দুর্গ মানেই দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বলিত রাজপ্রসাদ। শত্রুপক্ষের আক্রমণ ঠেকাতে দুর্গে থাকে সব ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আর এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে যুগে যুগে শাসকেরা বিভিন্ন অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গ রক্ষা করতে কেউ তৈরি করেছেন দুর্ভেদ্য প্রাচীর, কেউ বা আবার খাল কেটেছেন দুর্গের চারপাশ দিয়ে। অনেকেই আবার একধাপ এগিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কিংবা উপত্যকায় গিয়ে দুর্গ নির্মাণ করেছেন। বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলে দুর্গ তৈরি করার রীতি দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এতে করে শত্রুপক্ষের সৈন্যরা সহজেই দুর্গে প্রবেশ করতে পারে না।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও ভয়ংকর দুর্গটি অবস্থিত। বলছি কালাভান্তিন দুর্গের কথা।
কালাভান্তিন দুর্গের অবস্থান ভারতের মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায়। ওয়েস্টার্ন ঘাট পর্বতশ্রেণীতে প্রবালগড় দুর্গের খুব কাছেই এই দুর্গ অবস্থিত। মুম্বাই শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। ‘কালাভান্তিন’ ছাড়াও এর আরও কয়েকটি নাম রয়েছে, যেমন- কালাওয়ন্তিন, কালাবতী, কালাভান্তি ইত্যাদি।
এই দুর্গকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম দুর্গ বলা হয়। মাথা উঁচু করে থাকা খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ার উপর এই দুর্গের অবস্থান দেখলে আপনার চক্ষু চড়কগাছে উঠবে নিশ্চিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই দুর্গের উচ্চতা প্রায় ২,৩০০ ফুট। ট্রেকিং করার জন্য এটি খুবই জনপ্রিয়।
ইতিহাস
এই দুর্গের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। পার্শ্ববর্তী প্রবালগড় দুর্গ নির্মাণের সমসাময়িককালে এটি নির্মিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের মতে, কালাভান্তিন নামক এক রানীর জন্য এই দুর্গটি নির্মিত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একে দুর্গ নামে ডাকা হলেও পাহাড়ের চূড়ায় দুর্গ বা প্রাসাদ নেই। ছত্রপতি শিবাজী কালাভান্তিন দুর্গ জয় করেন ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে।
এই দুর্গটি একটি সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত, যেখান থেকে তৎকালীন শাসকরা আশপাশে নজর রাখতেন। এটি প্যানভেল এবং কল্যাণের প্রাচীন বন্দরগুলোতে নজর রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল। মূলত অনেক দূরের জিনিস দেখার জন্যই এবং রাজ্যের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য এই সুউচ্চ দুর্গটি নির্মিত হয়। জটিল নির্মাণশৈলী আর ভয়ংকর সিঁড়িগুলোই একে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম দুর্গে পরিণত করেছে।
এই দুর্গের গুহাগুলোর ধরন দেখে বোঝা যায়, এটি বুদ্ধের সময়ের সম্পর্কিত ছিল। শিলাহার এবং যাদব রাজবংশের চিহ্ন পাথরে খোদাই করা। ধারণা করা হয়, সে সময় এখানে সেনাশিবির তৈরি করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় ‘মুরঞ্জন’। অনেকে ধারণা করেন, এটি বাহমানী সাম্রাজ্যের সময়ে নির্মিত। পরে এটি আহমেদনগরের নিজাম শাহীর রাজবংশের অধীনে চলে আসে।
নিজাম শাহীর রাজবংশের যখন ভগ্নদশা চলছিল, তখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন শাহাজি রাজ। সে সময় মুঘল সম্রাট শাহজাহান এবং বিজাপুরের আদিল শাহ শাহাজিকে পরাস্ত করার জন্য আলাদাভাবে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। শাহাজি যখন বিষয়টি জানতে পারেন, তখন তার সৈন্যবাহিনীকে কান্দনা দুর্গ ও মুরুমদেবে সরিয়ে নেন।
এরপর তিনি জঞ্জির সিন্ধীদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেন। কিন্তু সিন্ধীরা সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর শাহাজি চাউল শহরে পর্তুগিজদের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু আবারও ব্যর্থ হন। অবশেষে শাহাজি তার স্ত্রী জাজিবায় এবং যুবক ছেলে শিবাজীকে নিয়ে সৈন্যবাহিনীসহ মুরঞ্জন দুর্গে (প্রবালগড় দুর্গ) চলে যান।
পরে ১৬৩৬ সালে শাহাজির ছেলে শিবাজীর সৈন্যবাহিনী মুঘলদের কাছে পরাজিত জয়। মুঘলরা দুর্গটি দখলে নেয়। সেই বছরে মহুলি চুক্তি সংঘটিত হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী মুঘল শাসক ওই অঞ্চল শাসন করার জন্য বিজাপুরের শাসক আদিল শাহকে কর্তৃত্ব দেয়। শিবাজী এই সুযোগটি কাজে লাগান।
এরপর শিবাজী ১৬৫৭ সালে জাভলি অঞ্চল দখল করে নেন। সে সময় শিবাজীর এক সেনাপতি বাবাজি মহাদেব কল্যাণ, ভীবান্দি এবং রায়রি অঞ্চল জয় করে নেন। মুরঞ্জন দুর্গ শিবাজীর অধীনে চলে আসে। শিবাজী দুর্গের নাম ‘মুরঞ্জন’ থেকে ‘প্রবালগড়’ করেন। ১৬৬৫ সালে পুরানদার চুক্তি অনুযায়ী, ২৩টি দুর্গকে মুঘলদের হাতে হস্তান্তর করা হয়, যার মধ্যে প্রবালগড় দুর্গও ছিল।
প্রতি বছর হোলি (শিমগা) উৎসবে মাছি-প্রবল গ্রামের আদিবাসী মানুষ কালাভান্তিন দুর্গের শীর্ষে নৃত্যের রীতি পালন করে। এ দুর্গের সাথে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। এটি যেন তাদের ঐতিহ্যেরই অংশ।
কালাভান্তিন দুর্গে ট্রেকিং
বিস্ময়কর এই দুর্গটি মুম্বাই-পুনে মহাসড়ক থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। দুর্গের শীর্ষ ভ্রমণ ওয়েস্টার্ন ঘাট পর্বতশ্রেণীর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে আরোহণের জন্য সুউচ্চ খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে তৈরি সরু সিঁড়ি রয়েছে। মাটি এবং পাথর কেটে এই সিঁড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর মৃত্যুর ভয় নিয়ে ট্রেকিং করাটা অনেক বিপদজনক হলেও বেশ রোমাঞ্চকর। এজন্যই তো প্রতি বছর অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু ট্রেকিংয়ের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন এখানে।
কালাভান্তিন দুর্গটি বিপদজনক প্রকৃতির কারণে এবং শীর্ষে অপেক্ষা করা পাখির চোখের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘স্বর্গের উপর চড়ন’ নামে খ্যাতি পেয়েছে। এই দুর্গের বেজপয়েন্ট ঠাকুরওয়াদির গ্রাম। এই গ্রামের উপরই খাড়াভাবে আকাশমুখে উঠে গেছে সুউচ্চ পাহাড়টি। আর সেই পাহাড়ের উপর কালাভান্তিন দুর্গ।
কালাভান্তিন দুর্গ এবং প্রবলগড় দুর্গ পর্যন্ত এই ‘অ্যাড্রেনালিন-স্পার্কিং’ দুর্গের পথে যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। পাথুরি পাহাড়ের গা ঘেঁষে বয়ে চলা শুরু সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে, যা পাথর এবং মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে। হাত রাখার জন্য কোনো গার্ড রেইল নেই, এমনকি নেই দড়িও।
বিপদজনক সিঁড়িগুলো আপনার হৃদয়ে মৃত্যুর ভয় ধরিয়ে দেবে। কিন্তু সুন্দর দৃশ্যাবলী এবং রোমাঞ্চকর ট্রেকিংয়ের অনুভূতি আপনাকে নিয়ে যাবে দুর্গের শীর্ষে।
ট্রেকিংয়ের পথের মাঝে পাহাড়ের গায়ে অনেকগুলো টি-স্টলে রয়েছে। ট্রেকিংয়ের সময় এই স্টলগুলোতে বিরতি দেওয়া যায়। ভয়ংকর বিপদজনক খাড়া পর্বতের গা বেয়ে প্যাঁচানো পাথুরে সিঁড়ি আরোহণের ক্লান্তি ভুলে যাবেন, যখন পাখির চোখে দেখবেন মুম্বাই শহর, প্রবাল দুর্গ, মাথেরান পর্বত, চন্দেরি, এরশাল, কর্নালার দুর্গ আর ওয়েস্টর্ন পর্বতশ্রেণী।
দুর্ঘটনা
কালাভান্তিন দুর্গ ভ্রমণ যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি বিপদজনকও। এখানে ট্রেকিংয়ের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাতছানি রয়েছে পদে পদে। তারপরও থেমে নেই ট্রেকাররা। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারেন না কিছুতেই।
কালাভান্তিন দুর্গে ট্রেকিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর খবর এসেছে মাঝে মাঝেই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রচিতা গুপ্তা ট্রেকিং করতে গিয়ে প্রাণ হারান। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুনের ট্রেকার চেতন ধাণ্ডে দুর্গের চূড়া থেকে পড়ে মারা যান।
চেতন ধাণ্ডের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ট্রেকারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন কিছু নিয়ম চালু করে। আরোহণের পূর্বে ২০ রুপি এবং ব্যক্তিগত বিবরণী নিবন্ধন আকারে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। বিকাল পাঁচটা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত ট্রেকিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্ধকারের সময় ট্রেকিং তো দূরের কথা, ঐ এলাকায় প্রবেশ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অনুমোদিত সময়ে শুধুমাত্র স্থানীয় গাইডের সহায়তায় ট্রেকিং করা যায়। প্রশাসন ৫০ জন স্থানীয় গাইডকে এজন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এছাড়া ট্রেকারদের জন্য প্লাস্টিকের বোতল এবং প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।