যান্ত্রিক জীবনের বেড়াজালে আটকে মাঝে মাঝেই আমাদের মনে হয় কংক্রিটের শহর আর সব যান্ত্রিকতা ছেড়েছুড়ে বহুদূরে কোথাও গিয়ে থাকতে পারলে ভালই হতো। কিন্তু চাইলেই তো আর বহুদূরে যাওয়া সম্ভব হয় না সবসময়। সময়, অর্থ কিংবা সুযোগের অভাবে থেকে যেতে হয় চিরচেনা যান্ত্রিক জীবনেই। কিন্তু যদি কখনো তিনটিই মিলে যায়? যাবেন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবিচ্ছিন্ন কিংবা দুর্গম জায়গাগুলোতে কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যেতে? যাওয়া হোক বা না হোক, চলুন দেখে আসা যাক পৃথিবীর সবচেয়ে জনবিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম কিছু জায়গা ।
ট্রিস্তান দ্য কুনহা, আটলান্টিক মহাসাগর
দুর্গম এবং জনবিচ্ছিন জায়গাগুলোর নাম আসলে প্রথমেই ট্রিস্তান দ্য কুনহার নাম আসবে। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ এটি। মাত্র ৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটি থেকে সবচেয়ে কাছের জনবসতি ২,০০০ কিলোমিটার দূরে, সেইন্ট হেলেন দ্বীপ। আর সবচেয়ে কাছের মহাদেশ হচ্ছে আফ্রিকা, সাউথ আফ্রিকা থেকে প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার দূরে।
২০১৭ সালের জানুয়ারির হিসেব অনুযায়ী ২৬২ জন স্থায়ী বাসিন্দা রয়েছে এই দ্বীপে। মূলত কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে এখানকার লোকেরা। একটি টিভি স্টেশন, আবহাওয়া অফিস থাকলেও মূল পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই বলা যায় দ্বীপটিকে। দ্বীপে আসা কিংবা বের হওয়ার একমাত্র উপায় পানিপথ। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মাছ ধরার নৌকা বছরে ৮-৯ বার দ্বীপে আসে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট থাকলেও সেটা যে কোনোমতে কাজ চালানোর জন্য তা না বললেও চলে। কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যেতে চাইলে মন্দ হবে না এই দ্বীপটি।
মেটক/মটুও কাউন্টি, চীন/তিব্বত
এটি স্বায়ত্ত্বশাসিত তিব্বতে অবস্থিত এশিয়ার অন্যতম দুর্গম এলাকা, যেখানে আধুনিক পৃথিবীর ছোঁয়া খুব কমই লেগেছে। এখানে পৌঁছানোর জন্য কোনো স্থায়ী রাস্তা নেই। ১৯৭০ সালে চীন সরকার একটি সাধারণ রাস্তা বানালেও বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে এ রাস্তা। চারপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা এই এলাকার জন্য গত কয়েক দশকে মিলিয়ন ডলার প্রজেক্ট হাতে নিলেও দুর্গমতার জন্য একটিও সফলতার মুখ দেখেনি।
হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত এই দুর্গম এলাকায় মেনবা এবং লউবা গোত্রের প্রায় দশ হাজার মানুষের বাস। পুরো এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অবিশ্বাস্য আধার, সাথে রয়েছে নানান প্রজাতির গাছ, চীনের দশ ভাগের এক ভাগ গাছের প্রজাতি রয়েছে এই একটি এলাকাতেই। তিব্বতের বৌদ্ধরা এই জায়গাটি একটি পবিত্র জায়গা হিসেবে গণ্য করে। দুর্গম আর জনবিচ্ছিন্ন হলেও ভ্রমণপিপাসুরা ঠিকই বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এখানকার সৌন্দর্য দেখতে যায়। কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাবার জন্যও বেশ ভাল জায়গা মটুও কাউন্টি।
কেরগুইলেন দ্বীপপুঞ্জ, ভারত মহাসাগর
দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জটি থেকে সবচেয়ে কাছে স্থায়ী জনবসতি মাদাগাস্কার যা প্রায় ৩,৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১,৩৪০ কিলোমিটার দূরে একটি রিসার্চ স্টেশন রয়েছে। কিন্তু স্থায়ী জনবসতি বলতে যা বোঝায়, তার জন্য মাদাগাস্কারই সবচেয়ে কাছে। আনুমানিক ৩০০ ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে প্রায় সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই দ্বীপপুঞ্জটি গঠিত। স্বাভাবিকভাবেই দ্বীপটিতে কোনো এয়ারপোর্ট নেই, বাইরের পৃথিবীতে যাবার একমাত্র মাধ্যম পানিপথ।
এখানে কোনো আদিবাসী না থাকলেও ফ্রান্স সরকারের অধীনে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জে ফ্রেঞ্চ সরকার সবসময় ৪৫ থেকে ১০০ জন গবেষক, প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য রাখে। মূলত মাটি এবং জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণার জন্য ফ্রান্স এই দ্বীপটিকে ব্যবহার করে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও দ্বীপপুঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
লা রিনকোনাডা, পেরু
আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থায়ী জনবসতির এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫,১০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত শহরটি মূলত একটি সোনার খনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। শহরের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও এই সোনার খনিকে ঘিরেই চলে। ২০০১ সালের পর সোনার দাম বেড়ে যাওয়ায় শহরে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছে। তবে খনি এলাকা বলে এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তেমন নেই বললেই চলে। স্যানিটেশন এবং প্লাবিংয়ের নানা রকম সমস্যা রয়েছে, সোনার খনিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের জন্য পরিবেশ দূষণও এখানে বেশি।
ওয়মায়কন, রাশিয়া
পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা গ্রাম হিসেবে বলা হয় ওয়মায়কনকে। জানুয়ারিতে গ্রামের তাপমাত্রা -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে থাকে। আর সারা বছরে সবচেয়ে বড় দিন হয় তিন ঘন্টার কাছাকাছি। শুনে মনে হতে পারে এখানে মানুষ বসবাস করা অসম্ভব। কিন্তু এখানে বর্তমানে ৫০০ মানুষের বাস রয়েছে। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। প্রচন্ড শীতের কারণে কোনো শস্য ফলানো সম্ভব হয় না। গোটা গ্রামে রয়েছে একটি মাত্র দোকান যা সবার দরকার মেটায়। গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের শহরে গাড়িতে করে যেতে লাগে দুদিন।
গত কয়েক বছরে কিছু উন্নয়ন হলেও গ্রামে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সেভাবে নেই বললেই চলে। এখনো প্রচুর বাড়ি রয়েছে যাদের টয়লেট ঘরের বাইরে। নিজেদের গরম রাখার জন্য কয়লা আর কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালায় লোকজন। এখানে এতই ঠান্ডা যে অনেক সময় কলমের কালি জমাট বেঁধে যায়! গাড়ির ব্যাটারি বন্ধ হয়ে যাবে ভয়ে অনেকে গাড়ি সারাদিন চালিয়েই রাখে। প্রচন্ড গরমে বিরক্ত হয়ে এই গ্রাম থেকে ঘুরে আসলে গরমকেই ভালো লাগবে।
পিটকেয়ার্ন দ্বীপপুঞ্জ, প্রশান্ত মহাসাগর
চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্বীপপুঞ্জটি প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। চারটি দ্বীপের মধ্যে শুধুমাত্র পিটকেয়ার্নেই রয়েছে জনবসতি। দ্বীপের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নিউ জিল্যান্ড থেকে আসা জাহাজ বা নৌকা। খাবারের জন্য নিউ জিল্যান্ডের উপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয় দ্বীপবাসীদের। কোনো কিছু অর্ডার করতে হলে অন্তত তিন মাস আগে জানাতে হয়! গোটা দ্বীপে রয়েছে মাত্র ৫০ জন মানুষ।
তবে দ্বীপ ও এর আশেপাশের এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। দ্বীপে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা আর প্রাণী। এর মধ্যে নয় প্রজাতির গাছ আছে যেগুলো গোটা পৃথিবীতে শুধুমাত্র পিটকেয়ার্নেই জন্মে। সম্প্রতি দ্বীপে রেডিও, টিভি, এমনকি ইন্টারনেটের সুবিধাও যুক্ত হয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন হলেও খুব একটা দুর্গম না এই দ্বীপপুঞ্জ। ফলে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে বর্তমানে বেশ ভালোই আয় করছে দ্বীপবাসী।
সোকর্তা দ্বীপ, আরব সাগর
কখনো যদি ভুল করেও এই দ্বীপে চলে যান, তবে আপনার মনে হতেই পারে আপনি হয়তো কোনোভাবে পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে চলে এসেছেন, কেননা এই দ্বীপ দেখে সেটা মনে না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। আরব সাগরের এই দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। তবে এই দ্বীপ এর অদ্ভুত দর্শন গাছপালা আর প্রাণীর জন্যই বেশি বিখ্যাত। মজার ব্যাপার হলো দ্বীপের ভেতরে রাস্তাঘাট খুব একটা ভালো না হলেও দ্বীপে রয়েছে এয়ারপোর্ট। প্রায় প্রতিদিনই এখানে প্লেন আসা যাওয়া করে। এছাড়া সমুদ্রপথে যাতায়াতের ব্যবস্থাও আছে।
সুপাই, আমেরিকা
আমেরিকার বুকেই রয়েছে এক জনবিচ্ছিন্ন এবং দুর্গম এক এলাকা। আরিজোনায় অবস্থিত সুপাইয়ে রয়েছে ২০৮ জন মানুষের বাস। এটি আমেরিকার একমাত্র জনবসতি যেখানে যাবার কোনো রাস্তা নেই বাহির থেকে। এখানে যাবার মাত্র দুটি উপায় রয়েছে- হেলিকপ্টার কিংবা গাধার পিঠে চড়ে।
এটি আসলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের নিচে অবস্থিত। এ কারণেই এটি এত দুর্গম। আর এ দুর্গমতার কারণে ২০০০ সালের আদমশুমারির সময় কর্মকর্তারা এখানে যেতেও ভুলে যান! আমেরিকা যতই আধুনিক হোক না কেন, সুপাইয়ে এখনো চিঠি যায় গাধার পিঠে করে, সেই আদ্যিকালের মতোই।