“আচ্ছা, কী মজা পাও এতো কষ্ট করে পাহাড়ে গিয়ে?” প্রায়ই এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। জবাব না দিয়ে কেবল হাসি, আর ভাবি, যে মানুষ পাহাড়ের সৌন্দর্য মন প্রাণ দিয়ে অনুভব করেনি তাকে কি আসলেই বলে বোঝানো সম্ভব কেন বারবার ছুটে যাই পাহাড়ে?
পাহাড়ের মায়ায় বাঁধা পড়েছি আরো আগেই। এই মায়ার বন্ধন আরেকটু গাঢ় করতে এবার ভাবলাম, এক রাত পাহাড়কে আরো কাছ থেকে দেখি, ক্যাম্পিং করে আসি।
ঠিক হলো, ক্যাম্পিং হবে মারায়ংতং পাহাড়ে। ‘মারায়ংতং’, ‘মারাইংতং’, ‘মেরাইথং’ বিভিন্ন নামেই ডাকা হয় এই পাহাড়টিকে। বান্দরবানের আলিকদম এই পাহাড়ের ঠিকানা। ১,৬৪০ ফুট উঁচু এই পাহাড়ে রাত কাটাবো ভাবতেই মন খুশিতে ভরে উঠলো। বান্দরবানকে অনেক আগেই মন দিয়েছি, মারায়ংতং এ যাবার আগ্রহ তাই কয়েকগুণ বেশি বেড়ে গেল। ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন তাবু ও খাবার দাবার যোগাড়-যন্ত করতে করতে মারায়ংতং-এ যাবার দিন চলে এল।
পাহাড়ে যখন যাওয়াই হচ্ছে, শুধু ক্যাম্পিং করলে কি আর পোষায়? সাথে আশেপাশে দেখার মত যা কিছু আছে তাই বা বাদ যায় কেন? সকালের শুরুটা তাই আলীর গুহা দর্শন করেই কাটানো ঠিক হলো। আলীর গুহাও বান্দরবানের আলীকদমেই। সকালে বাস থেকে নেমে নাস্তা সেরে উঠে পড়লাম জীপে (স্থানীয়ভাবে ‘চান্দের গাড়ি’ও বলা হয়)। জীপের সীটগুলো এমনভাবে দেওয়া যাতে ভেতরের সবটুকু জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। বুঝতেই পারছেন বসার জন্য কেমন হবে। তবে রাস্তার পাশের সবুজ দেখতে দেখতে সীটের কথা আর মাথায় ছিল না। এতো সবুজ, এতো সুন্দর! ইট-কাঠের শহর থেকে ওই সবুজের মাঝে গিয়ে অদ্ভুত এক শান্তি বোধ হয়!
প্রায় এক/দেড় ঘন্টা যাওয়ার পর আলীর গুহার ট্রেইলে পৌছালাম। আলীর গুহার ট্রেইলে যেতে হলে পাড় হতে হবে খরস্রোতা মাতামুহুরী। নৌকার দিক ঠিক রাখা যাচ্ছে না এমন স্রোত! একবার নৌকা উলটে ওখানে পড়লে কোথায় যে ভেসে চলে যাব তাঁর ঠিকঠিকানা নেই। নিরাপদেই অবশ্য ও’পাড়ে পৌঁছে গেলাম।
বান্দরবানের যেকোনো ট্রেইলের মতই সুন্দর আলীর গুহার ট্রেইল। তবে গুহায় ওঠার মাথায় গিয়ে আক্কেল গুড়ুম! একটা আধভাঙা সিঁড়ি ঝুলে আছে, ওই দিয়ে উঠতে হবে! সেই সিঁড়ি পর্যন্ত ওঠার ব্যবস্থাও তেমন সুবিধার না। যা-ই হোক, কোনোরকমে উঠে গেলাম আলীর গুহায়। একদম অন্ধকার, গা ছমছমে একটা পরিবেশ গুহার মধ্যে! যেন অনেক বছর আগের কোনো আদিম মানুষের বাসস্থানে চলে এসেছি, এখনই ভেতর থেকে সে বেরিয়ে আসবে! গুহা দেখা শেষ করে আবারো অনেক কসরৎ করে নিচে নেমে এলাম।
আলীর গুহা থেকে যখন রাস্তায় বেরোলাম, তখন দুপুর হয়ে এসেছে। পেটও জানান দিচ্ছে তার রসদ দরকার। জীপে করে চলে গেলাম স্থানীয় বাজারে। স্থানীয় দোকানে দুপুরের খাবার সেরে রওনা দিলাম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য মারায়ংতংয়ের দিকে! জীপ আমাদের নামিয়ে দিল পাহাড়ের নিচে কিছু দূরে এক পাড়ায়। সেখানেই তাবু-খাবার সব ভাগ করে নিয়ে রওনা দিলাম চূড়ার উদ্দেশ্যে।
প্রথমটা উঠতে অত খারাপ লাগছিল না। কিন্তু একটু পরেই পাহাড় ৭০ ডিগ্রী কোণ করে ঢালু হতে শুরু করল। তাবু আর ব্যাগের ভার, সাথে এই খাড়া রাস্তা- মনে হচ্ছিল, নাহ্, আর সম্ভব না! কিন্তু ফিরে যাবার জন্যে তো আসিনি, চূড়ায় পৌঁছাতেই হবে। ধীরে ধীরে উঠা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে বিশ্রাম নেবার জন্য থামি, আর চেয়ে দেখি পাহাড়ের উপর থেকে বান্দরবানের অপরূপ সবুজ! যত উপরে উঠছি মাতামুহুরী এক ফালি রূপালি ফিতের মত মনে হচ্ছে। অসাধারণ সেই দৃশ্য! সকল ক্লান্তি ছাপিয়ে আবারো আমি বুঝতে পারলাম পাহাড়ে কেন ফিরে ফিরে আসি।
প্রায় আড়াই ঘন্টা ওঠার পর একটা পাড়ার দেখা মিললো। ম্রোদের একটা পাড়া, নাম ‘মংকে পাড়া’। ওদের পরনের বসন দেখে বোঝা যায় অন্য অনেক আদিবাসীদের মত এখনো অত আধুনিক হয়ে ওঠেনি তারা। পাড়াটা অবশ্য খুবই ছোট, হাতেগোনা কয়েকটা বাঁশের তৈরি বাড়ি। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার উঠা শুরু। এবার অবশ্য পাহাড় অতটা ঢালু না। আরো প্রায় ১ ঘন্টা পাহাড় বেয়ে মারায়ংতংয়ের চূড়ার কাছে চলে আসি। আহ্, আরেকটু উঠলেই গন্তব্য! হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি মেঘের চাদর ঘিরে রেখেছে পাহাড়কে! তার উপরে পড়েছে অস্তগামী সূর্যের হালকা আলো। ছবিতে এই দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব না, এই দৃশ্য শুধু অনুভব করার মত। মেঘের চাদরে ঘিরে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের চূড়ায়।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠেই যেটা সবার প্রথমে চোখে পড়ে, তা হল বিশাল একটি জাদি। জাদি হলো বৌদ্ধদের পূজা-অর্চনার জন্য বানানো বুদ্ধমূর্তি। এমনভাবে জাদিটি বানানো যেন সে দূর কোনো প্রান্তের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির রহস্য নিয়ে ভাবছে আর স্মিত হাসি ফুটে উঠছে তার ঠোঁটে।
পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মেঘের কুয়াশায় মেখে মেখে তাবু সাজিয়ে ফেললাম। এরপর রান্নার পালা। তা অবশ্য আমাকে করতে হয়নি, দলনেতা সে দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আমি এই ফাঁকে অবাক বিষ্ময়ে তারা দেখছি! অজস্র তারা, কোটি কোটি তারা! সব যেন মাথার উপরে আলোর মেলা সাজিয়ে বসেছে। এই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করা সম্ভব কখনো ভাবিনি। কিন্তু দলের একজন ঠিকই অজস্র তারাকে তাঁর ক্যামেরায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এই ছবিটা আমার এখন পর্যন্ত দেখা অসাধারণ ছবি তালিকার প্রথম স্থানে থাকবে।
অনেকক্ষণ তারা দেখে ক্লান্ত হয়ে কখন তাবুতে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছি, নিজেও জানিনা। হঠাৎ ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো- খাবার তৈরি। খিচুরী-মুরগি-আচার নামক অমৃত দিয়ে পেটপূজা সেরে নিলাম। আকাশভর্তি তারা ধীরে ধীরে ঘন মেঘে ঢেকে গেল। চারিদিকে ঘোলাটে কুয়াশার মত মেঘ, শীতল কাঁপুনি ধরানো বাতাস। সারবাঁধা তাবুগুলো কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল। একই রাতে মারায়ংতংয়ের দু’রকম সৌন্দর্য দেখা হয়ে গেল। তবে ভয় পাচ্ছিলাম, বৃষ্টি না চলে আসে! শেষ পর্যন্ত মেঘের মর্জি হলো না। তাই বেঁচে গেলাম বৃষ্টি থেকে।
সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম মারায়ংতংয়ের ভোরের রূপ। জায়গায় জায়গায় মেঘ জমে আছে, কিংবা কুয়াশার মত ভেসে বেড়াচ্ছে। তার উপর সূর্যের হালকা আলো পড়ছে। এর মধ্যেই ফিরে যাবার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
পাহাড়ে উঠতে যত কষ্ট হচ্ছিল নামতে তার চেয়ে খুব কম কষ্ট হচ্ছিল না। ঢালু পথে খুব নিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ দিয়ে তবেই নামতে হয়। নতুবা যেকোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। যদিও অনেক কম সময়েই নিচে নেমে এসেছি। এবার ফেরার পালা। তবে গন্তব্য ঢাকা নয়, দামতুয়া ঝর্ণা।
পাহাড় থেকে নামতে নামতেই তুমুল বৃষ্টি। ওই বৃষ্টির মধ্যেই মোটর সাইকেলে করে আদুপাড়ার দিকে রওনা। পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে মোটর সাইকেল রাইড একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। একই সাথে ভয় এবং ভালোলাগা কাজ করে যখন খাড়া রাস্তা বেয়ে বাইক উঠে যায় কিংবা সাঁই করে নিচে নেমে আসে।
আলীকদম থেকে আদুপাড়া প্রায় ১৭ কিলোমিটার রাস্তা। আদুপাড়া থেকে দামতুয়ার ট্রেইল শুরু। কিন্তু মাঝে বিপত্তি হয়ে দাঁড়ালো আর্মির অনুমতি। সাধারণত মেয়ে ট্রাভেলার থাকলে অনুমতি দিতে চায় না নিরাপত্তাজনিত কারণে। অনেকটা সময় নষ্ট করে অনেক শর্ত মেনে নিয়ে শেষমেষ অনুমতি পাওয়া গেল। আদুপাড়ায় পৌঁছে হাঁটা শুরু হল দামতুয়ার উদ্দেশ্যে।
ট্রেইলটা অনেক বড়, প্রায় চার ঘন্টা পাহাড় এবং ঝিরির রাস্তা। একটু একটু করে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে পৌছে গেলাম দামতুয়ার কাছে। মাঝে পড়লো ‘ব্যাঙ ঝিরি’ নামক সুন্দর একটি ক্যাসকেড। এত সুন্দর ক্যাসকেডের নাম কেন ‘ব্যাঙ ঝিরি’, এর উত্তর অবশ্য জানা যায়নি।
ব্যাঙ ঝিরি থেকে একটু সামনেই ‘দামতুয়া’ বা ‘তুক অ’ বা ‘লামোনাই’ ঝর্ণা। সবগুলোই একটি ঝর্ণার নাম। বিশাল এই ঝর্ণার কাছে গিয়ে সব ক্লান্তি নিমেষেই ধুয়ে মুছে গেল।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে দুটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হল। প্রথমটি হল সন্ধ্যা নেমে আসছে, দ্বিতীয়টি হল মুষলধারে বৃষ্টি! যারা পাহাড় আর ঝর্ণা সম্পর্কে একটু ধারণা রাখেন, তারা জানেন বৃষ্টিতে হুট করে পাহাড়ি ঢল নামে, শান্ত নিরীহ দেখতে ঝিরিগুলো নিমিষে ভয়ংকর স্রোত নিয়ে ওত পেতে থাকে! এমন কয়েকটা ঝিরি পেরোতে গিয়ে পায়ের একপাটি স্যান্ডেল খুইয়ে কোনমতে মাঝামাঝি এক পাড়ায় এসে উঠি। এক পায়ে স্যান্ডেল আরেকটা খালি পা নিয়ে রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে পুরো ট্রেইল পাড়ি দিয়ে ফিরে আসি। একই সাথে ভয় আর উত্তেজনা কাজ করছিল মনে; রাতের বেলা পাহাড় পাড়ি দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়!
পাহাড়ে কেন যাই? এর আসলে কোনো যথার্থ উত্তর নেই। পাহাড়ের সাথে প্রচন্ড টান অনুভব করি, তাই বারবার যাই। প্রতিবারই পাহাড়ে উঠতে উঠতে ভাবি এই শেষ, আর যাব না। ফিরে এসে আবার অন্য আরেক পাহাড়ে যাওয়ার নকশা বানাই। পাহাড় উন্মুক্ত সবার জন্যেই, তবে হুট করে ঝোঁকের বসে না চলে যাওয়াই ভাল। পাহাড় যেমন অনেক দিতে পারে, তেমনি কেড়েও নিতে পারে অনেক। নিরাপদ হোক সকলের পাহাড়-ভ্রমণ!