মোহনীয় জলরাশির টাঙ্গুয়ার হাওর

“বাংলার মুখ, আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।” 

বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় এভাবেই বাংলার সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন। কবির এ কথার সত্যতা তার কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই লাইনের মর্ম বোঝার জন্য বাংলার মাঠে-ঘাটে চোখ মেলে তাকাতে হয়। আসলেই বাংলার রূপ আর আবহাওয়ার সাথে পৃথিবীর কিছুর তুলনা হয় না। সেই সৌন্দর্যের লীলাভূমির অনেকাংশই দখল করে রেখেছে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেট। পাহাড়-পর্বত, নদী-লেক, শহর-গ্রাম, সবুজ-নীল সবকিছু মিলিয়ে বাংলার অপরূপ সুন্দর স্থান এই সিলেট। আর সেই সিলেটের স্বর্গদ্বার টাঙ্গুয়ার হাওর।

Image Credit: Author
নীল আকাশ আর নীল হাওর মিশে একাকার; Image Credit: Author

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনেক হাওর এবং জলাভূমি রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হাওর- টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এটি। সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত এই হাওর। স্থানীয় মানুষেরা একে বলে, ‘নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল’। টাঙ্গুয়ার হাওরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ হাওর ভ্রমণের আদর্শ সময় বর্ষাকাল, তবে শীতকালেও এখানে প্রচুর দর্শনার্থী আসেন অতিথি পাখি দেখার জন্য। 

অনেকদিন ধরে নিজ চোখে টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার ইচ্ছাটা জমা ছিল। এক রাতে পাঁচ বন্ধু মিলে বের হয়ে গেলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের পথে। প্রথমে আমাদের লক্ষ্য ছিল সুনামগঞ্জ পৌঁছানো। সরাসরি বাসেও যাওয়া যায়, আবার ট্রেনে করে সিলেট শহর পর্যন্ত গিয়ে আবার সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বাসে যাওয়া যায়। রাতের ট্রেনে দুই পাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা না গেলেও ভোরের আলোয় দেখা মেলে চমৎকার এক চায়ের রাজ্যের। তা আপনার সারা রাত ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করে দেবে এক নিমেষেই। সিলেট শহরে নেমেই চলে গেলাম কুমারগাঁওয়ে, যেখান থেকে সুনামগঞ্জের বাস ছাড়ে। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ভ্রমণের পর পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জ শহরে। তারপর সেখান থেকে সিএনজি, বাইক অথবা লেগুনা করে তাহিরপুর যেতে হয়।

Image Credit: Author
হাওরে অহরহ দেখা যায় এমন উঁচু ঘর; Image Credit: Author

তাহিরপুর পৌঁছাতে সময় লাগে ২ ঘণ্টার মতো। বর্ষায় পুরো রাস্তা পানির নিচে ডুবে থাকে, আর দু’ধারে দেখা মেলে ছোট-বড় অনেক হাওর। তাহিরপুর যাওয়ার সময়েই দেখা যায় বিশালাকার শনির হাওর। পানির স্রোত যথেষ্ট বেশি হওয়ায় এখানে সচরাচর পর্যটকদের যেতে দেওয়া হয় না। তাহিরপুর পৌঁছেই ট্রলার বা বোট ভাড়া করতে হয়। ছোট-বড় মিলিয়ে অনেক বোট ছেড়ে যায় টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে বোট ভাড়া করে যেতে হয় স্থানীয় থানায় পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নেবার জন্য। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্যই মূলত এই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়ে থাকে। থানায় সব কাজ শেষ করে চলে গেলাম ঘাটের দিকে।

চাইলে দুপুরে এবং রাতে খাবার জন্য বাজার করে নেওয়া যায়। হাওরের সুস্বাদু মাছ আর হাঁসের স্বাদ পেতে চাইলে অবশ্যই বাজার করে উঠা উচিত। মাঝিদের সুস্বাদু রান্না আর হাওরের স্বর্গীয় সৌন্দর্যে আপনি হারিয়ে যেতে বাধ্য। বাজার শেষে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে রাতে টেকেরঘাট থাকার পরিকল্পনা নিয়েই একদিনের জন্য নৌকা ভাড়া করি। দুপুরে রওনা হয়ে সন্ধ্যার ভেতর পৌঁছে গেলাম টেকেরঘাট গ্রামে। এখানে মূলত পরিত্যক্ত চুনা পাথর খনি রয়েছে। এখানে তৈরি হয়েছে বাংলার সুইজারল্যান্ড খ্যাত নীলাদ্রি লেক। টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশাপাশি নীলাদ্রি লেক এবং শিমুল বাগান ঘুরে আসা যায়। এর পাশাপাশি রয়েছে বারিক্কা টিলা, লাকমাছড়া এবং জাদুকাটা নদী, যা একইসাথে ঘুরে আসা যায়।

দুপুরে তাহিরপুর নৌকাঘাট থেকে রওনা হয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল ওয়াচ টাওয়ার। ওয়াচ টাওয়ারে যেতে প্রায় ১ ঘণ্টার কিছু কম সময় লাগল। সেখান থেকে পুরো হাওরের মোটামুটি একটা ভালো দৃশ্য দেখা যায়। টাওয়ারের নিচেই রয়েছে অসংখ্য হিজল, করচ গাছ, যা পানিতে অর্ধডুবন্ত অবস্থায় ছিল। শুকনো মৌসুমে অঞ্চলটি একদম খোলা সবুজ মাঠের মতো হয়ে যায়। আর যখন পানি থাকে, তখন এখানেই সবাই গোসল করে, সাঁতার কাটে, ছোট ছোট কাঠের নৌকা চালায়। এসব নৌকায় ছোট ছেলে-মেয়েরা চা-বিস্কুট বিক্রি করে এবং হিজল-করচ বনটি নৌকায় ঘুরিয়ে দেখায়। হাওরের এ অংশের পানি সবসময় পরিষ্কার থাকে। ছোট নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় নৌকার মাঝিরা স্থানীয় বিভিন্ন লোকসঙ্গীত গেয়ে থাকে, যা পর্যটকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

Image Credit: Author
ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাওরের দৃশ্য; Image Credit: Author

ওয়াচ টাওয়ারে গোসল শেষ করে আমরা আবার রওনা দিলাম টেকেরঘাটের দিকে। যাবার পথে দেখা মেলে এক পাশে ভারতের মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়, আর অপর পাশে বিশাল হাওরের দৃশ্যের। নীল আকাশ আর নীল হাওরের পানি মিশে একাকার। বর্ষায় হাওরের পানি একটু ঘোলা থাকে। বর্ষার শেষদিকে যথেষ্ট স্বচ্ছ থাকে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ হাওরে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে। শুকনো মৌসুমে তারা শহরে গিয়ে কাজ করে, নয়তো ফসল চাষ করে থাকে। তাই হাওরের মানুষদের জীবন অনেক বিচিত্র। হাওরে পানির উপর ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হয় নৌকায় করে। অনেক জায়গায় দেখা যায় ছোট বাঁশের সাঁকো।

দুপুরের খাবার শেষে সূর্যাস্তের সময় দেখা মিলল হাওরের এক অসাধারণ দৃশ্যের। পানির রং নীল থেকে কখনো সবুজ, কখনো কমলা আভায় রঙিন হয়ে যাচ্ছিল। আকাশের রঙের সাথে তাল মিলিয়ে খুব সুন্দর করে বদলে যাচ্ছিল পানির রঙ। আরেকটু বেলা ঘনিয়ে যখন প্রায় সন্ধ্যা, তখন পাশে ছোট্ট একটি পাড়া থেকে ভেসে আসছিল আজানের ধ্বনি। আর আকাশে উঁকি দিচ্ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপ অন্যরকম থাকে। এ সময় চাঁদের আলোয় হাওরের পানি চিকচিক করতে থাকে এবং দূর-দূরান্তের সবকিছু একদম পরিষ্কার দেখা যায়। ভাগ্য ভালো হলে পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে পারলে দিনের পাশাপাশি রাতেও দেখা মিলবে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের।

Image Credit: Author
পূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওর। দূরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হলুদ বাতি জ্বলছে; Image Credit: Author

টেকেরঘাট পৌঁছাতে একদম সন্ধ্যা হয়ে গেল। দূরে পাহাড়ের উপর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হলুদ বাতি জ্বলছে। পেছনে হাওর আর আকাশে চাঁদ, পাশাপাশি হাওরের নির্মল-শীতল বাতাস। টেকেরঘাট নেমেই আমাদের নৌকা নোঙর করে রাখা হলো এবং আমরা গেলাম নীলাদ্রি লেক এবং আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখতে। পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু বেশ ভালো দেখা যাচ্ছিল। নীলাদ্রি লেককে চাঁদের আলোয় আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। সবুজ ঘাসে মোড়ানো সবুজ টিলা আর নীরব শান্ত পরিবেশে ভারতীয় সীমান্ত থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল। এমন একটি সুন্দর রাতের জন্য যেন হাজার রাত জেগে থাকা সম্ভব। টেকেরঘাটে অনেকটা পুরনো আমলের স্বাদ পাওয়া যায়। একসময় এখান থেকেই চুনাপাথর উত্তোলন করা হতো। অনেক পরিত্যক্ত ভবন আর বিশালাকার পাথর উত্তোলন মেশিন দেখেই তা বোঝা যায়। 

টেকেরঘাটে রাতের খাবার খেয়ে রওনা দিলাম আমাদের ট্রলারের দিকে। আজকে রাতে পাড় থেকে একটু দূরে হাওরের মাঝে ট্রলারে থাকা হবে। আমাদের নৌকার মাঝি থেকে জানতে পারলাম, একসময় রাতে হাওরে নৌকা নিয়ে পর্যটকরা একটু দূরে থাকতে গেলেই ডাকাতি হতো। এখন সব নৌকা কাছাকাছি এবং পাড়ের কাছে রাখা হয়, যেন যেকোনো সমস্যায় সহায়তা পাওয়া যায়। তাই নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। পূর্ণিমার আলোয় সারারাত সবাই জেগে ছিলাম। গল্প, আড্ডা আর চাঁদের আলোয় অপরূপ টাঙ্গুয়ার হাওরে কেটে গেল আমাদের রাত। খুব ভোরের সূর্য যখন পাহাড়ের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছিল, তখনো বারবার মনে হচ্ছিল, এ রাত যদি শেষ না হতো, তবে কেমন হতো!

 Image Credit: Author
টেকেরঘাট এবং নীলাদ্রি লেক; Image Credit: Author

ভোরে উঠেই বাইকে করে রওনা দিলাম বারিক্কা টিলা, যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান এবং লাকমা ছড়া দেখার জন্য। যাদুকাটা নদীর সৌন্দর্য যেকোনো নদীর সৌন্দর্যকে হার মানাতে বাধ্য। বাইকে করে সবকিছু ঘুরতে গিয়ে একপাশে সবসময় মেঘালয়ের পাহাড়গুলোকে পাওয়া যায়। বিশাল পাহাড়, ঝর্ণা, হাওরে মিশে একাকার টেকেরঘাট। প্রায় ২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে আমরা ফিরে এলাম আমাদের নৌকায়।

এখন আমাদের ফিরে যাবার পালা। ফিরে আসার সময় টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্য একটি রাস্তা দিয়ে আসা হয়। সেখানেও দেখা মেলে অসংখ্য ছোট গ্রাম আর অনেক উঁচুতে তৈরি কিছু ঘরের। বোঝাই যায়, হাওরের পানির উচ্চতা কতটুকু বাড়তে পারে। মাঝিদের থেকে জানতে পারলাম, মেঘালয়ের পাহাড় থেকে প্রায় ৩০টির বেশি ঝর্না এ হাওরে এসে মিলিত হয়েছে। হাওরের পানির আরেক উৎস এসব ঝর্ণা। 

ফিরে আসার সময় দেখা দিল আকাশে প্রচুর মেঘ, আর সাথে প্রচণ্ড বাতাস। শান্ত টাঙ্গুয়ার হাওর রূপ নিল উত্তাল জলরাশিতে। দেখা মিলল হাওরের আরেক উত্তাল রূপে। তবে বেশ নিরাপদেই আমরা তাহিরপুরে ফিরে আসি। ফিরে এসেই মাঝিদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার সিলেট শহরের দিকে রওনা দেই। এভাবেই শেষ হয়ে গেল আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরের এক স্মরণীয় ভ্রমণ, যা স্মৃতির পাতায় যোগ করল আরেকটি সুন্দর অভিজ্ঞতা।

সময় পেলেই ঘুরে আসতে পারেন টাঙ্গুয়ার হাওর। তবে হাওরে প্লাস্টিক, ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন। এই হাওর আমাদের দেশের সম্পদ। এটি হাওর পর্যটন কেন্দ্রের পাশাপাশি হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস; বিভিন্ন মাছ, সরীসৃপ, অতিথি পাখি এবং উদ্ভিদের আশ্রয়স্থল। ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক।

This article is in Bangla. It is about a tour to Tanguar haor, a great tourist spot in Bangladesh.

Featured Image Credit: Author

Related Articles

Exit mobile version