১৮১৯ সাল। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। সে সুযোগে বিভিন্ন ব্রিটিশ বণিক, কর্মকর্তা ও পর্যটক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রোমাঞ্চকর অভিযাত্রায় বের হতেন। যেমনটি বের হয়েছিলেন তরুণ ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা জন স্মিথ।
জঙ্গলে-ঘেরা অজন্তা গুহা তখন মাটির নিচে অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে। সামান্য যে অংশটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটিকে ঘিরে ছিল বাঘদের বসবাস। আর ভাগ্যক্রমে বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছিলেন এই ইংরেজ কর্মকর্তা ও তার দল।
বাঘের পিছু ছুটতে ছুটতে হঠাৎ তিনি গুহাটির একটি সঙ্কুচিত প্রবেশমুখের সন্ধান পেয়ে যান। এর অভ্যন্তরে ছিল অসংখ্য বাঘের বসবাস। কিন্তু গুহাটির অবস্থা দেখে বাঘ শিকার করা তার আর মুখ্য উদ্দেশ্য থাকল না, স্বয়ং গুহাটিই হয়ে উঠল তার আগ্রহের প্রধান বিষয়। আবিষ্কারের নেশা চেপে বসল তার মাথায়।
এরপর তার নেতৃত্বেই মাটি খুঁড়ে উদ্ধার করা হয় সুউচ্চ-দেয়ালসমৃদ্ধ সেই অজন্তা গুহার। গুহার অভ্যন্তরে রয়েছে ৩০টি পাথুরে গুহা মন্দির ও মঠ। এছাড়াও সেখানে রয়েছে অসংখ্য গুহাচিত্র, মূর্তি ও দেয়াললিখন। এতে বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পের উৎকৃষ্ট নমুনা ফুটে ওঠে। প্রাচীনকালের অন্য কোনো স্থাপনায় এর চেয়ে উন্নত ও শৈল্পিক বৌদ্ধধর্মীয় শিল্পকলার সন্ধান মেলেনি।
ভারতের মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ শহর থেকে প্রায় ১০২ কিলোমিটার উত্তরে এবং মুম্বাই শহর থেকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার পূর্বে অজন্তা নামক স্থানে এই ঐতিহাসিক গুহাটি অবস্থিত। ওয়াঘোরা নদীর তীরে ২২ মিটার উঁচু গিরিসঙ্কটের অভ্যন্তরে গ্রানাইট পাথরে গঠিত ফাঁপা প্রাকৃতিক গুহার অভ্যন্তরে পাথর কেটে নির্মাণ করা হয়েছে এই মন্দিরগুলো।
ঠিক কত আগে এই গুহার মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল- তা নিয়ে গবেষকগণ সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করতে পারেননি। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এই মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর দেয়ালচিত্র ও নানা শিল্পকর্মের ওপর গবেষণা করে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ মন্দিরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল।
৬৫০ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী ইলোরা গুহার অনুকূলে এই গুহাটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়লে প্রায় ১২০০ বছর যাবত এটি অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে সেখানে বাসা বাঁধতে থাকে নানা বন্য প্রাণী ও কিট-পতঙ্গ। জন্মাতে থাকে নাম জানা-অজানা উদ্ভিদ। বন্যা ও প্লাবনে ক্রমশ মাটির নিচে চলে যেতে থাকে গুহার অবকাঠামো।
সেই থেকেই বাঘের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে এই অগভীর জঙ্গল। যদিও সেখানে ভিল নামক ছোট্ট একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করতে, কিন্তু তারা ছিল বন্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত। উল্লেখ্য, অজন্তার ঠিক ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ইলোরা গুহাটি অবস্থিত। এটিও ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধধর্মীয় নিদর্শন।
স্মিথের এই ঐতিহাসিক আবিষ্কারের সুখ্যাতি দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গবেষকগণ একে ভারতের ইতিহাস পুনর্বেবিচনাকারী মাইলফলক হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। কেননা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণলিপিতে এই অজন্তা গুহার কথা বর্ণিত আছে; যা দীর্ঘকাল যাবত গবেষকদের সামনে অনুপস্থিত ছিল।
এরপর ১৮৪৪ সালে মেজর জেনারেল রবার্ট গিলের উদ্যোগে রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি গুহার অভ্যন্তরে বিরাজমান দেয়াল চিত্রগুলোকে পুনরুজ্জীবিত ও অনুলিপি তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাদের অনুসন্ধানেই একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত। এতে দেখা যায়, মন্দিরগুলো মূলত দু ভাগে বিভক্ত ছিল- চৈত্য এবং বিহার।
চৈত্য হলো ছোট্ট ছোট্ট থাকার জায়গা বা সন্ন্যাসীদের বাসগৃহ। আর বিহার হলো মঠ বা প্রার্থনালয়। এর মধ্যে পাঁচটি চৈত্য (কক্ষ নম্বর ৯, ১০, ১৯, ২৬ ও ২৯) এবং বাকি ২৫টি বিহার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এসব চৈত্যে প্রায় দু’শো সন্ন্যাসী বসবাস করতেন বলে ধারণা করা হয়।
এর বাইরে নির্মাণের দিক থেকেও কক্ষগুলো দু ভাগে বিভক্ত। প্রথম ধাপে দুটি চৈত্য (কক্ষ নম্বর ৯ ও ১০) এবং চারটি বিহার (কক্ষ নম্বর ৮, ১২, ১৩ ও ১৫) নির্মিত হয়। এগুলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মিত হয়। বাকি ২৫টি কক্ষ ৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মাণ করা হয়।
গুহার অভ্যন্তরের দেয়ালচিত্রগুলোতে গৌতম বুদ্ধের জীবনী এবং সংশ্লিষ্ট নানা কাহিনী অঙ্কিত আছে। এছাড়া ষষ্ঠ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের যেসকল রাজপুত্র সেখানে দীক্ষা লাভ করতে এসেছিলেন, তাদের জীবনীও সেখানে অঙ্কিত রয়েছে। এসব জীবনী ইতিহাসবিদদের নতুন সূত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এছাড়া সেখানে বিভিন্ন প্রাণী, স্থান, সিল্ক, জুয়েলারি ও প্রেমের দৃশ্য অঙ্কিত রয়েছে। মূলত বিহারগুলোকে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়, যেখানে আগত ছাত্রদের শিক্ষাপ্রদান করতেন বিহারের সন্ন্যাসীগণ।
অবাক করবার মতো একটি বিষয় হলো, গুহার অভ্যন্তরে পাওয়া অনেক দেয়ালচিত্রে গ্রিক শিল্পকলার সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়! ইতিহাসবেত্তাগণ এটিকে কাকতাল মানতে নারাজ। বরং এটিকে তারা দেখতে চান প্রাচীন গ্রিক-ভারতীয় সংস্কৃতির সম্বন্ধ হিসেবে।
এই ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এসব দেয়ালচিত্রে। এ সূত্র ধরেই অনেক গবেষক মনে করেন, প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও অন্যান্য বিদ্যা চর্চাতেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য গ্রিক প্রভাব।
১৮৬৬ সালে দক্ষিণ লন্ডনের সিডেনহামে একটি চিত্র প্রদর্শনীতে অজন্তা গুহার ২৭টি দুর্লভ দেয়ালচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল, যেগুলো ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন রবার্ট গিল। কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় মহামূল্য সেই চিত্রগুলো। এরপর গিল পুনরায় ক্যামেরা নিয়ে অজন্তা গুহার চিত্র ধারণের কাজে নেমে পড়েন। এরপর আরও অনেকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অজন্তা গুহার গবেষণা কর্মে নিযুক্ত হন।
এদিকে ‘রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি’র সহায়তায় ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রয়েল কেইভ টেম্পল কমিশন’। এই কমিশনের তত্ত্বাবধানে ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া’ নামের আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রধান কাজ ছিল অজন্তা গুহা নিয়ে অধিকতর গবেষণা করা।
এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয় তৎকালীন ভারতবর্ষ ও ব্রিটেনের কয়েকজন অভিজ্ঞ গবেষককে। তাদের গবেষণা ও অনুসন্ধানে উদ্ধারকৃত কয়েকটি দেয়ালচিত্র এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন মিউজিয়াম অভ ফাইন আর্টস-এ সংরক্ষিত আছে।
উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ১৮৭২ সালে মুম্বাই স্কুল অভ আর্টস এর অধ্যক্ষ জন গ্রিফস ও তার ছাত্ররা মিলে অজন্তা গুহা থেকে প্রায় ৩০০ দেয়ালচিত্র আবিষ্কার ও পুনর্জীবিত করেন। এগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছিল লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ইনস্টিটিউটে। কিন্তু ১৮৮৫ সালের এক অগ্নিকাণ্ডে চিত্রগুলোর প্রায় তিনভাগের এক ভাগ পুড়ে যায়। ফের অজন্তা গুহার গুরুত্বপূর্ণ দলিল আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে বিলীন হয় অগ্নিশিখায়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালে কলকাতা স্কুল অভ আর্টসের সহায়তায় লেডি হেরিংহাম অজন্তা গুহায় গবেষণা করতে শুরু করেন এবং পুনরায় দেয়ালচিত্রগুলোর অনুলিপি তৈরি করতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে ১৯২০ সালে ভারতীয় ইতিহাসবিদ গোলাম ইয়াজদানিও সেখানে গবেষণা শুরু করেন এবং তিনি এটিকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যান। ১৯৩০ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে চার খণ্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি বর্ণনা সহকারে অজন্তা গুহার চিত্রগুলোকে তুলে ধরেন।
১৯৮৩ সালে অজন্তা গুহা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হয়। এরপর সারা বিশ্ব থেকে অসংখ্য পর্যটক সেখানে আসতে শুরু করেন। ভারতের ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহের মধ্যে তাজমহলের পর অজন্তা গুহাতেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যটকের সমাগম ঘটে বলে মনে করা হয়।
সম্প্রতি অজন্তা গুহার আশেপাশে চারটি নকল গুহা গড়ে তোলা হয়েছে। পর্যটকদের ভুল বুঝিয়ে সেখানে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করাই এদের মূল লক্ষ্য। তবে তাদের এই কার্যক্রম খুব একটা সফলতা পায়নি। পর্যটকগণ ঠিকই আসল অজন্তা গুহা খুঁজে নিচ্ছেন।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/