উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধ জেলা বগুড়া ঘোরাঘুরির জন্য এক চমৎকার জায়গা। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা এই জেলাতেই অবস্থিত। হ্যাঁ, মহাস্থানগড়ের কথাই বলা হচ্ছে। হাতে ২-৩ দিন সময় নিয়ে অনায়াসেই ঘুরে আসতে পারেন বগুড়া শহর আর শহরের নিকটে অবস্থিত মহাস্থানগড় সহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান থেকে।
হাতে যদি তিন দিন সময় নিয়ে বের হন, সেক্ষেত্রে বেশ আরামে ঘুরতে পারবেন। বগুড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভাল। ঢাকার কল্যাণপুর বা গাবতলী বাস ষ্ট্যান্ড থেকে দিনে বা রাতে যেকোনো সময়েই বাস পাবেন। আপনার নিজের সুবিধাজনক সময় বেছে নিয়ে রওনা দিতে পারেন। শ্যামলী, হানিফ, নাবিল, শাহ ফতেহ আলী, ডিপজল ইত্যাদি বিভিন্ন পরিবহনের বাস ঢাকা-বগুড়া রুটে চলাচল করে, ভাড়া পড়বে ৩৫০ টাকা। এসি বাসেও যেতে পারেন, এসি বাসের ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে শুরু।
বগুড়া শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। শহরের চারমাথা মোড়ে আছে হোটেল সেফওয়ে, বনানীতে আছে হোটেল সিস্তা। বনানীতে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ‘পর্যটন মোটেল’। এছাড়াও বগুড়া শহরে একটি পাঁচ তারকা হোটেলও আছে, নাম হোটেল নাজ গার্ডেন, শহরের ছিলিমপুরে এর অবস্থান।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়া জেলা শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যেও বেশ বিখ্যাত। ভ্রমণের প্রথম দিন শহরটা ঘুরে দেখতে পারেন। শহরের ভেতরে রয়েছে বেশ কিছু ঘোরার জায়গা। প্রথমেই ঘুরতে পারেন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত মোহাম্মদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম। বগুড়া শহরের সাতমাথা মোড়ের নিকটে অবস্থিত এই জাদুঘরটি মূলত বগুড়ার নবাববাড়ী। এই নবাব পরিবারের সদস্য মোহাম্মদ আলী ছিলেন ১৯৫৩-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
নবাব পরিবারের এই প্রাসাদটি ১৯৯৮ সাল থেকে জাদুঘর হিসেবে চালু রয়েছে। জাদুঘরে নবাব পরিবারের ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাচীন দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে নবাব পরিবারের তৎকালীন জীবনধারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, অনেকটা আহসান মঞ্জিলের কায়দায়, যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা বেশ খারাপ। প্রাসাদ কমপ্লেক্সের ভেতরকার অংশে একটি শিশুপার্কও আছে।
জাদুঘরের নিকটে রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো হল, নাম থমসন হল। এটি বগুড়া জিলা স্কুলের সীমানার ভেতরে অবস্থিত। ১৮৮২ সালে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্ণর স্যার রিভার থমসন একটি থিয়েটার হল নির্মাণ করেছিলেন, পরবর্তীতে এটি জিলা স্কুলের পাঠাগারে পরিণত হয়। শহরের সাতমাথা মোড়ে দাঁড়িয়েও হলটি দেখতে পাওয়া যায়।
বগুড়ায় আছে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম ‘শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম’, এখানেও একটা ঢুঁ মারতে পারেন। স্টেডিয়াম গেটের সাথেই আছে বগুড়া ওয়ান্ডারল্যান্ড শিশুপার্ক। স্টেডিয়ামের কাছেই ১০ মিনিটের রিকশার দূরত্বে আছে ‘সরকারি আযিযুল হক কলেজ’। উত্তরবঙ্গের অন্যতম বিদ্যাপীঠ এই ক্যাম্পাসেও কিছু সময় কাটিয়ে আসতে পারেন।
মহাস্থানগড় বগুড়ার অন্যতম আকর্ষণীয় প্রত্নতত্ত্ব স্থল হলেও আরো কিছু জায়গা রয়েছে। তেমনই একটি জায়গায় হলো ‘খেরুয়া মসজিদ’। বগুড়া শহর থেকে ২২ কি.মি. দূরে শেরপুর উপজেলায় এটি অবস্থিত। শহরের সাতমাথা বাসস্ট্যান্ড থেকে শেরপুরগামী বাসে উঠলে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টার ভেতর পৌঁছে যাবেন শেরপুরে। শেরপুরে নেমে ভ্যান বা রিকশায় ১০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন সুলতানী আমলে তৈরী ৪৩৫ বছরের পুরনো খেরুয়া মসজিদে।
চারশ’ বছরের পুরনো হলেও মসজিদটি বেশ ভালো অবস্থায়ই আছে। সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ, বেশ কিছু গাছপালাও আছে চারপাশে। মসজিদের গায়ে রয়েছে চমৎকার এক শিলালিপি। শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ সালে জনৈক মির্জা মুরাদ খান কাকশাল এটি নির্মাণ করেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি মোগল ও সুলতানি স্থাপত্যরীতির মিশ্রণে তৈরী। মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে কিছু ফুল-লতা-পাতার নকশা, সাধারণ কিন্তু নান্দনিক নকশায় তৈরী মসজিদটি দেখতে বেশ ভালই লাগবে।
মহাস্থানগড়
মহাস্থানগড় ভ্রমণ করতে আপনাকে পুরো একটা দিন হাতে রাখতে হবে। কেননা ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন প্রত্নস্থল ঘুরে দেখতে আপনার সারা দিন লেগে যাবে। শহরের তিনমাথা বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাস্থানগড়গামী বাস পেয়ে যাবেন সহজেই, পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র আধাঘন্টা। ‘মহাস্থান বাজার’ নামক স্থানে নেমে একটি ভ্যান নিয়ে ৫ মিনিটেই পৌঁছে যাবেন মহাস্থানগড়ে। জায়গাগুলো ধারাবাহিকভাবে সময় নিয়ে দেখা উচিত। মহাস্থানগড় ঘোরার আগে গুগল ম্যাপে সব অবস্থানগুলো আগে দেখে নিলে ভাল ধারণা পাবেন। ইতিহাসটাও জেনে নেয়া দরকার, নতুবা ঘুরে দেখার পরও জায়গাটা অচেনা থেকে যাবে।
মহাস্থানগড় এখনো পর্যন্ত এ দেশে আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন পুরাকীর্তি, যেটা তৈরী হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও চারশ বছর পূর্বে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে! তখন মহাস্থানগড় পরিচিত ছিল ‘পুন্ড্রবর্ধন’ বা ‘পুন্ড্রনগর’ নামে। এটি তৎকালীন বাংলার রাজধানী ছিল। প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ নগরীটি উপর থেকে দেখতে আয়তকার। প্রাচীরের ভেতরে ও বাইরে ছিল বিভিন্ন স্থাপনা, এখন যেগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে একে সার্কের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হিসেবে ঘোষিত হয়।
নগরীতে ছিল বেশ কিছু বৌদ্ধমঠ, ম গুলোতে সুদূর তিব্বত ও চীন থেকে ভিক্ষুরা আসতেন পড়াশোনা করতে। এখান থেকে দীক্ষা নিয়ে ভিক্ষুরা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ ধর্মশিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে।
নগরীর সীমানা প্রাচীরটি প্রায় ৩ কি.মি. এর মতো দীর্ঘ, পুরোটা হেঁটে শেষ করা মুশকিল। এছাড়াও প্রত্নস্থলগুলো ছড়ানো-ছিটানো হওয়ায় একটি ক্রম ধরে দেখা শুরু করলে ভাল হয়। নিচে সেভাবেই বর্ণনা করা হলো। যথাসম্ভব সকাল সকাল পৌঁছানোর চেষ্টা করুন।
শুরুটা করুন মহাস্থান বাজারে নেমেই হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র) এর মাজার দিয়ে, বাজারে সাথেই লাগোয়া এটি। চতুর্দশ শতাব্দীতে তিনি পুন্ড্রনগরে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে আসেন। এ সময় তৎকালীন রাজা পরশুরামের সাথে ধর্মপ্রচার নিয়ে বিরোধে তার সাথে যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত হন। তিনি তার সাথীদের সাথে মাছ আকৃতির নৌকায় করে এ অঞ্চলে পৌঁছান, এ কারণে তাকে ‘মাহী সওয়ার’ বা ‘মাছের পিঠে করে আগমনকারী’ বলা হয়।
এরপর মাজার থেকে মহাস্থানগড়ের দিকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে ডাকবাংলো সংলগ্ন ‘খোদার পাথর ভিটা’তে যেতে পারেন। এটি মূলত একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। এখানে একটি বেশ বড় আকারের আয়তাকার মসৃণ পাথর আছে। পাথরটি রাজা পরশুরাম বলী দেয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। এখনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সিঁদুর ও দুধ ঢেলে ভক্তি করে থাকেন।
খোদার পাথর ভিটার ঠিক পাশেই আছে ‘মানকালীর কুন্ড’। ফসলি জমির আইল দিয়ে অথবা ঘরবাড়ি সংলগ্ন মেঠোপথে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে সামনে পড়বে এটি। অবাক করার বিষয় হলো, এটি একটি মসজিদের ধ্বংসবাশেষ, যেটি সুলতানি আমলে নির্মিত।
মানকালীর কুন্ডের ঠিক পাশেই খেয়াল করলে দেখতে পাবেন ফসলি জমির গা ঘেঁষে শুরু হয়েছে মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীর। প্রাচীরের উপর দিয়ে হাঁটতে বেশ দারুণ লাগবে, মনে হবে যেন চীনের মহাপ্রাচীরের উপর দিয়ে হাঁটছি! মিনিট দশেক হাঁটলে সামনে পড়বে দুর্গনগরী মহাস্থানে প্রবেশের প্রাচীন এক ফটক।
ফটক পেরিয়ে আবার প্রাচীরে উঠলে দেখতে পাবেন ‘রাজা পরশুরামের প্রাসাদ’। রাজা পরশুরাম ছিলেন এখানকার শেষ রাজা যাকে শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী পরাজিত করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে খননের মাধ্যমে এখানে প্রাসাদের প্রবেশদ্বার, প্রহরী কক্ষ, ৪টি অন্দরমহল ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
প্রাসাদের সামনে আছে ‘জিয়ৎ কুন্ড’ নামে একটি কূপ। কথিত আছে, রাজার পরশুরাম শাহ সুলতান মাহমুদ বলখীর সাথে যুদ্ধের সময় এই কূপের পানির সাহায্যে তার বাহিনীর মৃত সৈনিকদেরকে জীবিত করতে পারতেন। শাহ সুলতান কূপটির পানির জীবন দান করার ক্ষমতার কথা জানতে পেরে একটি চিলের সাহায্যে এক টুকরো মাংস কূপের পানিতে নিক্ষেপ করলে কূপটির অলৌকিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। যদিও এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
এরপর ভালো হয় আপনি যদি একটু আগে দুর্গের যে ফটকটি পার হয়েছিলেন, সেটা দিয়ে প্রধান রাস্তায় গিয়ে ভ্যানে করে মহাস্থানগড়ের মূল গেটে যান। দূর্গের প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটেও আপনি মূল গেটে পৌঁছাতে পারবেন, কিন্তু সেটা কিছুটা সময় সাপেক্ষ এবং পরিশ্রমের।
মহাস্থানগড়ের মূল ফটকে গড়ে ওঠার জন্যে তৈরী করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে কিছু দূরে দেখতে পাওয়া যায় ‘বৈরাগীর ভিটা’ নামক একটি ঢিবি। রাস্তার বিপরীতে করতোয়া নদীর গা ঘেঁষে আছে ‘গোবিন্দ ভিটা’, যেটা ছিল একটি মন্দির। গোবিন্দ ভিটা দেখা শেষে মহাস্থানগড় জাদুঘর পরিদর্শনে ঢুকে পড়ুন। জাদুঘরটি বেশ চমৎকার। চেষ্টা করুন উপরে বর্ণিত পুরো ঘোরাফেরাটা লাঞ্চের আগে সেরে ফেলতে, এতে বাকি তিনটি জায়গা সন্ধ্যার আগপর্যন্ত ঘোরার সময় হাতে থাকবে।
লাঞ্চ সারতে পারেন মহাস্থানগড়ের পর্যটন স্ন্যাকস কর্ণারে, অথবা ভ্যানে করে মহাস্থান বাজারে ফিরে কোনো একটা রেঁস্তোরায়। এরপর আর তিনটি জায়গা বাকী থাকবে; সেগুলো হলো গোকুল মেধ (স্থানীয়রা বলে ‘বেহুলার বাসরঘর’), ভাসু বিহার (স্থানীয়রা বলে ‘নরপতির ধাপ’) এবং বিহার ধাপ (স্থানীয়রা বলে ‘তোতারাম পন্ডিতের বাড়ি’)।
এই প্রত্যেকটি জায়গা মহাস্থানগড় থেকে গড়ে প্রায় ৫/৬ কি.মি. দূরত্বে ছড়ানো। ভাল হয় যদি একটি ভ্যান বা সিএনজি ভাড়া করে নিতে পারেন। তবে আলাদাভাবেও যেতে পারেন। ভাসু বিহার এবং বিহার ধাপ উভয়ই কিছু আয়তাকার বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি বিহারে ভিক্ষুদের যথাক্রমে ২৬টি ও ৩৭টি কক্ষ আছে। ভাসু বিহার থেকে প্রায় ৮০০টি প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে, যার মধ্যে আছে ক্ষুদ্র মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, মূল্যবান পাথরের গুটিকা, সীলমোহর ইত্যাদি। এগুলোর অনেক কিছুই মহাস্থানগড় জাদুঘরে রাখা আছে।
গোকুল মেধ মূলত একটি বৌদ্ধ মঠ হলেও এর অবকাঠামো বেশ বিচিত্র ও জটিল। বলা হয়ে থাকে, এখানে বেহুলার বাসরঘর হয়েছিলো। মহাস্থানগড় বাসস্ট্যান্ড থেকে ২ কি.মি. দূরে গোকুল গ্রামে এটি অবস্থিত। এখানে ত্রিকোণ বিশিষ্ট ১৭২টি এলোমেলো কক্ষ আছে, যা বেশ দুর্বোধ্য।
স্তূপটির উপরে রয়েছে একটি কূপ, একসময় কূপটি ৮ ফুট গভীর ছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে এটিকে মঠ বলা হলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থে এটিকে পর্যবেক্ষণাগার বলা হয়েছে, যার কাজ ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে পুন্ড্রনগরকে রক্ষা করা।
শহর আর মহাস্থানগড় ঘুরে ফিরে জমজমাট ছুটি কাটিয়ে আসতে পারেন বগুড়া থেকে, ২-৩ দিনের প্লানে ছুটি কাটানোর জন্য বগুড়া সত্যিই বেশ দারুণ এক জায়গা।
ফিচার ইমেজ- P. K. Niyogi