প্রবাস জীবনে এসে শুরুতেই একটা কোম্পানিতে ঝাড়ুদারের কাজ পেয়ে গেলাম। সুপারভাইজার হলেন একজন আর্জেন্টাইন। আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলেই বলতেন, “আস্তা লা ভিস্তা আমিগোস।” তার কাছ থেকে এমন অনেক স্প্যানিশ শব্দ শেখা হয়েছিল।
তার আগে বুয়েটে থাকতে রপ্ত করেছিলাম কিছু জার্মান শব্দ। পাশের রুমের সুমিত পাল শেখা শুরু করেছিল। পড়াশোনা শেষে ওর জার্মানিতে যাওয়ার ইচ্ছে। কলাবাগানের গ্যেটে ইনস্টিটিউটে গিয়ে ও জার্মান ক্লাস করে আসত। ওর থেকে টুকটাক শিখেই শুভ সকাল, শুভ সন্ধ্যা, ধন্যবাদ- এই শব্দগুলো জার্মানে বলা শুরু করলাম একে অপরের সাথে।
জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে গিয়ে একসময় ভাবতাম, অন্তত গোটা পঞ্চাশেক দেশ না দেখে মরতে চাই না। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেই ইচ্ছেটা কোনোভাবেই পূরণ হবার নয়। অবশ্য বহুজাতি এবং সংস্কৃতির মিশ্রণের দেশ অস্ট্রেলিয়াতে আমার সেই ইচ্ছেটা কিছুটা হলে পূরণ হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছি। জানতে পারছি তাদের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে।
এভাবেই একদিন পরিচয় হয়েছিল এক ভিয়েতনামিজ ভদ্রলোকের সাথে। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম মার্কিন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা। আরও পরিচিত হয়েছি লেবানন, ইরাক, ফিজি, নেপাল, ফিলিপাইনের মানুষদের সাথে। ভারত আর পাকিস্তানের মানুষের কথা আলাদা করে বলছি না, কারণ তাদের সাথে সাক্ষাতটা অতি অহরহ। এসেছি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সংসর্গেও।
মেয়ে তাহিয়া স্কুল থেকে রাগবির প্রশিক্ষণের জন্য একটা কোর্সে ভর্তি হলো। প্রশিক্ষক লোপিনি সদাহাস্য ভদ্রলোক। তাহিয়াকে বলল, “তুমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, তোমার বাবা তোমাকে রাগবির প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে এসেছে।”
এরপর একসময় আমার সাথেও পরিচয় হলো। এখানে প্রত্যেকের সাথেই পরিচয়ের শুরুতে কে কোন দেশের, সেই প্রসঙ্গ আসে। স্বভাবতই সে-ও জিজ্ঞেস করল, আমিও বললাম। দেশের নাম শুনতেই লোপিনি বলল, “তুমিই আমার প্রথম বন্ধু যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে।”
একদিন এই লোপিনি নিজ থেকেই বলল, “আমি তোমার জন্য আমাদের দলের একটা জার্সি নিয়ে আসবো।” শুনে তো আমি খুশিতে আটখানা। পরেরদিন সত্যিই দেখি, সে একটা অফিশিয়াল জার্সি নিয়ে হাজির। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের একটা জার্সি উপহার দেওয়ার। কিন্তু পরের সপ্তাহে তাহিয়ার পা মচকে গেলে রাগবি প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিতে হয়, যে কারণে তার সাথে আর দেখা হয়নি।
সিডনির সার্কুলার কিয়ে জায়গাটা খুবই বিখ্যাত। এখানেই ট্রেন থেকে নেমে অপেরা হাউস দেখতে যেতে হয়। আবার পাশেই রয়েছে বিখ্যাত হারবার ব্রিজ। তো সার্কুলার কিয়েতে যদি যান, তবে আসলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যায়। তাই কেউ সিডনি বেড়াতে আসলে অন্ততপক্ষে একটিবারের জন্য হলেও সার্কুলার কিয়েতে ঢুঁ মারেন। পাশাপাশি এখান থেকে ফেরিতে করে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়। এই ফেরি ভ্রমণটাও অনেক উপভোগ্য। সাগরের বড় বড় ঢেউ ভেঙে ফেরিগুলো হেলেদুলে এগিয়ে যায়।
সার্কুলার কিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে ভ্রমণকারীদের পদচারণায়। তাই জীবিকার তাগিদে ভাসমান পেশাজীবীদের আনাগোনাও সেখানে চোখে পড়ার মতো। আদিবাসীদের কথাই ধরা যাক। কয়েকজন মিলে জড়ো হয়ে সেখানে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী নাচ-গান পরিবেশন করে থাকে। সেসব শুনে বা দেখে শুনে আপনি তাদেরকে কিছু সেন্ট দিতেই পারেন।
আদিবাসীরা তাদের মিউজিক কম্পোজিশনের সিডিও বিক্রি করে থাকে। আমি তাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বললাম, আমি তোমাদেরকে শুধু শুধু টাকা দিয়ে অসম্মানিত করতে চাই না, এর চেয়ে বরং তোমাদের সিডি কিনি। আমার কথা শুনে তারা একেবারে ছেলেমানুষি খুশির শব্দ করল। আমি তাদের দুটো গানের সিডি কিনলাম। পরিচিত হলাম।
তাদের দলনেতার নাম ওমানজো। আমার শুধু এই নামটাই মনে আছে, কারণ বাকিদের নাম আরও বেশি খটমটে। এরপর আমি যতবারই সার্কুলার কিয়েতে গিয়ে তাদের পরিবেশনা দেখি, ততবারই তাদের কাছ থেকে আলাদা খাতির পাই। কারণ আমি ওমানজোর বন্ধু!
তবে অতি সম্প্রতি একজন নতুন বন্ধু হয়েছে। যার কথা বলতেই আসলে এই লেখার অবতারণা। বান্ধবী টুশি বুয়েটে আমাদের সাথে একই সেশনে পড়াশোনা করলেও পরিচয় ছিল না। পরবর্তীতে ফেসবুকের কল্যাণে তার সাথে পরিচয় হলো। ও বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ত।
টুশি এর আগেও অস্ট্রেলিয়া এসে ঘুরে গেছে। এবার এসেছে মোটামুটি পাকাপোক্তভাবে। তাই ওকে একটা অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আমি আর বন্ধু ননী পরিকল্পনা করলাম সবাই মিলে একদিন সার্কুলার কিয়েতে দেখা করব।
আমি সবার আগেই ওখানে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করতেই দেখি এক ভদ্রলোক পিয়ানো সামনে রেখে আরেকজনের সাথে গল্প করছেন, যিনি আবার গিটার বাজান। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাই গিটার বাজানো শেষ করে তিনি ফিরে যাচ্ছেন। আমি তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে কফি অফার করলাম। পিয়ানো বাদক হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন, কিন্তু গিটার বাদক বললেন, তিনি এখন চলে যাবেন।
আমি সাবওয়ে থেকে কফি এনে দেখি গিটার বাদক চলে গেছেন। আমি কফিটা পিয়ানো বাদকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গল্প শুরু করলাম। পিয়ানো বাদকের নাম গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেজ। অস্ট্রেলিয়াতে এসেছেন বেশ ক’বছর হলো। এর আগে তিনি আর্জেন্টিনাতে একটা স্কুলে পিয়ানো শেখাতেন। তার পিয়ানো বাজানোর উপরে উচ্চতর ডিগ্রিও আছে। শুনে আমি খুবই অবাক হলাম।
আমি বললাম, এত কিছু থাকতে তাহলে আপনি কেন রাস্তায় রাস্তায় পিয়ানো বাজিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুনে গ্যাব্রিয়েল বললেন, গৎবাঁধা জীবন আমার মোটেও ভালো লাগে না, তাই এই স্বাধীন জীবিকা বেছে নিয়েছি। আমিও বললাম, “খুব ঈর্ষা হচ্ছে আপনাকে দেখে!” আমার কথা শুনে তার হাসি আর থামতেই চায় না।
এরপর তার সংসারের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, বছর চারেক হলো বিয়ে করেছেন। কোন সন্তানাদি নেই। স্ত্রীর নাম গ্লোরিয়া, একটা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এভাবেই দুজন মিলে সংসারটা চলে যায়।
আমার মোবাইলে পারামাটা থেকে ধারণ করা এক গিটারবাদকের ভিডিও তাকে দেখাতেই গিটারবাদককে চিনে ফেললেন তিনি। ভিডিওর ব্যক্তিটির নাম জর্জ, থাকেন তার পাশের সাব আর্বেই গ্রামে। গল্প এগিয়ে চললো এভাবেই।
একসময় গ্যাব্রিয়েল বললেন, “তুমি আমাকে কিছু বাংলা গান দিতে পারো, যাতে আমি পরবর্তীতে সেটা বাজাতে পারি?” সাথে সাথে আমি ইউটিউব খুঁজে তাকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি শুনিয়ে দিলাম। খুব পছন্দ করলেন তিনি, লিংকটিও চাইলেন। আমি তার মোবাইল নম্বর নিয়ে তাকে লিংকটি পাঠিয়ে দিলাম।
এরপর হঠাৎ মাথায় চলে আসলো একটা গানের কথা। আমি সেটা গ্যাব্রিয়েলকে শোনাতেই তিনি বললেন, “এই গানটাই পিয়ানোর সাথে বেশি ভালো যায়। তুমি আমাকে এটাও পাঠিয়ে দাও।”
এরপর আবার একদিন পারামাটা সাইট পরিদর্শনে গিয়ে পরিচয় হলো থমাসের সাথে। কথায় কথায় আমার বন্ধু গ্যাব্রিয়েলের কথা বলতেই থমাস চিনে ফেললেন, কারণ থমাসও আর্জেন্টিনার মানুষ। অস্ট্রেলিয়া আসার পরের কঠিন সময়গুলোতে নাকি গ্যাব্রিয়েল তাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন।
আমি গ্যাব্রিয়েলের বন্ধু জেনে আমাকে খুবই খাতির করল। আমি সেই একই কথা থমাসকেও বললাম, আমি আপনাদের এই জীবন দেখে ঈর্ষান্বিত! আমার কথা শুনে থমাসও সেই হাসি দিলেন, যেটি আমরা সাধারণত ছেলেমানুষি কথা শুনলে দিয়ে থাকি।
আমি থমাসের বসার আসনে বসে পিয়ানো বাজানোর পোজ দিলাম। আর থমাস আমার সেই ছবি তুলে দিলেন। এরপর আমি থমাসকে বললাম তুমিও কিছু বাংলা গানের সুর বাজিয়ে দেখতে পারো। বলেই আমি আবারও সেই গানটা শুনিয়ে দিলাম থমাসকেও।
এতক্ষণ গানের নামটি বলিনি। এবার সেটিই বলি। আমি গ্যাব্রিয়েল এবং থমাসকে আসলে পাঠিয়েছিলাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত বাংলা গানটি- আমি বাংলায় গান গাই। এরপর আপনি যদি সার্কুলার কিয়ে বা পারামাটার ব্যস্ত জায়গাতে যদি এই গানের সুরের সাথে পিয়ানো বাজাতে শোনেন, তাহলে অবাক হবেন না যেন।
বিশ্বব্যাপী আমরা বাংলাদেশিরা নিজ নিজ যোগ্যতায় ছড়িয়ে পড়ছি- কখনো জীবিকার তাগিদে, আবার কখনো উচ্চাভিলাষের প্রয়োজনে। আর এভাবেই আমাদের হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতি। আমি গ্যাব্রিয়েলকে যখন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত পাঠিয়েছিলাম, তখন তিনি গানের কথাগুলো আমায় অনুবাদ করে দিতে বলেছিলেন। তাকে বলেছিলাম, এখানে বাংলাদেশের প্রকৃতিকে মায়ের মুখায়ববের সাথে তুলনা করে তার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা উৎসারিত হয়েছে।
এটুকু শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন, আবার পরক্ষণেই মন খারাপ করে বললেন, “আমাদের আর্জেন্টিনার জাতীয় সঙ্গীত একটু বিদ্রোহমূলক, আসলে আমাদেরকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বাধীনতা পেতে হয়েছে তাই জাতীয় সংগীতের মধ্যে তারই প্রতিফলন রয়ে গেছে।”
আমি শুনে বললাম, “আমরাও তেমনভাবেই স্বাধীনতা পেয়েছি, তবুও আমরা বিশ্বব্যাপী ভালোবাসার কথাই প্রচার করতে চাই। আর এই গানটা লিখেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” নামটা শুনে তিনি সাথে সাথেই চিনে ফেললেন।
আসলেই এখন দেশ আর কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমি আপনি যেখানে যাব, আমাদের কর্মকাণ্ডই আমাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তাই আপনি যদি নিজ দেশের সংস্কৃতির কথা বলেন, তাহলে একদিকে আপনি নিজে সম্মানিত হবেন, আর যিনি শুনবেন তিনিও নতুন কিছু জানার মাধ্যমে চমৎকৃত হবেন।
আর আপনি যদি অন্য দেশের ভাষা আয়ত্ত্ব করতে পারেন, তাহলে তো আপনি সেই দেশের মানুষের একান্ত আপনজন হয়ে যাবেন মুহূর্তেই। এভাবেই আপনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরবেন আর মনে মনে গেয়ে উঠবেন,
“আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন-এই বাংলায় খুঁজে পাই”