পাহাড়ের বুকে মারমাদের বসবাস। তাদের আবাসভূমির উপর দিয়েই পর্যটকদের পদচারণা। পাহাড়ি মানুষগুলোর বাড়ির উঠোন ধরে এগোলেই পাওয়া যায় গহীন অরণ্যে লুকিয়ে থাকা দেবতাখুম। শীলবাধা পাড়ার বেশিরভাগ ঘরগুলো মাটি থেকে দুই ফুট উপরে অবস্থিত। এটিই হয়তো তাদের ঘর তৈরির নিয়ম। পর্যটকদের ক্যামেরায় হরহামেশাই বন্দি হয় এই ঘরগুলো। অথচ যাদের ঘর নিয়ে পর্যটকদের এত উন্মাদনা, তাদের নেই পর্যটকদের নিয়ে তেমন আগ্রহ। স্থানীয় মারমা সদস্যরা নিজেদের কাজেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।
দেবতাখুম বান্দরবানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত স্থান পর্যটকদের কাছে। দেবতাখুম ভ্রমণে শুরু থেকে রোমাঞ্চ হাতছানি দিয়ে যায়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথ দিয়ে চান্দের গাড়ির যাত্রায় শান্ত প্রকৃতি পর্যটকদের অন্তরে সুখের পরশ বুলিয়ে দেয়। বান্দরবান শহর থেকে প্রথমেই রোয়াংছড়ি পৌঁছাতে হয়। সেখানে দর্শনার্থীদের নাম-ঠিকানা জমা করতে হয় রোয়াংছড়ি থানায়। সকলের জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে নিয়ে ভ্রমণ আবশ্যক। দেবতাখুম ভ্রমণে গাইড ছাড়া এক পা-ও এগোতে দেবে না স্থানীয় প্রশাসন। রোয়াংছড়ি থানায় নাম-ঠিকানা জমা দেওয়ার পর কচ্ছপতলী বাজারে লিরাগাঁও সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আবারও জমা করতে হয় দর্শনার্থীদের নাম-ঠিকানা।
সেনাবাহিনীর কাছে চেক ইন করার পর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দুপুরের খাবার আপনি কচ্ছপতলী বাজারে খাবেন, নাকি দেবতাখুমের পথে পাহাড়িদের বাড়িতে। অনেকেই স্থানীয়দের হাতে তৈরী রান্না খেতে ভালোবাসেন। পাহাড়ি জুমের তৈরী চাল, লাল মুরগির সমন্বয়ে সুস্বাদু খাবারের আয়োজন থাকে সেখানে। এক্ষেত্রে গাইডের সাথে আলোচনা করে রাখবেন আগে আগেই। গাইডই সব ব্যবস্থা করে দেবে। গাইডের নির্দেশনানুযায়ী ভ্রমণ করলে দেবতাখুম সফর অনেকখানি সাবলীল হয়ে যায় পর্যটকদের। বলে রাখা ভালো, দুপুর ১২টার মধ্যেই রোয়াংছড়ি থানা ও কচ্ছপতলী বাজারের লিরাগাঁও সেনাবাহিনী ক্যাম্পে চেক ইন করতে হবে।
বান্দরবান শহর থেকে রোয়াংছড়ি মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। পথিমধ্যে যতদূর চোখ যায়, রাস্তার দু’ধারে ধরা পড়ে ঢেউ খেলানো অসংখ্য পাহাড়। দিগন্তবিস্তৃত উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়ে ঘিরে থাকা অঞ্চল তার বিশালতা প্রমাণ করে। পাহাড়ের চূড়ায় গুচ্ছাকারে কিছু জমে থাকা থাকা মেঘ ধরা পড়ে চোখে। নীলগিরির পথের মতো স্বচ্ছ মেঘ এখানে খালি চোখে ধরা না দিলেও সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় সামান্য মেঘের স্তুপ ভ্রমণে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। চান্দের গাড়িতে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করলে ৩৬০ ডিগ্রি প্রাকৃতিক দৃশ্যের অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়। পাহাড়ি লোকেদের পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা কলাগাছ, আখ, জুম চাষের ক্ষেত দেখে।
আখকে মারমা ভাষায় ‘ক্র্যাং’ বলা হয়ে থাকে। পাহাড়ের বুকে চাষাবাদ হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কাজ। মারমা নারী-পুরুষ উভয়েই চাষাবাদের কাজ করে থাকে। বলিষ্ঠ শরীরে ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে দিনাতিপাত তাদের। তাদের কাছে জীবন মানেই পাহাড়-ঝিরি-চাষাবাদ। দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষদের জীবনের চেয়ে তাদের জীবন একেবারেই ভিন্ন। নিজেদের গণ্ডিতে সর্বদা তাদের বিচরণ, এখানেই যেন বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ায় তারা।
কচ্ছপতলী বাজার থেকে দেবতাখুম পৌঁছানোর রাস্তা দুটি। আপনি যদি রোমাঞ্চ উপভোগ করতে চান, তাহলে পাহাড়ি পথে পা বাড়াবেন আর যদি শারীরিক পরিশ্রমকে কাছে না টেনে স্বস্তি চান, তাহলে ঝিরিপথে যাওয়াই মঙ্গল। পাহাড়ি পথের যাত্রায় একদম প্রথম কদম থেকেই আপনাকে তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। দীর্ঘদিনের জং ধরে থাকা শরীর আপনার মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্লান্তি ধরিয়ে দেবে। সুবিশাল উঁচু পাহাড়ে প্রতি পদে পদে আপনার শারীরিক সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষা হবে। একে একে তিনটি পাহাড় মাড়াতে হবে। পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠা গাছ ও সবুজ দৃশ্য আপনার মানসিক মনোবল বৃদ্ধি করবে সামনে এগোতে। গাছের ফাঁক দিয়ে বেড়ে ওঠা নীল আকাশের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ছাতা হয়ে প্রস্তুত। দুর্গম, নিরিবিলি ও ভূতুড়ে পথে পাহাড়ি লাল মাটির ঘ্রাণে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়।
পরপর তিনটি পাহাড় পেরিয়ে আপনার উপলব্ধি হবে, পর্যটক ও স্থানীয় মারমা সম্প্রদায়ের কৃষিকাজ করা ব্যক্তিদের পদচারণায় পাহাড়ের বুকে মাটি অনেকখানি সিঁড়িতে রূপ নিয়েছে। এই সিঁড়িরূপী পাহাড়ি মাটি সামনের পথেও বন্ধু হয়ে দেখা দেবে। একধাপ-দু’ধাপ করে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এগোবেন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে। কয়েক প্রজাতির পাখি ও গাছের সংমিশ্রণে দেবতাখুমের যাত্রাপথ সমৃদ্ধ। আমাদের গাইড উল্লাসদা সর্বদাই সামনে এগিয়ে। শক্তিতে তিনি আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। পঞ্চাশ মিনিটের অধিক সময় পাহাড়ি পথ পেরিয়ে আমরা দেখা পেয়েছিলাম প্রথম ঝিরিপথের। ঝিরির পানির স্রোত শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট করলেও মানসিক তৃপ্তি উপহার দেবে তার হিমশীতল বৈশিষ্ট্যে। ঝিরিপথের বাকি অংশ কেবলই উচ্ছ্বাসের গল্প। কারণ অল্প একটু এগোলেই শীলবাধা পাড়া।
এ পাড়ায় গুটিকয়েক ঘর দেখা যায়। সেখানে মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস। পাড়ার মারমাদের জীবিকা নির্ভর করে পাহাড়ে চাষাবাদ করে। দুয়েকটি দোকান দেখা গেলেও পণ্যের ঘাটতি রয়েছে। নিজেরাই মালিক, আবার নিজেরাই খদ্দের। পাড়ার ঘরগুলো যেহেতু মাটি থেকে দু’ফুট উপরে অবস্থিত, তাই নিজেদের তৈরি কাঠের সিঁড়ি কাজে লাগায় তারা। এই পাড়ার পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে বেয়ে চলা ঝিরিপথ, চারপাশ ঘিরে থাকা পাহাড়, পাথুরে পথ ও চমৎকার নীল আকাশ চোখের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। এখান থেকেই দেবতাখুমের মূল আকর্ষণ শুরু। লাইফ জ্যাকেট কিনে একটু সামনে এগোলেই ঝিরির পানি সবুজ হতে শুরু করে। বাকি পথটুকু পর্যটকদের দুবার নৌকায় পার করে দেয়। নৌকা সর্বদা প্রস্তুত সেখানে। লাইফ জ্যাকেট পরিধান বাধ্যতামূলক।
দেবতাখুমের ভেতরে যাওয়ার জন্য বাকি দায়িত্ব আপনাকে পালন করতে হবে। আগে থেকে তৈরি ভেলায় বসে পথ পাড়ি দিতে হবে। কাঁচা বাশের শক্তপোক্ত ভেলা রূপকথার উড়ে যাওয়া চাদরের মতো লাগে। দেবতাখুমের পানি প্রচণ্ড সবুজ ও ঠাণ্ড। শীতের মৌসুমেও প্রশান্তির বার্তা দিয়ে যায়। আবহমান বাংলার মাঝিদের ব্যাপারে কবিদের লুকিয়ে থাকা বাসনা শুধুমাত্র প্রকাশ পেয়েছে। কখনোই ধরা পড়েনি এই পেশায় নিয়োজিতদের শারীরিক পরিশ্রমের বিষয়টি। খুমের ভেতরে বৈঠা ঠেলে ভেলা নিয়ে যতই ভেতরে প্রবেশ করেছি, ততই শ্বাস-প্রশ্বাস ভারি হচ্ছিল আমাদের। ভীষণ পরিশ্রম হচ্ছিল ভেলা চালাতে। নিজেকে যোদ্ধা মনে হচ্ছিল। গাইড উল্লাসদা আমাদের ভেলায় চড়িয়ে পেছনে আরেক ভেলায় আমাদের দিকে নজর রাখছেন।
খুমের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০০ ফুট। পথিমধ্যে অসংখ্য পাথর গতিপথ পাল্টে দেয়। মূলত ভেলা ও পাথরের সংঘর্ষে এই ঘটনাটি ঘটে। বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়ে নিজের ভেলাকে উদ্ধার করে নিতে হয়। ভেলা নিয়ে যতই ভেতরে প্রবেশ করবেন, ততই নিজেকে ভীষণ সুখী মানুষ মনে হবে। শারীরিক কসরত বেশি হলেও খুমের অকল্পনীয় সৌন্দর্যের রূপ সকল ক্লান্তি মুছে দেবে।
সুনসান নীরবতায় ঘেরা দেবতাখুম। পৃথিবীর সমস্ত নীরবতা যেন এখানে এসে জমা হয়েছে। প্রশান্তি নিয়ে ভেলায় শুয়ে তৃপ্তির ঘুম অসম্ভব কিছুই নয়। খুমের দুদিকে বেড়ে ওঠা দানবাকৃতির পাহাড় যেন খুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে কয়েকগুণ। খুমের অপার্থিব মায়াবী দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে পর্যটকরা সামনে এগোতে থাকে। সামনে দেখা মেলে সরু পথের, তখন মোড় ঘুরিয়ে আবারও সোজা আকৃতিতে আনতে হয় ভেলা। আরও খানিকটা পথ সামনে এগোলেই খুমের শেষ প্রান্তের দেখা মিলবে। ৬০০ ফুটের এই পথ পাড়ি দিতে সময়ের প্রয়োজন হবে আনুমানিক ১ ঘণ্টা। যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের সময় তুলনামূলক বেশি লাগবে।
খুমের শেষ প্রান্তে পাথুরে পরিবেশে তীব্র স্রোতের দেখা মেলে। সামুদ্রিক স্রোতের খণ্ডচিত্র বলা চলে। ভেলা থেকে নেমে পাথরের বুকে পা রাখার পরক্ষণেই মনে হবে স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ চলছে। রোদের ঝিলিক পাহাড় বেয়ে খুমের পানিতে পড়লে, প্রকৃতি হলুদাভ বর্ণে ফুটে ওঠে। পর্যটকদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। এ পথেই আবার ভেলা চালানো বন্ধ হয়ে যায় বর্ষাকালে। স্রোতের বিপরীতে ভেলা চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন স্থানীয় গাইডরাই নৌকা টেনে খুমের চমৎকার দৃশ্যে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে দর্শনার্থীদের।
স্রোতের বিপরীতে ঝিরিপথ দিয়ে সাধারণত বর্ষাকালে হেঁটে পার হওয়া যায় না। তখন পাহাড়ি পথ একমাত্র আশ্রয় দেবতাখুম যাওয়ার। শীতকালে গেলে আসা-যাওয়ার জন্য দুটো পথেই পা মাড়ানো যায়। একবেলা পাহাড় হলে অন্যবেলা ঝিরিপথ। ঝিরিপথে নাম-পরিচয়হীন তিন থেকে চারটি ঝর্ণা রয়েছে। প্রতিটি ঝর্ণা শীতকালে মৃত থাকে, বর্ষায় জেগে ওঠে।
আবেদনময়ী শীতকাল চিরকালই জীবনে অতীত ফেরত আনে। মানুষের ব্যস্ততম জীবনে একটুখানি প্রশান্তির আশ্রয় মেলে ভ্রমণের মাধ্যমে। জমে থাকা ভারি নিঃশ্বাস প্রকৃতির কোলে ছেড়ে দিয়েই শান্তি খোঁজার প্রয়াস সবার মাঝে। এ প্রয়াসেই আবার জীবনে অতীত ফেরত আসে। অতীতের সুখের স্মৃতি ঘুরপাক খায় স্পষ্টভাবে। কোনো এক অতীতে নদীভ্রমণের সুখস্মৃতি দেবতাখুমের বুকে এসে মুক্তি পায়। এমন ঋতুতেই তো দেবতাখুম নিজেকে মেলে ধরে। গহীন অরণ্যের মাঝে লুকিয়ে থেকেও দূর-দূরান্তের পর্যটকদের একটুখানি প্রশান্তির উপলক্ষ হয়ে আছে। বান্দরবানের গহীন অরণ্যে অবস্থান করেও চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর পর্যটকদের। তাই দেবতাখুমের সৌন্দর্য রক্ষার্থে পর্যটকদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়। সচেতনতা প্রতি পদেই জরুরি দেবতাখুম ভ্রমণে।