দুর্গম, বিপজ্জনক যাত্রাপথ আপনাকে ঠিক কতটা রোমাঞ্চিত করে? পৃথিবীর রোমাঞ্চকর কিছু যাত্রাপথ নিয়ে কথা হবে আজকের লেখাটিতে।
ম্যাকলং রেলওয়ে, থাইল্যান্ড
সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে যে, এশিয়ার যেকোনো দেশের ঘনবসতিপূর্ণ একটি বাজার! কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ করে দিনে বেশ কয়েকবার সেই বাজারের মাঝখান থেকে ট্রেন যেতেই পুরো দৃশ্যটাই যেন পালটে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাজারটি প্রকৃতপক্ষেই রেললাইনের উপর! যখনই ট্রেন আসি আসি ভাব, তখন মুহূর্তেই সেখানে হৈ চৈ এলাহি কাণ্ড শুরু হয়ে অ্যায় এবং সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই রেলালাইনের ওপর থেকে বাজারের মালামালগুলো তুলে নেয়া হয়। তারপর ট্রেন যেতেই জায়গাটি আগের রূপ ধারণ করে। থাইল্যান্ডের সবচাইতে ধীরগতির ট্রেনগুলোর মধ্যে এটি একটি। প্রতি ঘণ্টায় এর বেগ ৩০ কি.মি.। ১৯০৫ সাল থেকে এই রেললাইনের ওপর এভাবেই বাজারটি বসে।
প্রিন্সেস জুলিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, সিম্পসন উপসাগর, সেন্ট মার্টিন, ক্যারিবিয়া
নিরাপদভাবে অবতরণ করার জন্য গড়পড়তা একটি বিমানের কমপক্ষে ৮,০০০ ফুট রানওয়ের প্রয়োজন হয়। তবে এর ঠিক ব্যতিক্রমটিই ঘটে প্রিন্সেস জুলিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দরে! সেখানকার ল্যান্ডিং স্ট্রিপ (বিমান ওঠা নামার জায়গা) এর পরিমাপ মাত্র ৭,৪৫৬ ফুট! অথচ সেখানে সবচেয়ে বড়, যেমন- এ৩৪০ ও এ৭৪৭ এর মতো উড়োজাহাজগুলো অবতরণ করে। শুধু তা-ই নয়, উড়োজাহাজগুলো মাহো সমুদ্র সৈকত দিয়ে যখন যায় তখন মনে হয় যেন একেবারে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া রানওয়েতে যাওয়ার জন্য একটি বেড়াও অতিক্রম করতে হয়।
দ্য ডেথ রেলওয়ে, থাইল্যান্ড
দ্য ডেথ রেলওয়ে বা বার্মা রেলওয়ে মায়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি থাইল্যান্ডের রাজ্য কাঞ্চনাবুড়িতে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে জাপানের রাজত্বকালে এই রেলওয়েটি তৈরি করা হয়েছিলো, যা ঘন বন জঙ্গল ও খাড়া বা খুব বেশি ঢালু পাহাড় দিয়ে চলাচল করে। ডেথ রেলওয়ে হিসেবে এর নামটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ হলো, এর সেতুটি নির্মাণের সময় ৯০,০০০ বেসামরিক শ্রমিক এবং মিত্রবাহিনীর ১২,০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে।
গিসবোর্ন এয়ারপোর্ট, নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের মধ্যে উত্তর দ্বীপের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত গিসবোর্ন বিমান বন্দরটিকে অন্য সব বিমান বন্দর থেকে বেশ একক ও অনন্য বলা যেতে পারে। কারণ এই বিমান বন্দরের রানওয়ের মাঝ দিয়ে রয়েছে রেলপথ! নিশ্চয়ই এই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন যে, তাহলে কত দুর্ঘটনাই না ঘটার কথা এই বিমান বন্দরে! পাল্মারস্টোন নর্থ-গিবসন লাইনের ওপর দিয়ে সারা দিনব্যাপী রেলগাড়ি যাতায়াত করে। বিমান বন্দর ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যেকোনো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সর্বদা সময়ের সামঞ্জস্য বিধান করে চলে।
গোলিয়াং টানেল রোড, চায়না
চায়নার হেনান প্রদেশের হিউইশান, শিনশিয়ানে অবস্থিত এই ১৬ ফুট উঁচু এবং ১৩ ফুট প্রশস্ত পাহাড়ি পথটি ১৯৭০ সালে তৈরি করেছিলো ১৩ জন স্থানীয় গ্রামবাসী। আক্ষরিকভাবে এই সুড়ঙ্গ পথের অর্থ দাঁড়ায় “যে রাস্তা কোনো ভুল সহ্য করে না“! আসলেই চলাচলের সময় বোঝা যায় যে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সুড়ঙ্গ পথ।
সাবা এয়ারপোর্ট, নেদারল্যান্ড
এই বিমান বন্দরটিতে রয়েছে পৃথিবীর সবচাইতে ছোট রানওয়ে! উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে একে পৃথিবীর সবচাইতে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বন্দর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। নেদারল্যান্ড রাজ্যের অংশীদার দেশ সেন্ট মার্টিন থেকে ৪৫ কি.মি. দক্ষিণে রয়েছে এই বিমান বন্দরটি। ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যের ছোট এই বাণিজ্যিক রানওয়েতে উড়োজাহাজ অবতরণ করানোটা সারা বিশ্বের বৈমানিকদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ খুব ছোট্ট একটি ভুলের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ট্রেন অ্যা লাস নিউবস্, আর্জেন্টিনা
চিলির সীমান্তের সাথে আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিমকে সংযুক্ত করা এই রেল লাইনটি আন্দিজ পর্বতমালার মধ্য দিয়ে যায়। এই রেলগাড়িটি পূর্ব সালতা-আন্তো ফাগাস্তা রেলওয়ে বা ওয়াইতিকিনা দিয়ে চলাচল করে এবং এটি বেলগ্রানো রেলওয়ে কোম্পানির একটি অংশ। এই রেললাইনটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,২২০ মিটার উপরে এবং বিশ্বের সবচাইতে উঁচু রেললাইনগুলোর মধ্যে এটি পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে।
চেন্নাই-রামেশ্বরম রেলওয়ে, ভারত
এই রেললাইনটি রামেশ্বরম দ্বীপকে ভারতের পশ্চিমের মূল ভূখণ্ড (চেন্নাই) এর সাথে একত্র করে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে জায়গা করে নেয়া ১০৩ বছর পুরনো এই সেতুটিতে রয়েছে খুবই নিচু খিলান এবং দৈর্ঘ্য ২,০৬৫ মিটার। এই সেতুটি দিয়ে যাওয়ার সময় দু’পাশে শুধুমাত্র পানি ছাড়া আর অন্য কিছুই আপনার চোখে পড়বে না। মনে হয় যেন ট্রেনটি সমুদ্রের ওপর ঝাঁকুনি খাচ্ছে।
কাবুল-জালালাবাদ রোড
সর্পিল এই রাস্তাটি গিয়ে পৌঁছায় তালেবান অঞ্চলে। বলতে গেলে, এই রাস্তাটি যথাযথভাবে কোনো এলাকার মধ্যেই পড়ে না! পাথুরে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া এই ৬৫ কি.মি. রাজপথটির আশেপাশে একেবারেই কোনো জনবসতি নেই। পৃথিবীর সবচাইতে বিপজ্জনক রাস্তা হিসেবে আখ্যা পেয়েছে এই রাজপথটি। ১৯৬৯ সালে তৈরি করা এই রাজপথটিতে চালকদের নিরবচ্ছিন্ন গাড়ি চালানোর জন্য প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। শীতকালে যখন প্রচন্ড তুষারপাত হয় তখন রাস্তা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়ার কারণে সেখানে মাইলের পর মাইল গাড়ি ভিড় করে থাকে।
এন্টার্কটিকা
পৃথিবীর সবচাইতে শীতল এই অংশটিতে ঠিকঠাক কোনো রানওয়ে নেই। বরফের ওপর উড়োজাহাজ অবতরণ করার বিষয়টি শুনলেও যেন পুরো শরীর শিউরে ওঠে, তবুও বলতে গেলে এই ব্যাপারটি উদ্বেগ সৃষ্টি করার শুরুই কেবল। সবচাইতে গুরুতর বিষয়টি হলো ভারি ভারি সব উড়োজাহাজের বরফে অবতরণ করাটা! প্রতিটি উড়োজাহাজই নামার সময় এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যেন নামার সময় বরফে ফাটল না ধরে। অন্য দিকে, বরফে আটকে পড়াটা হলো আরেক কাহিনী।
দ্য জেমস ডব্লিউ ডালটন হাইওয়ে, আলাস্কা
দ্য জেমস ডব্লিউ ডালটন হাইওয়ে বা আলাস্কা ১১ হাইওয়ে পৃথিবীর ঝুঁকিপূর্ণ রাজপথগুলোর মধ্যে একটি। ৪১৪ মাইল দীর্ঘ এই রাজপথটি ফেয়ারব্যাঙ্কের এলিয়ট হাইওয়ে থেকে শুরু হয়ে উত্তর মহাসাগরের কাছে ডেডহর্সে গিয়ে থামে। এই রাজপথটি এই দুয়ের মাঝখানেই কোনো এক জায়গায় রয়েছে। এই মহাসড়কের আশেপাশে কেবল ১,০০০ জন বাসিন্দা রয়েছে এবং মাত্র তিনটি ফুয়েলিং স্টেশন আছে। আর সময়ভেদে প্রখর আবহাওয়া, ঠাণ্ডা বাতাস ও তুষারাবৃত রাস্তা তো আছেই।
ভিতিম রিভার ব্রিজ, সাইবেরিয়া
সাইবেরিয়াতে অবস্থিত ভিটিম নদীটি লেনা নদীর একটি উপনদ। ৬ ফুট প্রশস্ত এই সেতুটি দিয়ে গড়পড়তা যেকোনো গাড়ি যেতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। তাই আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেতুটির দু’পাশে কোনোরকম বেড়া বা রেলিং একদমই নেই! ৫৭০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি প্রায়ই চলাচলের অযোগ্য বলে বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর শীতলতম প্রান্তে মরিচা পড়া ধাতু ও কড়িকাঠ দিয়ে বানানো এই পিচ্ছিল সেতুটি দিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ সাহসিকতার প্রয়োজন!
দ্য যোজি লা পাস, ভারত
দ্য যোজি লা পাস হলো রাস্তার চাইতেও বেশি কিছু! কারণ এটি লাদাখে বসবাসকারীদের জন্য পুরো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করার একমাত্র পথ! ৯ কি.মি. লম্বা এই পাহাড়ি রাস্তাটি কাশ্মীরকে লাদাখের সাথে সংযুক্ত করে। ৩,৫২৮ মিটার উঁচুতে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত আঁকাবাঁকা এই রাস্তাটির একপাশে রয়েছে পাহাড়ি শিলার বেড়া, আরেকপাশ একেবারে উন্মুক্ত।
ফিচার ইমেজ: bestvideosintheworld.com