দার্জিলিং জমজমাট

শিলিগুড়ির পথ ধরে যাচ্ছি। দু’পাশে চা বাগান, মাঝ দিয়ে পাকা রাস্তা। চা শ্রমিকদের ব্যস্ততা চোখে পড়ছে, কেউ কেউ আপনমনে চা পাতা তুলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ তোলা চা পাতা নিয়ে কারখানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশই পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, কয়েকজন আবার সাইকেলে চেপে যাচ্ছে। সমরেশ মজুমদার ‘সাতকাহন’ এ এমনই এক চা বাগানের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন। চা শ্রমিকদের ভাগ্য খুব একটা ফেরেনি। সেই তখনও যেমন তারা বঞ্চিত ছিলো, আজও তেমনই বঞ্চিত

চা পাতা তোলায় ব্যস্ত চা শ্রমিকেরা; Image source: indiantouristplace.net

আঁকাবাঁকা রাস্তা, এর যেন কোনো শেষ নেই। মনে হলো একবার নেমে চা বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াই। কিন্তু গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড গরমে তা আর সম্ভব হলো না। সেইসাথে চারদিকে শুধু ধুলো উড়ছে। ধুলোমাখা দমকা হাওয়া এসে চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। চোখে রোদচশমা লাগিয়ে নিলাম। চারপাশ প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছি।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় যেতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা লেগে যাবে। আরো বেশি সময় লাগলেও খারাপ হতো না, বরং চারপাশ আরো ভালো করে উপভোগ করা যেত। এমন কোনো পথে ভ্রমণ করবার সময়ই হয়তো জন ডেনভার তার বিখ্যাত সেই Country road গানটি গেয়েছিলেন।

Country roads, take me home
To the place I belong,
West Virginia,
Mountain mamma,take me home
Country roads.”
– John Denver.

চা বাগান পেরিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড়ের দিকে এগোতে লাগলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, মাঝে মাঝে জিপ উপরে উঠছে তো উঠছেই, আবার হঠাৎ বাঁক নিচ্ছে। জিপের সামনে বসেছেন নব দম্পতি। হয়ত হানিমুনে এসেছেন এই গ্রীষ্মের ছুটিতে। জিপের সামনে বসায় খুব ভয় পাচ্ছিলেন দুজনই। আমরা ক্রমাগত উপরে উঠছিলাম। পথের একপাশে খাদ, অন্য পাশে সুবিশাল পাহাড়।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা; Image source: pinterest

দার্জিলিংয়ের পথে পাহাড়ে বেয়ে ভয়ংকর রাস্তা, একপাশে পাহাড় ও অন্যপাশে খাদ; Image source: Somjit Bhattachariyya

যতই দার্জিলিঙের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই এক অন্যরকম রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম সত্যজিত রায়ের দার্জিলিং জমজমাট। সেবার ফেলুদা দার্জিলিং রহস্য সমাধান করেছিলেন। ফেলুদাকে আমরা রূপালী পর্দার জগতে প্রথম দেখি বোম্বাইয়ের বম্বেটেতে, যখন বলিউডের চিত্রনির্দেশক পুলক ঘোষাল লালমোহন বাবুর গল্প থেকে একটি চলচ্চিত্র বানানোয় হাত দেন। সেই গল্পের উপর নির্ভর করে ফিল্মও বানানো হয়। আর ফেলুদাও তারই মাঝে বোম্বাইয়ের এক বড় চোরাচালানকারীকে জব্দ করেন।

যা-ই হোক, তার বছরখানেক পরে পুলকবাবু আবারও লালমোহনবাবুর আরেকটি গল্প থেকে নতুন একটি সিনেমা বানানো শুরু করেন। আর দৃশ্যধারণের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় দার্জিলিং শহরটিকে। ফেলুদা ও তোপসের ইচ্ছে ছিল শুটিং দেখার সাথে সাথে তাদের প্রথম গোয়েন্দাগিরির জায়গাটিতে আরেকবার ঘুরে আসার। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে তাদের আরেকবার তদন্তে নামতে হবে, তা কে জানতো?

সত্যজিত রায়ের ‘দার্জিলিং জমজমাট’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image source: Ananda Publishers

দার্জিলিংয়ের পরতে পরতে নানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার একটি প্রত্যন্ত থানা ছিল নকশালবাড়ি। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিকে সেই নামটি ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতে, সারা দক্ষিণ এশিয়ায়। শুধু তা-ই নয়, সারা দুনিয়ায়। এই নকশালবাড়ি আন্দোলনই একসময় নকশাল আন্দোলনে রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। দত্ত ভার্সেস দত্ত মুভিতে অঞ্জন দত্ত কলকাতায় নকশাল আন্দোলনের কিছু দৃশ্যপট তুলে এনেছিলেন।

পৃথিবীর নানা দেশের অনেকেই নাকি বিভিন্ন কারণে এই দার্জিলিং শহরের প্রেমে পড়েছেন। দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক আবার দার্জিলিংয়ের পাশাপাশি প্রেমে পড়েছেন দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনের। দার্জিলিংয়ের প্রেমে পড়া মানুষদের মধ্যে অঞ্জন দত্ত একজন। অঞ্জন দত্তের ছেলেবেলা কেটেছে দার্জিলিংয়ে। তখন থেকেই প্রেমে পড়ে গেছেন শহরটির, যা তার অনেক গানে এবং তার পরিচালিত সিনেমায় পরিলক্ষিত হয়। উডি অ্যালেন যেমন নিউ ইয়র্ক ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না, সুইজারল্যান্ড যেমন যশ চোপড়ার হৃদস্পন্দন, ঠিক তেমনই অঞ্জনের কাছে এই দার্জিলিং শহরটি। তিনি না বললেও ধরে নেওয়া যায়, এই পাহাড়ি শহরের অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনি। এ বয়সে এসেও অঞ্জন দত্ত তার দার্জিলিংয়ের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন নানা সময়। দার্জিলিংকে নিয়ে তাই গান লিখেছেন,

“খাদের ধারের রেলিংটা
সেই দুষ্টু দো দস্যি রিংটা
আমার শৈশবের দার্জিলিংটা
জানলার কাছে টপকে পেয়ে
ছবি এঁকেছি নিঃশ্বাসে 
পাহাড় আঁকা কত সোজা
হারিয়ে গেছে সেই ড্রয়িং খাতা…

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও অনেক পছন্দের জায়গা ছিলো এই দার্জিলিং। অনেকবার এসেছেন এই দার্জিলিংয়ে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং কাদম্বরীর দার্জিলিং সফরের সঙ্গী হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই তাঁর প্রথম দার্জিলিং যাত্রা। তাঁরা এসে উঠেছিলেন রোজ ভিলাতে। দার্জিলিং পাহাড়ে এসে কবি লিখেছিলেন ‘প্রতিধ্বনি’। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বইয়ে বিভিন্নজনকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক চিঠিতে কবির দার্জিলিং বন্দনা দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সাথেও জড়িয়ে রয়েছে দার্জিলিং। শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কবিগুরু তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পংয়ে। সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন বলেছিলেন, তখনই অপারেশন না করলে কবিকে বাঁচানো যাবে না। সেই অসুস্থতায়ই পরের বছর কবিকে হারায় তার অসংখ্য অনুরাগী।

দার্জিলিং এর বিখ্যাত টয় ট্রেন; image source: tempotravellerhire.in

পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে আমরা উপরের দিকে উঠে চলেছি। গাড়ি যতই উপরে উঠছে, ততই ঠাণ্ডা অনুভব করছি। গায়ে চাদর জড়িয়ে নিলাম। জিপের মৃদু দুলুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, মনে নেই। কার্শিয়াং পেরিয়ে এসে জিপ থামলো দশ মিনিটের জন্য। কার্শিয়াং দার্জিলিং জেলার একটা শহর। কার্শিয়াং শহরে নামিদামি কিছু বোর্ডিং স্কুল ও মিশনারি স্কুল রয়েছে। এখান কার বোর্ডিং স্কুলগুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও আছে। বাংলাদেশি যেসব শিক্ষার্থী এখানে পড়ে তাদের অনেককেই পারিবারিক সমস্যার কারণে এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এরা সবাই উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনেকের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে, সন্তানকে বাবা বা মা কেউই নিজের কাছে রাখতে চায় না তাই পাঠিয়ে দিয়েছে। মাসে মাসে শুধু খরচ পাঠায়। আবার অনেকের বাবা বা মা বিচ্ছেদের পর তাদের সন্তানকে ইচ্ছে করেই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, যাতে তাদের সন্তান অন্তত অল্প বয়সে পারিবারিক এই সমস্যার সম্মুখীন না হয়।

কুড়ি মিনিটের যাত্রা বিরতি। শীত করছিলো খুব, তাই জিপ থেকে নেমে পাশের দোকানে চা খেলাম। দার্জিলিং চা। চা-শিল্প বিকাশের শুরু হতে আজ পর্যন্ত অনেক গবেষণা, অনেক প্রতিযোগিতা হয়েছে, কিন্তু দার্জিলিং চায়ের মতো চা তৈরি করা দূরে থাক, সৌরভে গুণগত উৎকর্ষতায় এর ধারে কাছেও আসতে পারেনি কোনো চা-উৎপাদনকারী। দার্জিলিঙে বছরে চারবার চা ওঠে। এগুলো হলো ফার্স্ট ফ্ল্যাস, সেকেন্ড ফ্ল্যাস, অটম ও রেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেকেন্ড ফ্ল্যাসের চা। যার কেজিপ্রতি বাজার মূল্য প্রায় হাজার টাকার কাছাকাছি। অবশ্য অভিজ্ঞ কেউ ছাড়া অরিজিনাল দার্জিলিং চা কেনা মুশকিল। কারণ সারা বিশ্বব্যপী দার্জিলিং চা এর এতই চাহিদা যে নেপালি বা আসাম চাকেও অনেকে দার্জিলিং চা বলে বিক্রি করে। আমি চা খাচ্ছিলাম আর ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে দোকানির সাথে কথা বলছিলাম। এখানকার মানুষদের মাতৃভাষা নেপালি। যদিও অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলা ও ইংরেজিও আছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাদের উপর জোর করে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বলে তাদের দাবি। এখানকার  নেপালি ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী অনেক দিন থেকেই স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড এর দাবি করে আসছে। ভাঙা ভাঙা হিন্দী আর বাংলা মিশিয়েই এখানকার আবহাওয়া ও মানুষেদের জীবনযাপন নিয়ে কথা হচ্ছিলো দোকানির সাথে।

কখন যে কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেছে, খেয়ালই করিনি। সবাই গাড়িতে চড়ে বসেছে। ড্রাইভার ডাকতে এলো। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম জিপে। জিপ আবার ছুটতে শুরু করল মেঘ পাহাড় আর সবুজের দেশ দার্জিলিঙের পথে।

ফিচার ইমেজ: মান্ডালা পিকচার্স

Related Articles

Exit mobile version