দুই দেশের সীমানা চলে গিয়েছে যে লাইব্রেরির মধ্য দিয়ে

প্রথম দেখায় আর দশটা গ্রন্থাগারের মতন স্বাভাবিক মনে হবে হাসকেল লাইব্রেরিকে। ভেতরটা বই দিয়ে ভর্তি, মানুষের আনাগোনাও যথেষ্ট। গ্রন্থাগার বলতে এমন কিছুই তো বুঝি আমরা, তাই না? তাহলে আবার অন্যরকম কী করে হলো আমেরিকার এই গ্রন্থাগারটি?

হ্যা, তা একটু ভারিক্কিভাব লেগে আছে বটে হাসকেল লাইব্রেরির শরীরে। সেই ১৯০৫ সালের কাঠের খোদাই এখনো ঠিক তেমনিভাবেই আছে এর পরতে পরতে। সেই সাথে আছে ভারী ভারী সব আসবাব। তবে এসব কিছুই নয়, হাসকেল লাইব্রেরিকে অনন্য করে তুলেছে সামান্য একটি রেখা। রেখাটির বিস্তৃতি খুব অল্প, তবে যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডাকে আলাদা করে দিয়েছে এই সামান্য রেখাটি।

যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডাকে আলাদা করে দিয়েছে এই সামান্য রেখাটি; Source: Daily Mail

কেন হাসকেল লাইব্রেরির মধ্য দিয়ে কালো দাগ চলে গিয়েছে, কেন ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজি দুটো ভাষাতেই পারদর্শী হতে হয় হাসকেল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিককে, আর কেনই বা কানাডা আর ফ্রেঞ্চ– দুটো ইতিহাসের বই-ই মজুদ রাখতে হয় এখানে- এই প্রশ্নগুলোর জবাব এই একটিই। আর সেটি হলো লম্বা এক সীমারেখা।

কোন অসুবিধা হয় দুই দেশের গ্রন্থাগার হাসকেল লাইব্রেরীর? উঁহু, একদম না। বরং এক পা আমেরিকা, আরেক পা কানাডায় রেখে দিব্যি কেটে যাচ্ছে লাইব্রেরির দিনকাল। সামান্য মাস্কিং টেপের চিহ্ন রেখেই দুটো দেশের সীমারেখা এঁকে দেওয়া হয়েছে। একদিকে ভার্মন্টের ডার্বি লাইন আর অন্যদিকে কুইবেকের স্ট্যান্ডস্টিড- সব মিলিয়ে বেশ মজার ব্যাপার। গ্রন্থাগারের ভাগাভাগির সাথে সাথে এর বইগুলোরও কিন্তু ভাগ হয়ে গিয়েছে। গ্রন্থাগারের সামনের দরজা, বুলেটিন বোর্ড আর শিশুদের বই- এগুলো পড়েছে আমেরিকার ভাগে। আর বাদবাকি সব বর্ডারের অন্যপাশে, অর্থাৎ কানাডায়।

গ্রন্থাগারের ভাগাভাগির সাথে সাথে এর বইগুলোরও কিন্তু ভাগ হয়ে গিয়েছে; Source: BBC

অবশ্য হাসকেল লাইব্রেরির কোন বই কোন দেশে পড়েছে সেটা নিয়ে মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এখানে যারা আসেন তাদের বেশিরভাগ সময়ই কেটে যায় গ্রন্থাগারের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া বর্ডারের সাথে ছবি তুলতে। কেউ বর্ডারের পাশে শুয়ে, কেউ বসে, কেউ আবার পরিবার সহ, কেউ একা, কেউ নানা রকম স্টাইল করে। যে যেভাবে পারছে ছবি তুলে যাচ্ছে। এটা গ্রন্থাগারের খুব পরিচিত দৃশ্য। সবচাইতে মজার ব্যাপার ঘটে যখন কেউ কেউ স্থির হয়ে যান রেখার সামনে দাঁড়িয়ে। শত শত বছর ধরে সীমারেখা নামক ব্যাপারটির সাথে অভ্যস্ত হওয়ার পর সেটাকে একটি সামান্য টেপের সাহায্য চিহ্নিত করা আর তাকে পেরিয়ে যেতে পারার মতন ক্ষমতা পাওয়া মানুষের পক্ষে খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। তাই অনুমতি থাকুক বা না থাকুক, বর্ডার শব্দটিকে তুচ্ছ করে দুই দেশে দুই পা রাখার মতন ব্যাপারটি মানুষকে আলোড়িত করে।

আমেরিকা ও কানাডার পতাকা বর্ডারে পাশাপাশি; Source: Toronto Star

“মানচিত্রের একটা রেখা আমাদের বিভক্ত করবে, আলাদা করে দেবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু এই ব্যাপারটিই হাসকেল লাইব্রেরিকে আরো অনন্য করে তুলেছে। হ্যাঁ, এর মধ্য দিয়ে একটি সীমারেখা চলে গিয়েছে। তবে সেটা মানুষকে আরো কাছাকাছি এনেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?” কথাগুলো বলছিলেন হাসকেল অপেরা হাউজের সাবেক পরিচালক হাল নিউম্যান। তিনি কানাডার নাগরিক। কিছুদিন আগে তার পরিচালিত হাসকেল অপেরা হাউজের অবস্থাটাও অনেকটা হাসকেল গ্রন্থাগারের মত। অপেরা হাউজটির মধ্য দিয়েও চলে গিয়েছে দুই দেশের সীমারেখা। অপেরা হাউজের ঘরটিকে “দ্যা ইম্পসিবল রুম” নামে ডাকেন তিনি। হাউজের মঞ্চ কানাডায় আর বেশিরভাগ আসন আমেরিকায়- এমন একটি ঘরকে অসম্ভব কিছু বললে কি সেটা খুব বেশি ভুল হয়ে যাবে?

সবচাইতে মজার ব্যাপার হল, অপেরা হাউজের বর্ডার রেখাটি কিছু আসনের মাঝ দিয়ে চলে গিয়েছে। তাই এই আসনে বসলে আক্ষরিকভাবেই আপনার মাথাকে দুই দেশে রাখতে পারবেন আপনি। আর সেই সাথে উপভোগ করতে পারবেন নান্দনিক উপস্থাপনাও।

বর্ডার চলে গিয়েছে হাসকেল অপেরা হাউজের মধ্য দিয়েও; Soirce :BBC

কী ভাবছেন? ভুল করে তৈরি করা হয়েছে এমন অদ্ভুত বর্ডার? একদম না। বরং ইচ্ছে করেই দুই দেশের ভেতরে সম্প্রীতি বাড়িয়ে তুলতে এক শতক আগে ঠিক বর্ডারের মাঝখানে লাইব্রেরি আর অপেরা হাউজ নির্মাণ করেছিল হাসকেল পরিবার। তবে ব্যাপারটা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। এমনকি পুরো ব্যাপারটি টিকিয়ে রাখাটাও যথেষ্ট জটিল। মোট দু’রকমের মুদ্রা গ্রহণ করতে হয় এখানে, নিরাপত্তার দিক দিয়েও দু’দিকেই বেশ কড়া নজর রাখতে হয়। শুধু তা-ই নয়, খাবার খাওয়ার জন্যও বর্ডার পার করতে হয় মানুষকে।

বছর ১৫ আগে তো বেশ ঝামেলাই তৈরি হয়েছিলো! নতুন একটি এলিভেটর বসানো হবে দালানে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গিয়েছিলো এলিভেটর আর সেটার ক্রেনকে নিয়ে। এলিভেটর কানাডায় থাকলেও ক্রেন আমেরিকায়। ফলে দুই দেশকেই বেশ মোটা অংকের টাকা দিতে হত এই কাজে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ক্রেন আমেরিকাতেই থাকবে। আর কানাডায় অবস্থিত এলিভেটর চলবে আকাশপথ দিয়ে। তবুও অবশ্য বিরক্তি বা ঝামেলাবোধ করেন না এখানকার কেউ। ক’জনের ভাগ্যে এমন দুই দেশে কাজ করার সুযোগ থাকে?

হাসকিল লাইব্রেরি; Source: Travel Photography by Gary Arndt

সেই যে ১৭ শতকে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি ভাগ করে দিল এক দেশকে আরেক দেশ থেকে, এরপর থেকেই সমস্যার শুরু। বর্তমানে দেশে দেশে যেখানে সংঘাত চলছে, মানুষ যেখানে একটু জমির জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, সেখানে এমন একটি সীমারেখা কেবল একটি সীমারেখা নয়, অনেক বিশাল কিছু। সীমানা যে আসলে কিছুই না, মানুষই আসল- সেটা বোঝানোর জন্য এমন একটি সীমারেখাই যথেষ্ট। তবে হাসকেল লাইব্রেরির এই বর্ডার নিয়েও তৈরি হয়েছে প্রচুর ঝামেলা। শুরুটা হয় ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। ১০ই সেপ্টেম্বরেও যেটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি, ১১ই সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার মধ্য দিয়ে সেটাই হয়েছে। বর্ডারের রেখা পড়েছে রাস্তার যে অংশে সেটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, গাছপালা এনে রাখা হয়। এখনো অব্দি লাইব্রেরির সদর দরজার সামনে ২৪ ঘন্টা যুক্তরাষ্ট্রের একটু আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার গাড়ি নিয়োজিত থাকে।

একদিকে কানাডা, অন্যদিকে আমেরিকা; Source: Architectural Digest

এখন আমেরিকা আর কানাডার এই বর্ডার পেরিয়ে যাওয়াটা একটু চিন্তার ব্যাপার, যেটা মানসিকভাবে নেওয়া অনেকের জন্যেই হয়ে পড়েছে কষ্টকর। শুরু থেকে গ্রন্থাগারের সীমানাকে সীমানা না মনে করা মানুষগুলো আজ পর্যন্ত নিজেদের স্মৃতি ভুলতে পারেননি। তাদের স্মৃতিতে আজও অমলিন হয়ে আছে ভয়হীন মনে সীমানা পার হওয়া, অন্য দেশের মানুষগুলোকেও নিজের কাছের মানুষ বলে মনে করার মত ঘটনাগুলো। আমেরিকান কিংবা কানাডিয়ান- কে কোন দেশের সেটা মনেই ছিল না সেসময় তাদের। এখন তাদের জন্য এই লাইব্রেরিই হয়ে আছে একমাত্র স্থান যেখানে ঠিক আগের মত করে, নিজের পরিচিতদের সাথে দেখা করতে পারেন তারা। নিজেদের মত করে কিছু সময় কাটাতে পারেন। ডার্বি লাইনের বাসিন্দা বাজি রয়ের ওষুধের দোকান পড়ে গেছে একেবারে বর্ডারের মধ্যখানে। না ক্রেতা, না বিক্রেতা- কেউই ঠিক জানেন না আসলে কোথায় কেনাবেচা করছেন তারা। এমন কড়াকড়ির দরকার ছিল না বলে মনে করেন বাজি। তবে বাজি মনে না করলেও বাস্তবে নানা রকম মাদক চোরাচালানের মতন কর্মকান্ড ঘটছে এই সীমারেখার মধ্য দিয়ে। সচেতনতা আর যথাযথ পদক্ষেপ নেয়াটা প্রয়োজন। তবে অনেকে ভয় পাচ্ছেন, বর্তমান এই অবস্থায় এতদিনের গ্রন্থাগারটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আসলেই কি তাই? সেটা হতেই পারে। তবে বিনা যুদ্ধে হাসকেল পরিবারের এই নির্মাণকে বন্ধ হতে দেবে না কেউ। কানাডা এবং আমেরিকা- সীমানার দুই পাশের মানুষই সেটা খুব ভালো করে জানে।

ফিচার ইমেজ- BBC

Related Articles

Exit mobile version