সুলতানি আমলের স্থাপত্য রীতির অনুকরণে নির্মিত চমৎকার এক স্থাপনা বায়তুর রউফ মসজিদ। এটি রাজধানী ঢাকার আব্দুল্লাপুর থেকে কিছুটা ভেতরে অবস্থিত। এ মসজিদের গঠন ও নকশা অন্য যেকোনো মসজিদের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। প্রাকৃতিক উপায়ে মসজিদের ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য মসজিদটিকে দেওয়া হয়েছে এক বিশেষ নকশা। আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য মসজিদের ছাদে বিভিন্ন জায়গায় করা হয়েছে ছোট ছোট বৃত্তাকার নকশা। ফলে সূর্যের আলো সরাসরি ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় এখানে।
তাছাড়াও মসজিদের অভ্যন্তরে চারপাশে রয়েছে খোলা আকাশের ব্যবস্থা, যা মসজিদটিকে প্রাণবন্ত করেছে। এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে ব্যয় হয়েছে দেড় লক্ষ মার্কিন ডলার। এ মসজিদের জমির মালিক সুফিয়া খাতুন। মুসল্লিদের নামাজ পড়ার সুবিধার্থে মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি এই জায়গাটি ওয়াকফ (দান) করেন। তার দানকৃত ৭৫৪ বর্গমিটার জমির উপর ২০১২ সালে নির্মাণ করা হয় মসজিদটি।
যদিও এই মসজিদটির সূচনার ইতিহাস খুবই স্বল্প, তবে নির্মাণের পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এটি নজর কেড়েছে সবার। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই দেখতে আসেন এই মসজিদটি। মাঝে মাঝে বিদেশি পর্যটকের আনাগোনাও লক্ষ করা যায় এখানে। ২০১৬ সালে ‘আগা খান আওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’ পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে স্থাপত্যের জগতে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে এ মসজিদটি। এর বাজার মূল্য ১০ লাখ মার্কিন ডলার। বায়তুর রউফ মসজিদের স্থপতি হিসেবে মেরিনা তাবাসসুম গ্রহণ করেছিলেন সম্মানসূচক এই পুরস্কারটি।
এর আগে বাংলাদেশি স্থপতিরা বেশ কয়েকবার এ পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলেও পুরস্কার পাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ইতোপূর্বে বাংলাদেশের মোট তিনটি স্থাপত্যকর্ম এই পুরস্কার অর্জনে সক্ষম হয়েছিল, তবে সেগুলোর স্থপতি ছিলেন বিদেশিরা। বায়তুর রউফ মসজিদের সম্মানসূচক এ অর্জন মসজিদের পরিচিতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো বহুগুণে।
এ মসজিদের প্রকৃত নাম বায়তুর রউফ হলেও অনেকেই একে লাল মসজিদ কিংবা ইটের মসজিদ নামেও চেনেন। কারণ, লাল ইটের চমকপ্রদ আবরণেই ঢাকা গোটা মসজিদটি। বাইরে থেকে সরাসরি ভেতরে প্রবেশের জন্য এ মসজিদে রয়েছে তিনটি দরজা। কালো রঙের সুউচ্চ এই দরজা তিনটিও মসজিদের এক অন্যতম আকর্ষণ। তাছাড়াও মসজিদের অভ্যন্তরের ঝুলন্ত বাতি ও পাখাগুলোও নজর কাড়ে নতুন মুসল্লিদের।
মসজিদটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে সব মৌসুমেই এর ভেতরের তাপমাত্রা থাকবে প্রায় একইরকম। মসজিদের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম বলেন,
“মসজিদটি তৈরি হয়েছে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। প্রচলিত মসজিদগুলোর ধরন থেকে আলাদা। আর মসজিদটি নির্মিত হয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে, অংশগ্রহণমূলক ধারণা থেকে। খরচও এসেছে সবার কাছ থেকে। পরিবেশবান্ধব এবং আলো-বাতাসের বিষয়টি মাথায় রেখে এর ডিজাইন করেছি। ইতিহাস, সংস্কৃতি, আবহাওয়াসহ নানা বিষয় মাথায় রেখে এর নির্মাণ করা হয়েছে। আর ব্যবহৃত সব উপকরণই স্থানীয়।”
কীভাবে যাবেন
যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে টঙ্গী আব্দুল্লাপুর বাস্ট্যান্ডে আসতে হবে। সেখানে খন্দকার সিএনজি পাম্প সংলগ্ন পুলিশ চেকপোস্টের পাশ থেকে লেগুনা কিংবা রিকশায় চড়ে যেতে পারবেন এই মসজিদে। এক্ষেত্রে রিকশা চালককে বলতে হবে, ফায়দাবাদ ট্রান্সমিটার মোড়ের কথা। ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা, আর ব্যাটারি চালিত অটোতে গেলে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১০ টাকা। তারপর ফায়দাবাদ ট্রান্সমিটার মোড়ে নেমে হাতের বাম পাশের ভেতরের রাস্তা ধরে এক মিনিট হাঁটলেই দেখা পেয়ে যাবেন দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের।
নিকটস্থ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও জুড়ে দেওয়া হলো, আগ্রহী পাঠক ও পর্যটকদের জন্য।
টঙ্গী নদী বন্দর
বায়তুর রউফ মসজিদের অতি নিকটে একটি নদী বন্দর রয়েছে। মসজিদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পশ্চিম পাশের রাস্তা ধরে যেতে পারবেন সেখানে। দেখার মতো তেমন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা ঐতিহাসিক নিদর্শন যদিও নেই, তবে রয়েছে গ্রামীণ পরিবেশের এক ক্ষুদ্র ছোঁয়া।
বন্দর থেকে হাতের ডানে চলে যাওয়া সরু কৃত্রিম পথের উপর থেকে উপলব্ধি করা যায় এ সমস্ত চিত্র। দেখা মেলে বিস্তৃত ফসলি জমি আর অপর পাশে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদীর। যদিও এ নদীর পানি প্রচণ্ড কালো, বিষাক্ত ও দুর্গন্ধময়, তবে বর্ষা মৌসুমে পাল্টে যায় নদীর চিত্র। এ সময় বৃষ্টির কারণে পানির স্বচ্ছ প্রবাহ বেড়ে যায় নদীতে, তবে তা কখনোই পান করার উপযুক্ত নয়।
তেরমুখ ব্রিজ
নদী বন্দর ব্যতীত অন্য কোথাও ঘুরতে চাইলে যেতে পারেন তেরমুখ ব্রিজ। সেখানেও প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ মিলবে। কংক্রিটের এই শহরে প্রকৃতিকে খোঁজার প্রয়াসে অনেকেই এখানে ভিড় জমান ছুটির দিনগুলোতে। প্রকৃতিপ্রেমী পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের কাছে এটিই যেন একমাত্র প্রাকৃতিক ঠিকানা।
এই ব্রিজে মূলত দু’ভাবে যাতায়াত করা যায়। এক হলো, আব্দুল্লাহপুর টু আটিপাড়া রোডে; আর দুই হলো, তেরমুখ ব্রিজের ওপাশ থেকে আসা উলুখোলা রোডে। আব্দুল্লাহপুর টু আটিপাড়া রোডে এই ব্রিজে আসার ক্ষেত্রে আব্দুল্লাহপুর থেকে সরাসরি যেকোনো রিকশা বা লেগুনায় চড়ে সহজেই চলে আসতে পারবেন। তাছাড়া বায়তুর রউফ মসজিদ থেকে ট্রান্সমিটার মোড়ে এসেও বিভিন্ন ব্যাটারিচালিত অটো, রিকশা বা লেগুনা পেয়ে যাবেন, যেগুলো তেরমুখ ব্রিজ পর্যন্ত যাবে। তবে সব ব্যাটারিচালিত অটো আবার সে পর্যন্ত যায় না, তাই যাওয়ার আগে জেনে নিশ্চিত করে নেওয়াই ভালো হবে।
সতর্কতা ও পরামর্শ
১. সন্ধ্যায় নদী বন্দর এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। একইসাথে নদী বন্দর থেকে নদী পারাপার হয়ে ওপারে না যাওয়াই উত্তম। কারণ, নদীর ওপারে এলাকাগুলো খুব বেশি নিরাপদ নয়। তাছাড়া, সেখানে দেখার মতোও কিছুই নেই।
২. সন্ধ্যার পর নদী বন্দরের পাশাপাশি তেরমুখ ব্রিজ যাওয়া থেকেও বিরত থাকুন। কেননা অন্ধকার নামার পর এই এলাকায় নির্জনতা বিরাজ করে। সন্ধ্যার পর সাধারণত তেমন কাউকেই এখানে ঘুরতে দেখা যায় না।
৩. নদী বন্দর কিংবা তেরমুখ ব্রিজ ঘুরতে যাওয়ার সঠিক সময় বর্ষাকাল। এ সময় প্রকৃতি নির্মল থাকায় অনেক মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে।
৪. এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে যথাসম্ভব ভালো আচরণ করুন এবং পরামর্শগুলো সঠিকভাবে মেনে চলুন। আশা করি উক্ত নির্দেশনাগুলো আপনার সাফল্যময় ভ্রমণের সহায়ক হবে।