থিয়েরি টেসিয়ার ২০০২ সালে তার অসাধারণ সৌন্দর্যে ঘেরা ‘দার আহলাম’ হোটেল প্রতিষ্ঠিত করে মূলত খ্যাতি অর্জন করেন। এই হোটেল আসলে সাহারা এবং আটলাস পর্বতের মাঝে অবস্থিত পৌরাণিক কাসবাহের রূপান্তরিত স্থান। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তিনি আরেকটি নতুন হোটেল চালু করেছেন। আর এর অবস্থান হলো দক্ষিণ ইতালির সেলেনটো পেনিনসুলায়। এর যাত্রা এই মাস থেকেই আরম্ভ হয়ে গেছে। ইতালির পাহাড়ের উপর জলপাইয়ের বাগানের কাছে অবস্থিত ১৯ শতকের প্যালেসের সাজসজ্জার কিছু পরিবর্তন করে এটি তৈরি করা হয়েছে। ইতালির নিজস্ব এই রাজপ্রাসাদকে সাজানো হয়েছে বিশ্বের নানা দেশের নানা শিল্পকর্ম দিয়ে। জাদুঘরের মতো হোটেলের দেয়ালগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চিত্রকর্ম লাগানোর কাজটাও করা হয়েছে। এছাড়া একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুগন্ধদ্রব্য ব্যবসায়ী হোটেলের প্রত্যেকটি রুমে সুগন্ধ বজায় রাখার জন্য নানান অত্যাধুনিক সুগন্ধি তৈরিরও কাজ করছে। এজন্য তারা ব্যবহার করেন সাদা সিডার, অ্যাঞ্জেলিকা, অরেঞ্জ ব্লুসম এবং ক্যামোমিলের। এসব কিছু মিলে যে এক অনন্য সৌন্দর্যের দেখা মেলে তা হয়তো আর আলাদা করে বলতে হবে না।
আরেকটা বিষয় যা অনেকেই জানে না তা হলো, এই হোটেল থিয়েরির এক বিশেষ প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত। প্রজেক্টটির নামকরণ করা হয়েছে ৭০০,০০০ ঘণ্টা। আর এই সংখ্যাটি আসলে উন্নত বিশ্বে একজন মানুষের গড় আয়ু নির্দেশ করে। এই প্রকল্প অনুসারে থিয়েরি এবং তার দল কয়েক মাসের জন্য একটি বিশেষ এলাকা বা স্থানকে নিজেদের আওতায় নিয়ে সেখানে অস্থায়ী হোটেলের ব্যবস্থা করেন। আগামী প্রজেক্টগুলোতে তারা কাজ করতে যাচ্ছেন কিটোর এক মৎস্যশিকারী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি নিয়ে। পানামার স্যান ব্লাস আইল্যান্ডে পর্যটকদের রবিনসন ক্রুসের মতো অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্যও কাজ করছে তার এক দল।
এছাড়া ব্রাজিলের লেনকোয়েস মারানহেনসেস ন্যাশনাল পার্কের উপহ্রদ ও পাহাড়ি এলাকা নিয়েও তারা পরবর্তী সময়ে কাজ করতে পারে। থিয়েরি টেসিয়ার বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর কিছু পর্যটন স্থানকে কিছু সময়ের জন্য নিজেদের আওতায় নিয়ে এসে তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা এই প্রজেক্টের লক্ষ্য। বর্তমানে আসল বিলাসিতা মানেই হচ্ছে এ সকল পর্যটন স্থান ঘুরে দেখতে পারা”।
টেসিয়ারের এই সাইটগুলোতে যে কেউ থাকতে পারবে, তবে একসাথে ১২ জনের বেশি থাকা যাবে না। আর আগামী পর্যটন স্থানের জন্য বুকিং দেওয়ার অগ্রাধিকার তারাই পাবে যারা আগেও থিয়েরির কোনো অস্থায়ী হোটেলে থেকেছেন। একটা বিষয় হলো, এ সকল জায়গায় থাকতে আপনাকে অবশ্যই মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হবে। এগুলোর সাজসজ্জার তো অবশ্যই কোনো তুলনা হয় না। তবে আরেকটি যে বিষয় সকলের নিকট প্রশংসা পাওয়ার উপযুক্ত তা হলো, পৃষ্ঠপোষক এবং আঞ্চলিক লোকজনের মধ্যে একটি সুন্দর বন্ধন সৃষ্টি করা। যেমন- সেলেনটোতে মৎস্যজীবীরা অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করার জন্য সমুদ্র ভ্রমণে নিয়ে যান এবং এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অতিথিদের জন্য বিশেষ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বসন্তে কম্বোডিয়ায় হোটেলের আরেকটি সাইট স্থাপন করা হবে। সেখানে পর্যটকেরা প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরে আঞ্চলিক মানুষজনের সাথে মেলামেশা করার ও ভোজের সুযোগ পাবেন। এই এলাকায় টোনলে স্যাপ লেকের ভাসমান গ্রাম এবং বাট্টামবাঙের বিখ্যাত ফারে সার্কাসের দেখাও পাবেন ভ্রমণে যাওয়া মেহমানেরা। তবে থিয়েরির হোটেলে নতুন নতুন এসব নিদর্শনের কল্পনা একদিনের নয়।
ছোটবেলা থেকেই থিয়েরি টেসিয়ার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। আটলান্টিক মহাসাগরে নিজের প্রথম সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি অত্যন্ত অনুপ্রাণিত অনুভব করি। এটা আমার অন্যতম প্রিয় স্মৃতিগুলোর একটি। নির্জীব শীতকালের পর গ্রীষ্মকালের আগমন আনন্দের এক পরিবেশের সৃষ্টি করে।”
তার এখনও মনে আছে সকালবেলায় ছোট ছোট পাহাড়ের আশেপাশে ভোরের হালকা রোদের দৃশ্য। আর এই রোদ যে রাতের আকাশের অন্ধকার সরিয়ে নতুন দিনের আরম্ভ ঘটায় সেই কথাও।
তিনি আরও বলেন, “একদিন আমি আমার মেয়ের সাথে ভারতের এক শাড়ির দোকানে ছিলাম। সেখানে আমি কিছু মহিলাকে খালি পায়ে কাঠের পাটার উপর দাঁড়িয়ে কয়েক মিটারের রঙিন কাপড়ের গোছা খুলতে দেখি।” এই অভিজ্ঞতা থেকেই থিয়েরি মরক্কোর দার আহলামে তার বাগানে বিভিন্ন গাছের উপর রঙিন কাপড়গুলো বিছিয়ে এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছেন। এই কাপড়গুলো বাতাসে সাদাসিধেভাবে উড়লেও এর দৃশ্যটা বেশ জাঁকজমক। বিগত ২০ বছর ধরে তিনি এ সকল অভিজ্ঞতা একসাথে মনে গেঁথে রেখেছেন, যা তিনি পরবর্তীতে তার স্বপ্নের হোটেলগুলো তৈরিতে ব্যবহার করেন।
টেসিয়ার একাই বিশ্বের বিভিন্ন পরিচিত পর্যটন স্থানে এরকম ক্ষণস্থায়ী হোটেলের কাজ করছেন না। সাথে ‘হ্যাবিটাস’ এর নামও জুড়ে দেওয়া যায়। এটা আসলে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ক্লাব, যা থিয়েরি ও তার দলের মতোই কিছু কাজ করে থাকে। নামিবিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণীদের জীবন সংরক্ষণকারী এলাকা থেকে শুরু করে ভেনিসের সমুদ্র তীর পর্যন্ত এলাকায় বেশ কিছু ছোট ছোট কুঁড়েঘর তৈরি করে এই হ্যাবিটাস। এগুলোও অস্থায়ী বসবাসের জন্য। হ্যাবিটাসের এই প্রজেক্ট একটি সিরিজের মতো কাজ করেছে, যার মধ্যে নেভাদা মরুভূমি এবং ইবলিজাও ছিল। এই ক্লাবের মূল উদ্দেশ্যে ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করার একটি সুযোগ করে দেওয়া। বর্তমানে সংস্থাটি ব্রিটানির সমুদ্র তীরের এক দ্বীপে ১৮ শতকের একটি দুর্গ নিয়ে কাজ করছে।
তবে হ্যাবিটাস স্থায়ীভাবেও কিছু ছোট ক্লাব হাউজ বা বাড়ির নির্মাণ করে, যেখানে পর্যটকেরা বছরের বিভিন্ন সময়ে যেতে পারে। আর সেখানে ঘুরে বেড়ানো ও বিনোদনেরও যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। তুলুমের মেক্সিকান উপকূলে বিচ্ছিন্ন একটি জায়গায় পর্যটকদের জন্য এরকমই কিছু ব্যবস্থা করেছে হ্যাবিটাস। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর পর্যটকদের কিছু নিয়ম-কানুন পালন করে তাদের সেখানে থাকার যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। এজন্য তাদেরকে আধ্যাত্মিকভাবে সেই অঞ্চলের গাছের রেজিন গরম কয়লার পাত্রে দিতে হবে এবং নিজেদের থাকার উদ্দেশ্য বলে যাত্রা শুরু করতে পারবে। সেখানের সাজসজ্জাও বেশ পরিপাটি। এই জায়গায় ৩২টি রুম রয়েছে, যা অনেকটা তাঁবুর মতো। এর উপরে তালপাতার তৈরি ছাদ রয়েছে এবং ভেতরে আছে কাঠ নির্মিত আসবাবপত্র। স্থায়ী জিনিসের মধ্যে শুধু গ্লাস এবং লোহার তৈরি তিনতলার একটি গঠনই আছে এখানে। হ্যাবিটাসের এই সাইটে এসে একজন ব্যক্তি নরম বিছানায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঘুমাতে পারবেন, টাটকা খাবারের মজা নিতে পারবেন এবং নিজের মতো করে আরামও করতে পারবেন।
একটা বিষয় হলো, এ সকল স্থানে আপনি বিলাসবহুল কোনো কিছুর দেখা না পেলেও প্রাকৃতিক এবং ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্যের ভরপুর আনন্দ নিতে পারবেন। আর এটাই এ সকল কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যে। এছাড়া যারা আরও বেশি যাযাবর জীবনযাত্রা উপভোগ করতে চান, তারা যোগাযোগ করতে পারেন ‘নর্ন’ এর সাথে। এটিও একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লাব। এই ক্লাব বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে ছয় মাসের জন্য তাদের অস্থায়ী হোটেলের ব্যবস্থা করে থকে। সময় পেরিয়ে গেলেই তারা তাদের জায়গা পরিবর্তন করে। ‘নর্ন’ এর প্রতিষ্ঠাতা ট্রেভিস হোলিঙ্সওর্থ তার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, “এটি প্রচলিত নির্জীব হোটেল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের এই ব্যবস্থার মূল কারণ হলো অতিথিদেরকে যাযাবর জাতির জীবনযাত্রার ধারণা দেওয়া”।
২১ শতকে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশের নিদর্শন সব হারিয়ে যাচ্ছে এবং এগুলোর সাথে মানুষের সম্পর্কটাও। আর এই বিষয়টাই নতুনভাবে সকলের মধ্যে উজ্জীবিত করাই এসব হোটেল ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।
ফিচার ইমেজ: theceomagazine.com