হিমালয় পর্বতশ্রেণীর বুক ঘেঁষে চলাচলকারী ধীরগতির ট্রেন ‘দার্জিলিং হিমালয়ান এক্সপ্রেস’। ধীর গতি আর রঙিন সব বগির জন্য সারা ভারতজুড়ে এর খ্যাতি আছে ‘খেলনা ট্রেন’ হিসেবে। হিমালয়ের পাদদেশে ৬,৭০০ ফুট উচ্চতার সুন্দর ছিমছাম দার্জিলিং শহরে বেড়াতে আসা বিদেশী পর্যটকদের একটা বড় অংশের লক্ষ্য থাকে ধীর গতির এই ‘Toy Train’-এ চেপে দার্জিলিং থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়া। বোনাস হিসেবে উপভোগ করা যায় পাহাড়ি রাস্তার দু’পাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। পথেই দেখা মিলবে মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের, ভারতের সর্বোচ্চ স্টেশন ‘ঘুম’ সহ অনেক আর্কষণীয় স্থানের।
পশ্চিম বাংলার এই দার্জিলিং শহর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চায়ের জন্য বিখ্যাত। আর তাই এই শহরে এসে পর্যটকরা উষ্ণ চায়ের কাপ হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় রোদের প্রতিফলন দেখার পাশাপাশি দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে চড়তেও ভুল করেন না। কারণ একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে পৃথিবীর আর কোথায় খুঁজে পাবেন পাহাড়ের অলিগলিতে এঁকেবেঁকে চলা স্টীম ইঞ্জিনের ট্রেন? তাই ভারতের ‘নীলগিরি মাউন্টেন রেলওয়ে’ আর ‘কালকা শিমলা রেলওয়ে’ এর পাশাপাশি হিমালয় চিরে বয়ে চলা এই অনিন্দ্য সুন্দর রেলওয়ে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ভারতবর্ষের উচ্চতম রেলওয়ে। এর রেল ট্র্যাকগুলো ন্যারো গেজ নামে পরিচিত। অবিশ্বাস্য শোনালেও এই রেলওয়ের ট্র্যাকগুলোর প্রস্থ মাত্র ২ ফুট বা ৬১০ মিলিমিটার। ১৮৮১ সালে নির্মিত এই “Toy Train” পাহাড়ের মধ্যে নির্মিত রেলওয়ের দিক থেকে শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বেই প্রথম।
দার্জিলিংয়ে রেলওয়ে কেন দরকার ছিলো ?
মূলত ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ায় বিলেতী শাসকদের বেশ কষ্টই হচ্ছিলো। তাই গ্রীষ্মকালের তীব্র গরমের সময়টা দার্জিলিংয়ে কাটাতে যাবার ব্যবস্থা বের করতেই এই রেলওয়ের নির্মাণ শুরু করা হয়। তবে তখনো পুরোদমে এই রেলওয়ের কাজ শুরু হয় নি। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এই ব্যয়বহুল রেললাইন নির্মাণের কাজ নিয়ে তখনও দ্বিধাবিভক্ত ছিলো ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৮৮০’র সেই সময়ে কলকাতা থেকে দার্জিলিং যেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হত। তাই প্রথম ধাপে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন নির্মাণ শেষ করে। তখনকার সময়ে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চালু ছিলো “টাঙ্গা” নামের ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ি চড়েই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরেই যেতে হতো দার্জিলিং। গ্রীষ্মকালের ভারতবর্ষের তীব্র গরম থেকে রেহাই পেতে দার্জিলি্ংয়ে আসা ব্রিটিশদের হাত ধরেই এই এলাকায় শুরু হয় চায়ের চাষ।
চা চাষের অনুকূল আবহাওয়া আর সুলভ শ্রমিকের যোগান ক্রমান্বয়ে দার্জিলিং এবং এর আশেপাশের এলাকাকে পরিণত করে ভারতবর্ষের চা ব্যবসার মূল কেন্দ্রে। ভারতের নদীবিধৌত অঞ্চলগুলোতে যখন নীল চাষের প্রসার হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে দার্জিলিংয়ে গড়ে উঠছিলো চা শিল্প। দলে দলে ব্রিটিশ বণিকেরা আসা শুরু করে এবং এই চা শিল্পের দ্রুত বিকাশ হয় এই অঞ্চলে। তাই ভারতীয় ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ আর চা জাতীয় পণ্য পরিবহণের জন্যে পাহাড়ি এই পথে ধীরগতির টাঙ্গা ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভবনা দেখা দেয় ব্রিটিশ বণিকদের। তাই তারা জোর দাবি তুলে শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের।
রেলওয়ের দাবি ও সম্ভাবনা যাচাই
ব্রিটিশ বণিকদের জোরালো দাবি গিয়ে পৌঁছায় তৎকালীন বাংলায় নিযুক্ত গভর্নর স্যার এশলে এডেনের কাছে। তিনি এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় আদৌ রেলওয়ে লাইন স্থাপন করা যাবে কিনা এ নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিলেন। কারণ সারা ভারত জুড়ে যেমন একদিকে রেললাইন প্রসারের কাজ চলছে, তেমনি অন্যদিকে এই রেলওয়ে লাইন ঘিরেই চলছে নাশকতা। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রেলওয়ে লাইনের ইস্পাতের পাত পর্যন্ত উধাও হয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি এই রেলওয়ে লাইন স্থাপন করার যৌক্তিকতা এবং সম্ভাব্যতা বিবেচনা করার জন্যে একটি কমিটি গঠন করেন। ১৮৭৯ সালে এই কমিটির পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পাবার পরেই এই রেললাইনের কাজ শুরু করার জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ‘ইস্ট বেংগল রেলওয়ে’ এবং ‘নর্থ বেংগল রেলওয়ে’ এই দুই কোম্পানিকেই প্রস্তাব দেয়। কিন্তু পাহাড়ের এই খাড়া ঢালে রেলওয়ে নির্মাণ একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে রক্ষণাবেক্ষণ অনেক কঠিন বলে এই দুই কোম্পানির কেউই কাজটি নিতে রাজি হয়নি।
রেলওয়ে নির্মাণে চড়াই-উৎরাই
‘ইস্ট বেংগল রেলওয়ে’-এর কর্মকর্তা ফ্রাংক্লিন পেস্টাগ এই সমস্যা সমাধানে স্যার এশলে এডেনকে নতুন একটি প্রাইভেট কোম্পানি গঠন করে এই রেলওয়ের কাজ শুরু করার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবেই সর্বপ্রথম ২ ফুট প্রস্থের রেলওয়ে ট্র্যাকের উল্লেখ করা হয়, যা এখন ন্যারো গেজ নামে পরিচিত।
এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন এডেন। এর পরেই ‘Darjeeling Steam Tramway Company’ নামের প্রাইভেট কোম্পানি এই রেলের কাজ শুরু করে। কিন্তু কাজ শুরু করে এই প্রকল্পের পরিচালক হার্বার্ট রামসে বুঝতে পারেন কত কঠিন কাজ এটি। একদিন পাহাড়ের ঢালে কিভাবে ভারি এই ট্রেন উঠবে এই সমস্যার কোনো সমাধান না পেয়ে তিনি তার স্ত্রীর সাথে এই নিয়ে কথা বলছিলেন। তার স্ত্রী তাকে বললেন -“If you can’t go forward, why don’t you go back darling” তার এই কথার অর্থ ছিলো যদি এই কঠিন কাজ করতে না পারো, তবে চলো ব্রিটেনে ফিরে যাই। কিন্তু হার্বার্ট রামসে তার স্ত্রীর কথা শুনে চিন্তা করেন যখন ট্রেন আর সামনে যেতে পারছে, না তখন তাকে কয়েক গজ পিছিয়ে এসে পুনরায় যাত্রা শুরু করে উঁচুতে উঠানো যেতে পারে। এই ধারণা থেকে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে জন্ম নেয় বিখ্যাত ‘Z Reversals or Zigzags’, যে প্রযুক্তি পরে ভারত সহ সারা বিশ্বে পাহাড়ের ঢালে রেললাইন নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
অসংখ্য প্রতিকূলতা আর চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে ১৮৮১ সালের মার্চে এই লাইনের কাজ শেষ হয়। ৪ মার্চ ১৮৮১ এই রেলওয়ে লাইনের উদ্বোধন করতে ভারতবর্ষের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিটনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভাইসরয় তার স্ত্রী লেডি লিটনকে নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন ‘টয় ট্রেনে’র প্রথম যাত্রায়। তারপর আজ অবধি সেই ট্রেনের যাত্রা অব্যাহত আছে ।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে, ট্রেনের বাড়ি কই ?
মজার এই ট্রেনে চড়ে শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনের বাড়ি দার্জিলিং যেতে চোখে পড়বে ‘ঘুম’ নামের এক স্টেশন। ২,২৫৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই ‘ঘুম’ স্টেশনটিই ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন।
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক বেড়াতে আসেন ঘুমে। রেলওয়ে স্টেশন ছাড়াও এই শহরে আছে বৌদ্ধ সভ্যতার বিখ্যাত ‘ঘুম মনেস্ট্রি’। আছে টাইগার হিল, যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তায় আরও চোখে পড়বে মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। ধীরগতির এই ট্রেনে করে যাওয়ার পথে এই অভয়ারণ্যের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। এই অভয়ারণ্যে দেখা পাওয়া যায় বিরল প্রজাতির সব হর্নবিল আর ইন্ডিয়ান বাইসনের। আছে রয়েল বেংগল টাইগার সহ বেশ কয়েক প্রজাতির বেড়াল।
রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা
১৮৮১ সালে ট্রেনটি চালু হওয়ার পর কেটে গেছে অনেক বেলা। ভারত স্বাধীন হবার পরে ভারত সরকার এই রেলওয়ে লাইনের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
চলতে থাকে আগের মতোই। বহুবার পাহাড়ি ভূমিধ্বসের কারণে বন্ধ ছিলো এই রেলওয়ে। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ংকরী ভুমিকম্প এবং ১৮৯৯ সালে সাইক্লোনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই রেলওয়ে। ১৯৯৮-৯৯ সালে দার্জিলিং এবং এর আশপাশের এলাকায় গোর্খাল্যান্ড মুভমেন্টের সময় ১৮ মাস বন্ধ থাকে এই রেলওয়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পরে আবারও চালু হয় এটি। ১৯৯৯ সালেই ইউনেস্কো এই “দার্জিলিং হিমালয়ান এক্সপ্রেস”-কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা দেয়। ২০১০ পাহাড়ি ভূমিধ্বসের কারণে আবারও চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এই রেলওয়ের। ক্রমাগত আর্থিক ক্ষতির মুখে থাকা এই রেলওয়ে বন্ধ করে দেবার গুঞ্জন শুরু হয়। কিন্তু তা ২০১৩ সালে রেললাইন এবং বগিগুলোতে সংস্কার করার পরে চালু করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এই লাইনে দ্রুত চলাচলের জন্য ডিজেল চালিত ইঞ্জিন চালু থাকলেও এর পাশাপাশি সেই ধীরগতির ঐতিহ্যবাহী বাষ্পচালিত ইঞ্জিনও চালু আছে ।
এমনই করে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে তার ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য ধরে রেখে চলবে এমনটাই প্রত্যাশা দার্জিলিংয়ের অধিবাসী এবং বেড়াতে আসা পর্যটকদের।