গত বছরের কথা। নতুন অফিসে চাকরিতে ঢুকেছি। এক মাস কাজ করতে না করতেই শুনলাম অফিস থেকে ট্রিপে নিয়ে যাবে। শুনে তো আমি একদম পুলকিত! যদিও তখনো অফিসের সবাই আমার কাছে অপরিচিত। একবার ভাবলাম, যাব না। পরে আবার ভাবলাম, এটাই হয়তো একটা সুযোগ অফিসের সবাইকে কাছ থেকে জানার। কারণ আমি শুনেছিলাম, আপনি দুইটি উপায়ে মানুষকে চিনতে পারবেন: ১. টাকা ধার দিলে, ২. কোথাও একসাথে ঘুরতে গেলে।
তাই আর দেরি না করে বলে দিলাম আমিও যাচ্ছি। কোথায় যাবো জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় অবস্থিত The Base Camp, Bangladesh, এটি দেশের প্রথম আউটডোর অ্যাক্টিভিটি ক্যাম্প। আমাদের আগে থেকেই বলে দেয়া হয়েছিলো সঙ্গে কী কী নিতে হবে, কী ধরনের কাপড় পরতে হবে। এমন কাপড় পরতে হবে যাতে আপনি সব ধরনের অ্যাক্টিভিটি বা ক্রিয়াকলাপ সহজেই করতে পারেন। সকাল সাতটার মধ্যে অফিসে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল। অফিস থেকে আমরা প্রায় উনিশজন দুটি মাইক্রো এবং একটি প্রাইভেট গাড়িতে করে হিম হিম সকালেই গাড়ি চেপে বেজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্য রওনা হই।
এখানে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হয়। কারণ, ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা লেগেই থাকে সেখানে। এমনকি যাদের এমন ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই, তারাও আসেন এখানে রোমাঞ্চের খোঁজে। রাস্তার দু’ধারে শাল গাছের সারি, ততক্ষণে আমরা গাজীপুর চৌরাস্তা ছাড়িয়েছি। ন্যাশনাল পার্কের ৫ নম্বর গেটের ঠিক বিপরীতে গাড়িটি মোড় নিয়ে আমাদের পৌঁছে দিল বেজ ক্যাম্পে। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে আগত অতিথিদের পার্ক করা গাড়ির সারি। সামনে লেপটে থাকা সবুজ ঘাসে ছাওয়া খোলা মাঠ, তাতে কেউ ক্রিকেট খেলছে, কেউ তীর ছুড়ছে। আবার হয়তো দেখবেন দল বেঁধে হাঁস হেঁটে যাচ্ছে। শিশুদের কেউ বা ব্যস্ত বল ছোঁড়াছুড়িতে, কেউবা চালাচ্ছে সাইকেল।
পৌঁছুতেই আমাদের গ্যালারিতে বসতে বলা হলো। এ সময় আপনি আশেপাশে ঘুরেও দেখতে পারবেন কিংবা ফ্রেশও হয়ে নিতে পারেন। এরপর ইন্সট্রাকটর এসে আমাদের মাঠের এক প্রান্তে তিন ধাপের কাঠের সিঁড়ির জায়গায় বসতে বললেন। এসময় তারা রোমাঞ্চকর নানা খেলায় আমাদের কী কী সতর্কতা নিতে হবে সে ব্যাপারে জানালেন। ইন্সট্রাকটর আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কারো উচ্চতাভীতি, অ্যাজমা, হৃদ্রোগের ঝুঁকি আছে কিনা। সুস্থতার কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের ঠিক ততটুকু কার্যক্রমে অংশ নিতে বলা হলো, যতটুকুতে আমাদের শারীরিক সমস্যা হওয়ার কথা না। এরপর আমাদের সবাইকে নিয়ে দুইটি টিম করা হলো, একটি টিমের নাম হচ্ছে ফিনিক্স, আরেকটি টিমের নাম ইউনিকর্ন।
এরই মধ্যে আমাদের স্ন্যাক্স আর কফি/চা খাওয়ার জন্য ব্রেক দেওয়া হলো। এরপর আমাদের কিছুক্ষণ পিটি করিয়ে নেওয়া হলো যেন অ্যাডভেঞ্চার ঠিকমতো করতে পারি। প্রথমেই আমরা যে অ্যাডভেঞ্চার শুরু করলাম তার নাম হচ্ছে ‘অন গ্রাউন্ড’ অ্যাক্টিভিটি। দুই দলে বিভক্ত করে আমরা ফুটবলও খেলি। এছাড়াও আরও আছে সাইক্লিং, মাঙ্কি পাস, টায়ার পাস, টায়ার স্যান্ডউইচ, জিপ লাইন, রোপ ট্রেঞ্চ, রোপ ওয়াক, তির ছোড়া ইত্যাদির ব্যবস্থা; শিশুদের জন্যও আছে পৃথক খেলার ব্যবস্থা। ‘অন গ্রাউন্ড’ অ্যাক্টিভিটি শেষ করার পর আমাদের আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার সময় দেয়া হলো।
এরপরের অ্যাডভেঞ্চারের নাম হচ্ছে ‘অন ট্রি’ অ্যাডভেঞ্চার। এটি মোটামুটি কঠিন ছিল। তাই অনেকেই অন ট্রি অ্যাডভেঞ্চারটি করেনি। আমি প্রায় সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করি। তবে বলতেই হচ্ছে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এই অ্যাডভেঞ্চার করতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল। আমি পুরো অ্যাডভেঞ্চার শেষ করতে পারিনি, কিন্তু আমাদের ইন্সট্রাকটর আমাকে বলেন, আমাকে আরও সময় দিলে আমি পুরোটাই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমাদের সবার একটাই অভিযোগ ছিল, তা হচ্ছে ওদের দেয়া গ্লাভসগুলোতে দুর্গন্ধ অনেক। কারণ, একই গ্লাভস পরপর সবাই ব্যবহার করে। তাছাড়া তারা সবাই খুব বন্ধুসুলভ।
বেজ ক্যাম্পে শীতলতা পাওয়ার জন্য রয়েছে সুইমিংপুল। আমরা অ্যাক্টিভিটিস শেষ করে কিছুক্ষণ পানিতে সাঁতার কেটে ঠাণ্ডা হয়ে নিলাম। ওদের চেঞ্জিং রুম বা ওয়াশ রুম পরিষ্কার, এই ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই। সুইমিংপুলে লাফালাফি করতে করতে তিনটা বেজে গেল। ততক্ষণে ক্ষুধায় আমাদের পেটে ইঁদুর দৌড়ানো শুরু করে দিয়েছিল। এখানে বুফেতে খাবার পরিবেশন করা হয়। যদিও আইটেম কম ছিল, তবে স্বাদ দারুণ। খাবারের মেন্যুতে ছিল পোলাও, গরুর গোস্ত, মুরগির রোস্ট, সবজি, ড্রিংকস। আর এত পরিশ্রমের পর যেকোনো খাবারই মজা লাগাটা স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে খাবারটা চমৎকার ছিল।
খাওয়া শেষে আমরা আবারও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, সে সুযোগে আমরা কলিগদের সাথে কথা বলে একে অন্যের ব্যাপারে জেনে নিচ্ছিলাম। আসলে সে সময়টিই ছিলো টিম বিল্ডিংয়ের সময়। এরপর আমাদের আবার ডাকা হলো। সময় হয়ে গিয়েছিলো আমাদের আরও অ্যাডভেঞ্চার করার। এবার আমরা করলাম আর্চারি বা তীর ছোঁড়া। আমার তীরটি যে কোথায় চলে গিয়েছিলো আমি নিজেও দেখিনি। যা-ই হোক, বাকিরা ভালো করেছিল।
আর্চারি শেষে আমরা এগিয়ে গেলাম জিপ লাইনের দিকে। জিপ লাইন হচ্ছে অনেক উঁচুতে উঠে তারের সাথে ঝুলে নিচের দিকে যাওয়া। উপরে ওঠার পর একটু ভয় লাগে আর যাদের হাইট ফোবিয়া আছে তারা আরও বেশি ভয় পাবে। কিন্তু সবগুলো অ্যাক্টিভিটিসের মধ্যে আমার সব চাইতে ভালো লেগেছে এটি। যখন আমাদের তারের সাথে ঝুলানো হয়, তখন আমাদের নানাভাবে সাহস দেয়া হচ্ছিলো, এই জিনিসটা আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল। যদিও মাত্র কয়েক সেকেন্ডে এটি শেষ হয়ে যায়। আরও কিছুক্ষণ বানরের মতো ঝুলে থাকতে পারলে ভালো লাগতো। যা-ই হোক, জিপ লাইন করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।
এরপরই আমরা কিছু সান্ধ্যকালীন নাস্তা করে শেষবারের মতো একত্রিত হই। কারণ দু’দলের মধ্যে কোন দল জয়ী হয়েছে এবং কে হয়েছে বেস্ট ক্যাম্পার তা ঘোষণা করা হবে। যদিও খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল, তবু যখন বেস্ট ক্যাম্পার হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন আনন্দে আকাশে ভাসছিলাম। এরপর আমাদের একটি ছোট অফিসিয়াল মিটিং হয়ে বিদায় নেয়ার সময় চলে আসে। বিদায় বেলায় সেদিন বেজ ক্যাম্প অনেক কাঁদছিল, মানে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। এই ট্রিপে না আসলে বুঝতামই না টিম বিল্ডিং কাকে বলে। সব মিলিয়ে আমাদের জন্য দারুণ একটি দিন ছিল এটি।
দ্য বেজ ক্যাম্পে বনে ট্রেকিংসহ পুকুরে মাছ ধরারও ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও রাতে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, কমপক্ষে ২০ জন থাকা যায় আছে এমন তাঁবু। যারা একান্তই তাঁবুতে থাকতে চান না, তাদের জন্য বাংলো বাড়ি তো আছেই। তাঁবুর পাশেই চলে ক্যাম্পফায়ার উৎসব, বারবিকিউ পার্টি। শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন খেলা যেমন চলে, ঠিক তেমনি দিনে আবার চলে ক্রিকেট, ফুটবল, ফ্রিসবি, টেবিল টেনিস, ক্যারাম ও আর্চারি। বনভোজনও হয় এখানে। ডুপ্লেক্স বাংলোবাড়ির দোতলায় রয়েছে, আবার ৭০ জন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সম্মেলন কক্ষ। আছে ২৪ ঘণ্টা জেনারেটর সুবিধা। তবে রয়েছে কিছু নিয়ম, যেমন: ড্রাগস এবং অস্ত্র সঙ্গে আনা যাবে না, লিকার সম্পূর্ণ নিষেধ, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট স্থানে ধূমপান করা যাবে, বাইরের খাবার আনা যাবে না।
তাহলে আর দেরী কেন? চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন আপনার বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে অথবা করতে পারেন অফিসের যেকোনো টিম বিল্ডিং অনুষ্ঠানের আয়োজনও। ভ্রমণ হোক আনন্দময়!