ফিলিপাইন, অসংখ্য দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এক দেশ। ১১টি বড় দ্বীপসহ মোট ৭,১০৭টি দ্বীপ রয়েছে দেশটিতে। এর মধ্যেই ভ্রমণ পিপাসুদের চোখ কেড়ে নেওয়া সর্বাধিক আলোচিত সাদা বালুর ভূমি বোরাকায় দ্বীপ।
ফিলিপাইনের মধ্যভাগে এই দ্বীপটি অবস্থিত। দ্বীপটি তার রিসোর্ট ও সৈকতগুলোর জন্য জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে। প্রায় ৩০০টির মতো রিসোর্ট রয়েছে মাত্র ৭ কিলোমিটার লম্বা ও ১ কিলোমিটার প্রশস্ত এই দ্বীপে। আকারে ছোট হওয়ায় খুব সহজেই পুরো দ্বীপটি অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দেখে শেষ করা যায়।
এই দ্বীপের পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত জায়গাগুলো হলো হোয়াইট, বুলবগ, পুকা, বেইলিং হাই নামের সৈকতগুলো। এছাড়াও লুহো পর্বত, হ্যাপি বুদ্ধ রিভার রিট্রিট, কারাবো, ক্রোকোডাইল, ম্যানিগুইন, ক্রিস্টাল কোভ নামের মূল দ্বীপের আশেপাশের ক্ষুদ্র দ্বীপগুলোও বোরাকায়ে পর্যটকদের নজর কাড়ে।
উপকূলের সাথে সমান্তরাল বিস্তীর্ণ সাদা বালির ‘হোয়াইট বিচ’ নামের সৈকতটি সর্বাধিক জনপ্রিয়। রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বার, স্যুভেনির শপের কেন্দ্রবিন্দু এই এলাকা। এর সৌন্দর্যকে জীবিত রূপে দেখা যায় রাতের বেলায়। আলোকসজ্জিত রেস্তোরাঁ, লাইভ ব্যান্ড পারফরম্যান্স, ফায়ার ড্যান্সিং, স্বচ্ছ সমুদ্রের জলে রাতের আকাশের প্রতিচ্ছবি- সবকিছুর মিশেলে জাদুকরী টানে পর্যটকদের টানে এই সৈকতটি।
পাম গ্রোভ ও নীল জলরাশির পুকা সৈকত হৈ-হুল্লোড় মুক্ত। এই সমুদ্রসৈকতটির পরিবেশ পিকনিক করার জন্য আদর্শ।
পূর্ব উপকূলের শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের বুলবগ সৈকত ওয়াটার গেমগুলোর জন্য বিখ্যাত। কাইটসার্ফিং, উইন্ডসার্ফিং ও নানা ধরনের প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে সৈকতটি।
সৈকতের পাশেই উপত্যকার চূড়া থেকে সমগ্র দ্বীপের দৃশ্য দেখার সুবিধা আছে বেইলিং হাই নামক সৈকতটিতে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটার উঁচু লুও পর্বতের শীর্ষ বুলাবগ সৈকত এবং সম্পূর্ণ বোরাকায় দ্বীপ দর্শনের জয় সর্বোত্তম জায়গা।
মূল দ্বীপ থেকে ১ ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত কারাবো দ্বীপটি দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যসহ স্নোকেলিং ও বিচ গেমের জন্য পরিচিত।
হ্যাপি বুদ্ধ রিভার রিট্রিট মোটাগ শহরে অবস্থিত। ফিলিপাইনের প্রথম ‘ওপেন এয়ার’ যাদুঘর, ছোট ঝর্ণা, নদী তীরবর্তী দৃশ্য- সব মিলিয়ে নির্জন সৌন্দর্যের জায়গা এটি। ১৫ মিনিটে মিনি ভ্যানে করে পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে।
কুমিরের মতো আকৃতির কারণেই ক্রোকোডাইল দ্বীপের এই নামকরণ। অসংখ্য প্রবালের এই দ্বীপে স্নোকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিংই পারে মানুষকে সমুদ্রের প্রকৃত সৌন্দর্যের অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে যেতে।
ছোট্ট একটি গুহা ও মূর্তির জন্য বিখ্যাত ক্রিস্টাল কোভ নামের ব্যক্তিগত দ্বীপটি।
ম্যানিগুইন দ্বীপ মূলত মূল দ্বীপ থেকে এর পথে যাত্রাপথের ভ্রমণের জন্যই নজর কাড়ে। উপকূলের ধার ঘেঁষে যাওয়ার পথে একসারিতে সৈকত, পর্বত ও গুহার দর্শন হয়ে যায়।
দ্বীপের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি নানা ধরনের বিনোদনমূলক কর্মকান্ড ও ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা আছে। এসবই মূলত দ্বীপটিকে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে এবং একে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলেছিলো।
আইল্যান্ড হপং, স্নোকেলিং, স্কুবা ডাইভিং, উইন্ডসার্ফিং, কাইটসার্ফিং, প্যারাসেইলিং, জিপ লাইনিং, কায়াকিং, মারমেইড সুইমিং, ক্লিফ ডাইভিং- এই সব কিছুরই ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া রাতের বেলায় বিচ পার্টি, আতশবাজি, ফায়ার ড্যান্সিং, স্পার ব্যবস্থা তো রয়েছেই।
সবকিছু মিলিয়েই এই ছোট্ট দ্বীপটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে এবং স্বর্গদ্বীপ নামে পরিচিতি লাভ করে।
পরিচিতি লাভ
১৯৭০ সালের দিকে এই দ্বীপটি প্রথম পর্যটকদের নজরে আসে। ১৯৭০ সালে আমেরিকান পরিচালক জ্যাক স্ট্যারেট ‘ন্যাম’স এঞ্জেলস’ নামক চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়ন করেন বোরাকায়ে। এছাড়াও রবার্ট আল্ড্রিচের পরিচালনায় ‘ট্যু লেইট দ্য হিরো’ চলচ্চিত্রটির অনেকাংশ নির্মিত হয় এখানে। ১৯৭৮ সালে জার্মান লেখক জেনস পিটার ‘প্যারাডাইস অন আর্থ’ বইয়ে এই দ্বীপের সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। পরে আশির দশক থেকে এই দ্বীপে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। ফিলিপাইন ট্যুরিজম অথোরিটির ব্যবস্থাপনায় দ্বীপটিতে সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, বর্জ্য নিষ্কাশন পদ্ধতিসহ সকল কিছুর আধুনিকায়ন করা হয়। পর্যটন শিল্পের বিকাশে নেওয়া এই পদক্ষেপগুলোর পরে দ্বীপটিতে পর্যটক সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে।
অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের প্রভাব
প্রথমদিকে এই বিস্ফোরণ দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনলেও যত দিন যেতে থাকে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে পর্যটক আগমনের কুফল পেতে শুরু করে স্বর্গদ্বীপটি। ২০১৭ সালে ফিলিপাইনে আগত মোট পর্যটকদের এক-তৃতীয়াংশের গন্তব্যস্থলই ছিলো এই দ্বীপটি। এই সংখ্যা ২ মিলিয়নেরও বেশি ছিল গত বছর! খুব স্বাভাবিকভাবেই ৩.৯৮ বর্গ মাইলের ছোট্ট দ্বীপটি এই ভার সইতে না পেরে ধুঁকতে থাকে। এ বছরের এপ্রিল মাসে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ‘রড্রিগো দুতের্তে’ দ্বীপটিকে ‘cesspool’ বা ‘মলকুণ্ড’ আখ্যা দেন। বর্জ্য পদার্থ সরাসরি বোরাকায়ের নীল জলে প্রবাহিত হচ্ছে, এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তিনি এমন বক্তব্য দেন।
এ থেকে দ্বীপটিকে বাঁচানোর জন্য একটি জরুরি টাস্কফোর্স প্রেরণ করা হয়। আট শতাধিক পরিবেশ লঙ্ঘনকারী কার্যক্রমের নমুনা পাওয়া যায়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এই দ্বীপের বর্জ্যপদার্থ দেশটির রাজধানী ম্যানিলার চেয়েও তিনগুণ বেশি। তাই দ্বীপটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ছয় মাসের জন্য পর্যটকদের আগমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির সরকার। এ বছরের ৪ এপ্রিল রদ্রিগো দুতের্তের মুখপাত্র হ্যারি রক ২৬ এপ্রিল থেকে ৬ মাসের জন্য দ্বীপটি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।
কর্তৃপক্ষের গৃহীত পদক্ষেপ
এই ৬ মাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ছাড়াও আরো নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দ্বীপটি রক্ষাকল্পে। দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। সৈকতগুলোসহ সম্পূর্ণ দ্বীপে জনসম্মুখে সিগারেট ও অ্যালকোহল গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহারযোগ্য সকল ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ডেকচেয়ার, সৈকতে খাদ্য ও পানীয়ের দোকান, ম্যাসাজ এসব কিছুও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বীপটির অন্যতম আকর্ষণ ফায়ার ডান্সারদের কেরোসিনে সিক্ত টর্চের পরিবর্তে এলইডি লাইট ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইঞ্জিন চালিত যানবাহন চলাচলের সীমাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কোনো রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ বা হোটেল যদি যেকোনো নিয়ম তিনবারের বেশি ভঙ্গ করে, তাহলে লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। ৩টি ধাপে দ্বীপটি পুনরায় উন্মুক্ত করা হবে। প্রথম ধাপে গত ২৬ অক্টোবর খুবই অল্প সংখ্যক প্রবেশপথ খুলে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ধাপ ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে, এটিও সংরক্ষিত প্রবেশাধিকার মেনে উন্মুক্ত করা হবে। সম্পূর্ণভাবে দ্বীপটি উন্মুক্ত করা হবে ২০১৯ এর ডিসেম্বর মাসে। এছাড়াও পূর্বের মতো অসংখ্য পর্যটকের দ্বীপে প্রবেশের ব্যাপারেও নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরও প্রতিদিন ৬,৪০০ এর মতো পর্যটকের প্রবেশের অনুমতি থাকবে।
কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সকল সম্ভাব্য পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে অনিন্দ্য সুন্দর এই স্বর্গদ্বীপটিকে বিনাশের হাত থেকে বাঁচাতে। দ্বীপটি খুলে দেওয়ার পরে অবস্থার বেশ উন্নতিও লক্ষ্য করা যায়।রাস্তাঘাট সংস্কারসহ আরো কিছু উন্নয়ন কাজ এখনো চলছে।
বাকি দায়িত্বটুকু বর্তায় পর্যটকদের উপরে। পর্যটকদের সচেতনতা না বাড়লে এতসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও এই স্বর্গদ্বীপের আবারও নরকরাজ্যে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সারা বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের সচেতনতাবোধ ও পরিবেশ রক্ষাকল্পে নিজেদের দায়িত্ব পালনের বিকল্প নেই বোরাকায়সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে।