুরের মধ্যেই আমাদের স্পটগুলো ঘোরাঘুরি শেষ।
সেখান থেকে গেলাম সোজা রেস্তোরাঁতে। খাবার আসতে আসতে প্ল্যান হয়ে গেল মুভি দেখবার! দার্জিলিংয়ে এসে আইনক্সে মুভি না দেখলেই নয়। তখন হলে চলছিল ‘প্যাডম্যান’ আর ‘পদ্মাবতী’। খাবার খেয়েই কয়েকজন চলে গেল টিকেট কিনতে। আর বাকিরা ফিরলাম হোটেলে। হোটেলে ফিরে কেউ বাসায় ফোন দিয়ে দার্জিলিং দেখাচ্ছি, কেউ ফেইসবুকে ছবি আপলোড করছে। আবার কেউ গিজার নিয়ে সন্দিহান হয়ে বরফঠাণ্ডা পানি দিয়েই ফ্রেশ হচ্ছে। ফ্রেশ হতে হতে টিকেট চলে এল। আমাদের শো বিকেল ৪টায়।
এরপর বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে সোজা রিংক মলের আইনক্স থিয়েটারে গেলাম। মুভি শুরু হলো। দেখতে দেখতে প্রায় ৩ ঘণ্টার মুভি শেষে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে। এবার আমাদের ‘ফ্রি টাইম’। বাঁধাধরার বাইরে গিয়ে কেনাকাটা কিংবা নিজের মতো ঘুরাঘুরি। তাই সবাই চলে গেল নিজ নিজ কেনাকাটায়। এটাই ছিল দার্জিলিংয়ে আমাদের শেষ রাত। তাই নিজের মতো খাওয়াদাওয়া ও কেনাকাটায় ব্যস্ত সবাই। বিগবাজারের ঢুঁ মারার পর গেলাম মল রোডে। সেখান বাসার সবার জন্য শাল কিনলাম।
কিছুদূর যেতেই দেখলাম দোতলা এক রেস্তোরাঁ। কাঠের সিঁড়ি আর ছিমছাম আসবাবে সাহেবিয়ানার ছাপ। রেস্তোরাঁর নাম ‘দিদির মোমো’। রাতের খাবার মোমো দিয়েই শেষ করলাম। খাওয়া শেষে চললাম হোটেলের দিকে। পাহাড়ি রাস্তায় শীতের রাতে শহর ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা ভোলার মতো নয়। হেলতে দুলতে পোঁছালাম হোটেলে। রাত ৯টা পার না হলেও ততক্ষণে চারদিকে সব বন্ধ। এমনকি আমাদের হোটেলও।
শেষমেশ হোটেলে ঢুকলাম। সারাদিন শেষে এখন যে যার মতো ব্যস্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম করিডোরের বারান্দাটায়। কিছু দূরেই ক্লক টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছে, আর দেখতে পাচ্ছি জলাপাহাড়ের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা। উত্তুরে ঠাণ্ডা বাতাস আর রাতের দার্জিলিংয়ের প্যানোরামা সবটাই সুন্দর এক স্মৃতি।
আমার দার্জিলিং ভ্রমণ এখানেই শেষ। পরবর্তী গন্তব্য মিরিক।