মাস দুয়েক আগের কথা। ট্রাভেলিং নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে কিছু বিখ্যাত উক্তির খোঁজে গুগল করলাম। একটা উক্তি দেখে থমকে গেলাম। Heaven is a myth, Nepal is real. না কোনো বিখ্যাত মানুষের উক্তি নয়, নেপালের একটি প্রচলিত কথা। সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের কাছের এই স্বর্গটা না দেখলেই নয়। ঘাটাঘাটি করে পেয়ে গেলাম ‘অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং’। এমনিতে পাহাড় পাগল মানুষ। তার উপর হিমালয়ের বিখ্যাত এই রেঞ্জে ট্রেকিং এর সুযোগ। আর পায় কে! ১৪ই মে ইউএস বাংলার একটা ফ্লাইটে রওনা দিলাম মর্তের স্বর্গ দেখার আশায়।
অন্নপূর্ণা রেঞ্জ নিয়ে কিছু কথা বলি। প্রায় ২৬,৫০০ ফুট উচ্চতার অন্নপূর্ণা ১ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর পর্বত। আর উচ্চতার দিক থেকে পৃথিবীর দশম। এখানে সামিট করতে গিয়ে মৃত্যুর হার প্রায় ৩৪%। ২য় অবস্থানে আছে k2, মৃত্যুর হার ২৯%। আর এভারেস্টে তা ৬.৫%। ১৯৫০ সালে প্রথমবারের মতো অন্নপূর্ণা ১ জয়ের পর ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৯১ জন অভিযাত্রী এই পর্বতের শিখরে উঠার চেষ্টা করেন। তার মধ্যে ৬১ জনই মারা যান। আর এই ভয়াবহ পর্বতকে ঘিরেই মানুষের তুমুল আগ্রহে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত অন্নপুর্ণা সার্কিট ট্রেকিং, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং। আমার যাত্রা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১৩৫৪৯ ফুট।
যাই হোক, ১৪-১৯ ই মে সপ্তাহখানেক কাঠমুন্ডুতে কাটানোর পর এলো সেই বহুল প্রতিক্ষিত অন্নপূর্ণা সফর। ১৯ মে সকাল, কাঠমুন্ডু থেকে ট্যুরিস্ট বাসে করে রওনা দিলাম পোখরার উদ্দেশ্যে। প্রায় ২০০ কিলোমিটারের পথ ৬ ঘন্টায় পাড়ি দেয়ার কথা থাকলেও আমাদের লেগে গেল ১২ ঘন্টা। প্ল্যান ছিল ১ম দিনেই জিপে করে কাদে’তে গিয়ে সেখান থেকে ২-৩ ঘন্টার ট্রেকিং করে পোথানায় রাত কাটানো। কিন্তু পোখরায় পৌছতে পৌছতেই সন্ধ্যা। অগত্যা রাত কাটাতে হলো পোখরাতেই।
যাই হোক মন্দ কাটলো না পোখরার রাত। ব্যাকপ্যাক হোটেলে ফেলেই চলে এলাম নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ ফিউয়ার ধারে। ফিউয়ার স্বচ্ছ পানিতে শত শত নৌকা, আর মৃদু টলমলে পানিতে রহস্যময়ী মাচাপুচারে পর্বতের প্রতিচ্ছবি, স্বপ্নের মতো লাগছিল।
লেকের দু’পাশেই সারি সারি রেস্টুরেন্ট, বার, বাহারি পণ্যের দোকান। পুরো এলাকাটাই সাজানো হয়েছে পর্যটকদের জন্য। নেপালের কুটির শিল্প থেকে শুরু করে বিখ্যাত সব জার্মান বিয়ার সবকিছুই মেলে এখানে। ভালো কথা, নেপালে কখনো এলে পোখরায় আসতে ভুলবেন না। খালি চোখে নয়নাভিরাম অন্নপূর্ণা রেঞ্জ দেখা, লেকের ওপারে জাপানীদের বানানো পবিত্র পিচ প্যাগোড়া, আর বাঙ্গিজাম্প, প্যারাগ্লাইডিং, স্কাইডাইভিং এর মতো এক্টিভিটির জন্য পোখরার কোনো তুলনা নেই।
তো পরদিন ভোরে ভোরেই হাজির হলো জিপ। দলে আমরা তিনজন। আমার রাশিয়ান বন্ধু সাশা, আমি আর আমাদের গাইড রামু। আগের দিনের ২ ঘন্টার জিপ জার্নি আর ৩-৪ ঘন্টার ট্রেকিং পুষিয়ে নিতে আমরা সরাসরি চলে এলাম গান্দরুকে। ঘন্টা চারেক জিপ জার্নির পর শুরু হলো ট্রেকিং। পাহাড়ের গা বেয়ে চলা বিশাল রাস্তা ছেড়ে মিনিট বিশেক বাদেই আমরা ঢুকে পড়লাম নয়নাভিরাম এই গ্রামে।
এরকম হাজারো দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় মনে হলো বেশ ক্ষুধার্ত। দুপুরের খাবার জরুরি। সামনেই মিললো একটা টি হাউজ। নামে টি হাউজ হলেও কাজে সব। লাঞ্চ, ডিনার, চা থেকে শুরু করে রাতে থাকার ব্যবস্থা, বিয়ার, ওয়াই ফাই সবই আছে এখানে। টি হাউজের মালিক এসে মেন্যু দিয়ে গেলেন। মেন্যু দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। পৃথিবীর হেন ডিশ নেই এখানে পাওয়া যায় না! ডাল-ভাত থেকে শুরু করে নেপালের বিখ্যাত মোমো, পিজা, পাস্তা, স্যুপ কী নেই। বাঙালি বলে কথা, সব রেখে নিলাম ডাল-ভাত, নেপালি ডিশ। একটা বিশাল থালার মাঝে বিভিন্ন রকমের সবজি, আলু, বাঁশ, ডাল ইত্যাদি।
আবার শুরু হাঁটা। ঘন্টাখানেক হেঁটেই বিশ্রাম। এক চুমুক চা কিংবা পানি। কিছুক্ষণ ফটোসেশন, গল্প-গুজব, জীবনের কথা, গাইডের হাঁক এসবের মধ্যে দিয়েই কেটে গেল ট্রেকিং এর প্রথম দিন।
রাতে উঠলাম আরেকটা টি হাউজে। নাম মনে নেই। রুমের একপাশে পুরো দেয়ালজুড়ে স্বচ্ছ কাঁচ। কাঁচের ওপাশে সারি সারি পাহাড়। উপরে টিনের চাল, আর তাতে রাতভর বৃষ্টির শব্দ। সবমিলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাগছিল। ঘুমানোর ঠিক আগে মনে হলো ফেসবুকে তো কিছু ছবি দিতে হয়। মোবাইল নেটওয়ার্কের বেহাল দশা দেখে খোঁজ নিলাম ওয়াই ফাই আছে কিনা। পাওয়া গেল, কিন্তু প্রতি ডিভাইস ১০০ নেপালি রুপি! অগত্যা উপায় না দেখে রাজি হয়ে গেলাম। টি হাউজের ম্যানেজারের কাছ থেকে ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিয়ে ফেসবুকে ঢুকেই শুনি বজ্রপাতের বিকট শব্দ। জীবনের দর্শন নিয়ে আবেগময় বিশাল একটা স্ট্যাটাস লিখে পোস্ট করতে গিয়ে দেখি আর পোস্ট হয় না। পাশে দাঁড়ানো ম্যানেজার নির্মম এক হাসি দিয়ে বললো আজ আর ইন্টারনেট হবে না। কেন কেন! অদূরে ডিশ অ্যান্টেনা দেখিয়ে ভদ্রলোক বললেন বজ্রের আঘাতে অ্যান্টেনা নষ্ট হয়ে গেছে। এটা নাকি এখানকার নৈমিত্তিক ঘটনা। স্যাটালাইট থেকে বীম করে ডিশ অ্যান্টেনায় আসে ইন্টারনেট। মাঝে মাঝে অনাকাঙ্খিত এই ইলেক্ট্রনের স্রোতও!
এমনিতে সারা রাত জেগে সকালে ঘুমানোর অভ্যাস। তার উপর নাই ইন্টারনেট! তো কী আর করা, সাশার সাথে গল্পগুজব করে আর জীবনের অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে করতে কেটে গেল রাত। ঘুম ভাঙ্গলো সাশার চিৎকারে। দরজা খুলতেই তার হুঙ্কার – ‘আবদুল্লাহ! সকাল ৭ টা বাজে। সেই কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি, এখনো ঘুমাচ্ছো কেন! সকালের নাস্তা রেডি।’ আপনারাই বলেন, চীনে বসবাসকারী রাশিয়ান মেয়ের সাথে এই বাঙালি কি আর সময় মেপে চলতে পারে! কী আর করা, ৫ মিনিটেই রেডি হয়ে ছুটলাম ক্যান্টিনে। সকালের নাস্তার মেন্যু নিয়ে আসলো আমাদের গাইড রামু। ভাবলাম তাওয়ায় গরম রুটির সাথে জম্পেশ সবজি ভাজা আর ডাল হবে। কিন্তু কীসের কী! ডিম আর পাউরুটি ছাড়া কিছুই পেলাম না! কোনো মতে এসব পেটে চালান করে বের হতেই রামু একটা বিলের কাগজ নিয়ে আসলো।
- গোসল – ১০০ রুপি
- পানি – ২০০ রুপি
- ইন্টারনেট – ১০০ রুপি!
সর্বনাশ, মনে মনে কইলাম, সারারাত এতবার ১ নম্বর, ২ নম্বর করলাম, এসবের বিল নাই! এসব বাদ রাখলেন ক্যা! সাশারও একই অবস্থা। আমি চুপ থাকলেও সে জানতে চাইলো এরকম কেন? ম্যানেজার বুঝিয়ে বললেন। এখানে খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু পোর্টাররা মাথায় করে নিয়ে আসেন। যে গরম পানি দিয়ে গোসল করলাম তা গরম করার জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে শুরু করে সবকিছু। তাই সবকিছুর দামই একটু বাড়তি। আর এসব সরকার থেকেই নির্দিষ্ট করা। আরো সাবধান করে বললেন যতই উপরে যাবেন ততই এই দাম বাড়তে থাকবে!
এবার আগ্রহভরে রামুকে জিজ্ঞেস করলাম, খাবারের বিল কেমন। এখানে উল্লেখ্য, যে ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যেমে আমরা বেস ক্যাম্পে যাচ্ছি তারাই সব খাবার ও থাকার বিল দিচ্ছে। ওদেরকে আমরা এককালীন টাকা দিয়েছিলাম। যাই হোক রামুর লিস্ট দেখে চক্ষু চড়ক গাছ।
- ১টি ডিম – ২০০ রুপি
- ২ পিস পাউরুটি – ১৫০ রুপি
- চা – ১০০ রুপি
- ডাল-ভাত – ৭০০ রুপি
- মোমো – ৭০০ রুপি
বুঝেন অবস্থা। ৩ বেলা চা, লাঞ্চ আর ডিনারের দায়িত্ব রামুর। সাধে কি আর ৭ দিনের এই ট্রেকিং এর খরচ ৩২০০০ টাকা!
টাকা পয়সার হিসেব নিয়ে আর মাথা নষ্ট না করে শুরু করে দিলাম ২য় দিনের ট্রেকিং। টানা হাঁটলাম ঘন্টা তিনেক। দুইটা বিশাল পাহাড় চড়াই উৎরাই করে যখনই ক্লান্তির শেষ সীমায় তখনই চোখে পড়লো এই দৃশ্য।
পৌছে গেলাম ঝিনুডানায়। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৭৬৬০ ফুট উচ্চতা থেকে প্রথমবারের মতো দেখলাম পরাক্রমশালী অন্নপূর্ণার সৌন্দর্য। এক কাপ চা, মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কিছুক্ষণ ফেসবুকিং আর এই অভাবনীয় সৌন্দর্য দেখে কাটিয়ে দিলাম ঘন্টাখানেক।
আবার যাত্রা শুরু। আবার হাঁটা। কখনো ঝড়ো হাওয়া, কখনো তুমুল বৃষ্টিতে সাবধানে পা টিপে টিপে হাঁটা। ঘোড়া, মহিষ, মানুষ, গ্রাম্য বৃদ্ধা, জুম চাষি নারীর কোলে বাচ্চার কান্না এসব দেখতে দেখতেই কেটে গেল আরেকটি দিন।
এভাবে ঝিনুডানা থেকে চমনং, চমনং থেকে বাম্বু, বাম্বু থেকে দিউরালি, দিউরালি থেকে মাচাপুচারে বেস ক্যাম্প (MBC), এবং অবশেষে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে (ABC) পৌছলাম আমরা। ঝিনুডানা থেকে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত পৌছতে সময় লাগলো আরো দুইদিন। এরই মাঝে পরিচিত হলাম কত মানুষের সাথে! সুদূর ফ্রান্স থেকে আসা ৫ বন্ধু, জার্মানির এক কাপল, কোরিয়ান দুই কলিগ, চীনা এক পরিবার। কত মানুষের কত স্বপ্ন, কত কথা! আর এরই মাঝে আমার বিভিন্ন ধরনের কার্ড খেলা রপ্ত করা। আফসোস একটাই, আমার দেশি টুয়েন্টি নাইন আর কাউরে শিখাইতে পারলাম না। এটা নাকি একটু বেশি কঠিন!
এরপর আর কী! যেখানে ৪ দিনে উঠলাম বেস ক্যাম্পে, সেখানে ২ দিনে নেমে চলে আসলাম পোখরায়। মাঝে ঝিনুডানায় ন্যাচারাল হট স্প্রিং এ গোসল, শাওলি বাজারে জীবনের সবচেয়ে তুমুল বর্ষণে ভেজা সবমিলিয়ে সারাজীবন মনে রাখার মতো একটা ভ্রমণ শেষ হলো। দেখলাম প্রকৃতি, দেখলাম মানুষ। জীবনটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে শিখলাম। সত্যিই যে মানুষটা ঘর ছেড়ে ঐ পাহাড়ে যায় সে মানুষটা আর থাকে না। জীবনটাকে আরো বৃহত্তর পটভূমিতে দেখার শিক্ষা নিয়ে তীব্র আকুলতায় ঘরে ফেরে সে। আরো নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে শেখে ঘরে ফেলে যাওয়া আপনজনকে।
আপনিও শুরু করুন। যখনই সময় পান, ঘুরে আসুন পাহাড়ে। আর কিছু না হোক ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুকে বন্ধুদের হিংসায় ফেলার জন্য হলেও ঘুরুন! আর ভালো কথা, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং এ আমার সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০,০০০ টাকার মতো। ১৬,০০০ টাকা ঢাকা-কাঠমুন্ডু আসা যাওয়ার বিমান ভাড়া আর ৩২,০০০ টাকা ৭ দিনের ট্রেকিং এর সম্পূর্ণ খরচ। বাড়তি ১ সপ্তাহ কাঠমুন্ডু ছিলাম বলে আরো ২০,০০০ টাকা খরচ হয়েছে। তবে আপনি নিজেও গাইড-পোর্টার নিয়ে যেতে পারেন এই ট্রেকিং এ। সেক্ষেত্রে খরচ আরো ১০,০০০ টাকা কম পড়তে পারে। মোটামুটি ফিটনেস আছে এমন যে কেউই যেতে পারবেন এই ট্রেকিং এ। তবে কেওক্রাডং, সাফা হাকং এর মতো বাংলাদেশের দুয়েকটা পর্বতে আগে উঠার অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো। তো এ নিয়ে যদি আরো বিস্তারিত জানার ইচ্ছা থাকে কিংবা আমার তোলা ছবিগুলো হাই রেজ্যুলেশনে নেয়ার ইচ্ছে থাকে আমাকে ফেসবুকে নক দিতে পারেন কিংবা মেইল করতে পারেন (abdullah@roarmedia.net)। ভালো থাকবেন।