প্যারিস ভালোবাসার শহর নামে সারা বিশ্বে পরিচিত । প্রতি বছর বিশ্ব সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল প্যারিসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৮৪ মিলিয়ন ভালবাসা পিপাসু ছুটে যান। তবে প্যারিসে ঢুকেই পর্যটকরা যে বিষয়টি দেখে অবাক হন সেটি হলো রেলস্টেশন, এয়ারপোর্ট এ থাকা স্ট্রিট পিয়ানোর সমাহার। যেখানে যে যার ইচ্ছা মতো পিয়ানোতে কিছু একটা বাজাবেন। এই প্রজেক্টের কেতাবি নাম “Play me I’m yours”। যেন হাত বাড়িয়ে পিয়ানোগুলো আপনাকে ডাকছে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেবার জন্যে।
এই প্যারিস মূলত ফ্রান্সের রাজধানী। ২২ লক্ষ বাসিন্দার এই শহরের আয়তন ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। পুরো ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশের বাস এই শহরে। যার কারণে প্যারিস ইউরোপীয় ইউনিয়নে জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় শহর। আর এই কারণেই বোধহয় শুধু ফ্রান্স না, পুরো পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক বড় অংশকে লালন করে এই শহর।
প্যারিসের প্রতীক ‘আইফেল টাওয়ার’ থেকে একপলক ফেললেই চোখে পড়বে রূপকথার মোনালিসার ‘ল্যুভর মিউজিয়াম’, ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন ‘নটর ডেম ক্যাথেড্রাল’, নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস খচিত তোরণ ‘আর্ক ডে ট্র্যেম্ফে (Arc de Triomphe)’ সহ আর অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী স্থান। তবে দর্শক যে ব্যাপারটি দেখে সবচেয়ে অবাক হবেন সেটি হলো একটি “স্ট্যাচু অফ লিবার্টি”। প্যারিসের বুক চিরে বয়ে চলা সিন নদীতে তৈরী করা কৃত্রিম দ্বীপে এটি স্থাপন করা হয়েছে ১৮৮৯ সালে। পুরো ফ্রান্স জুড়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রায় ৯টি রেপ্লিকা আছে। মূলত একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে প্যারিসে থাকা এই সবকয়টি ঐতিহাসিক স্থান পরিণত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ পর্যটক গন্তব্যে। ইতিহাস বিখ্যাত এই প্যারিস এখনো আলোক ঝলমলে ভালোবাসার শহর।
ইংরেজিতে প্যারিস নামে পরিচিত এই নগরী ইউরোপে ‘পারি’ নামেই খ্যাত। কাগজে কলমে প্যারিসের খ্যাতি আছে “আলোকিত নগরী” বা “La Ville Lumière” এর। একটি কারণ এই প্যারিস একদিকে জ্ঞান বিজ্ঞানে ইউরোপে ছিল চালকের আসনে। ইউরোপের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ প্যারিস ইউনিভার্সিটি (‘la Sorbonne’) ছিলো এই চালক তিরীর অন্যতম কারখানা। আর অন্য কারণটি হলো প্যারিস ইউরোপের প্রথম শহর যেখানে গ্যাস চালিত ল্যাম্পপোস্ট প্রচলিত হয়। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে পুরো ইউরোপ যখন তলিয়ে যেত অন্ধকারে, সেখানে প্যারিসের বুলেভার্ড আর স্ট্রীটগুলো আলোয় ঝকমক করতো।
অনিন্দ্যসুন্দর শহর প্যারিসকে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সিন নদী। আর সেই নদীর উপর বিভিন্ন স্থানে আছে শৈল্পিক ৩৭টি ব্রিজ। পায়ে হাঁটার জন্যে নির্ধারিত সুন্দর ছিমছাম এই ব্রিজের রেলিংয়ের বেশ কয়েকটিতে চোখে পড়বে “লাভ প্যাডলক” নামে এক বিশেষ ধরনের তালার। এই তালাগুলো প্রেমিক অথবা প্রেমিকা যেকোনো কেউ আরেকজনের নাম বা নামের প্রথম অক্ষর খচিত করে এই ব্রিজগুলোর রেলিঙয়ে বেঁধে রাখেন এবং এর চাবিটি ফেলে দেন সিন নদীতে। প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা প্রকাশের অনন্য এই রীতি প্যারিসকে খ্যাতি দিয়েছে ভালোবাসার শহরে।
ভালোবাসার বিড়ম্বনা
প্রতি বছর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরুপ এই বিপুল পরিমাণ লাভ প্যাডলক তৈরী করছে নানা ধরনের ঝামেলা। ২০১০ মে মাসে প্যারিস শহরের কর্তৃপক্ষ ব্রীজগুলোতে এই বিপুল পরিমাণ তালা নিয়া শংকা প্রকাশ করেন। মূলত এই তালাগুলো ব্রীজে অতিরিক্ত ওজন যোগ করছে। আর এই কারণে ব্রীজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই প্যারিসের ব্রীজ দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীরা ব্রীজগুলোতে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিচ্ছেন “লাভ উইদাউট লক” এই শিরোনামের! এমনকি কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাস্তবিক তালার বদলে ইন্টারনেটে “ভার্চুয়াল লাভ লক” ক্যাম্পেইন চালু করেছে।
আইফেল টাওয়ার
প্যারিস এলেন আর আইফেল টাওয়ার না দেখে চলে গেলেন ব্যাপারটা মোটেও ঠিক হলো না। ফ্রান্সে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায় এটি এক নাম্বারে। প্রতি বছর তাই ৭ মিলিয়ন পর্যটকের পদচারণায় ভারী থাকে আইফেল টাওয়ার এলাকা। যেখানে গড়ে প্রতি ১২ মিনিটে একটি সিনেমার শুট্যিং চলতেই থাকে। আর ইউরোপের প্রতি ১০ নবদম্পতির ৩টিকেই পাওয়া যাবে আইফেল টাওয়ার এর সামনে। তবে ১৮ হাজার ৩৮টি লোহার টুকরো দিয়ে বানানো এই বিশাল টাওয়ার শীতের চেয়ে গ্রীষ্মে অন্তত ৬.৭৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যে বেড়ে যায়। তাই সিদ্ধান্ত আপনার, গরমে যাবেন নাকি শীতে।
প্যারিস সহ পুরো ফ্রান্সের স্বর্ণালী স্থাপত্যকলার এক জীবন্ত নিদর্শন হলো নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। ১৩০ মিটার লম্বা, ৪৮ মিটার চওড়া আর ৩৫ মিটার উঁচু এই স্থাপনা প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ১১৬৩ থেকে ১৩৪৫ সালের মধ্যে নির্মিত এই স্থাপনায় রয়েছে ১৩ টনের এক ঘন্টা যেটি মূলত “ইমানুয়েল বেল” নামেই পরিচিত।
মিউজিয়ামের শহর প্যারিস
পুরো প্যারিস শহরজুড়ে আছে মোট ১৭৩টি মিউজিয়াম। বিশ্বজুড়ে তাই এই শহরের খ্যাতি আছে মিউজিয়ামের শহর হিসাবে। এর মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত মিউজিয়ামটি হল ল্যুভর মিউজিয়াম। যেখানে সংরক্ষিত আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর কীর্তি “মোনালিসা”। শুধু কি মোনালিসা? আরো আছে বিশ্বখ্যাত সব চিত্রকর আর কলাকুশলীদের অমর ৩,৮০,০০০টি কীর্তি। এই অমর কীর্তির টানেই বোধহয় সারা পৃথিবী থেকে প্রতি বছর ৯ মিলিয়নের অধিক সৌন্দর্য পিপাসু ছুটে আসেন। ল্যুভরের প্রতিটি শিল্পকর্মে দেখতে যদি আপনি ৫ সেকেন্ড করে ব্যয় করেন, তবে পুরো মিউজিয়ামের সবকিছু দেখতে লেগে যাবে ১০০ দিনের বেশী। সারা প্যারিসজুড়ে ১৭২টি মিউজিয়াম বাকী থেকেই যাবে!
ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিস
১৮০০ সালের শুরু থেকেই সৌন্দর্য সচেতনের মিলনমেলায় পরিণত হয় প্যারিস। যেটি বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশন রাজধানী হিসাবে খ্যাত। পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত সব ফ্যাশন ডিজাইনার আর ফ্যাশন সচেতনদের সেই মিলনমেলা “প্যারিস ফ্যাশন উইক”। প্যারিসেই আছে পৃথিবীর নামীদামী সব পারফিউম আর ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর ঘাটি।
রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফের শহর প্যারিস
ভূমি থেকে ৪০০ ফিট উপরে ঠিক আইফেল টাওয়ারে বসে রাতের আলোক ঝলমলে প্যারিস দেখতে দেখতে ডিনার করতে চান, পকেটে ১৯০ থেকে ২৩০ ইউরো নিয়ে চলে যান ‘লা জুল ভার্ন’ (Le Jules Verne) নামক রেস্টুরেন্টে।
তবে এত টাকা খরচ না করেও চাইলে পেয়ে যেতে পারেন প্যারিসের ঐতিহ্যবাহী সব খাবার । শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে প্যারিসের প্রশস্ত রাস্তার দুইপাশের স্ট্রিটফুডের দোকানগুলোতে।
শান্তির শহর প্যারিস
প্যারিস আপাদমস্তক শান্তির শহর। অস্কার ওয়াইল্ড নামের সাহিত্যিকের প্যারিস এতই ভালো লাগে যে, উনি মজা করে বলেছিলেন মারা যাবার আমেরিকানরা প্যারিসের মতো স্বর্গ পেলেই খুশি। ঐতিহাসিকভাবে এই শহরেই রচিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিসূচক শান্তিচুক্তি, যেটি “প্যারিস পিস কনফারেন্স” নামে পরিচিত। এই কনফারেন্সেই স্বাক্ষরিত হয়েছিলো “ভার্সাই চুক্তি”। আর “লিগ অফ নেশনস” এর ধারণা বেরিয়ে আসে এই পিস কনফারেন্স থেকেই।
আর তাই শান্তির চাদরে ঢেকে থাকা এই প্যারিসে বেড়াতে আসা প্রতিটি বিদেশী নাগরিকের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বদা সজাগ ফ্রেঞ্চ পুলিশ। কড়া এই আইনশৃঙ্খলা প্যারিসকে পর্যটকের স্বর্গভূমিতে রূপান্তর করেছে। আর এই শত-সহস্র বছরের পুরোনো এক রূপকথার নগরী প্যারিস তার আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর মিউজিয়াম সহ শত শত কীর্তি নিয়ে হাত বাড়িয়ে ডাকে সারা বিশ্বের সৌন্দর্য পিপাসুদের।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Paris
২) toureiffel.paris/en/
৩) louvre.fr/en
৪) en.wikipedia.org/wiki/Louvre