পৃথিবীর একদম মাঝখান দিয়ে একটি কাল্পনিক রেখা চলে গেছে। এটি নিরক্ষরেখা। ইংরেজিতে যাকে বলে ইকুয়েটর (equator)। এই রেখাটি অতিক্রম করেছে একটি দেশের উপর দিয়ে। এই ইকুয়েটর বা নিরক্ষরেখার নাম অনুসারে সে দেশের নাম রাখা হয়েছে ‘ইকুয়েডর’। এটিই একমাত্র দেশ, যার নামকরণ করা হয়েছে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটি দেশ ইকুয়েডর। নিরক্ষীয় জলবায়ু অধ্যুষিত দেশগুলো সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। ফলে এই দেশগুলোর আবহাওয়া সাধারণত গরম হয়। দেশগুলোতে ঋতুবৈচিত্র্যও তেমন পরিলক্ষিত হয় না। তবে একটা দেশের আবহাওয়া বা জলবায়ু নির্ধারণে শুধু নিরক্ষরেখার সাপেক্ষে এর অবস্থান নয়, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যও বিবেচনায় আনতে হয়। বিচিত্র ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ইকুয়েডরের আবহাওয়াও বিচিত্র। ইকুয়েডরের বেশকিছু অংশে রয়েছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা। উচ্চতার কারণে ইকুয়েডরের এই অঞ্চলগুলোতে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। নিরক্ষীয় জলবায়ুর প্রভাবে ইকুয়েডরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অবিরাম বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে এখানে গড়ে উঠেছে ঘন সবুজ রেইনফরেস্ট, যা বিখ্যাত আমাজন রেইনফরেস্টের অংশ।
এ অঞ্চলের আবহাওয়া প্রচণ্ড উষ্ণ আর আর্দ্র। উপকূলীয় অঞ্চলে আবার উষ্ণ আবহাওয়ার সাথে রয়েছে শুষ্ক বর্ষাকাল। এই রকমারি আবহাওয়ার কল্যাণে ইকুয়েডরের জীব-বৈচিত্র্য দারুণ সমৃদ্ধ, যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ। বাহারি আবহাওয়া বা প্রকৃতির অপরূপ সুষমা ছাড়াও ইকুয়েডরের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আন্দিজের বাঁকে বাঁকে নানান আদিবাসীদের নিস্তরঙ্গ জীবনে কিংবা শহরের কোলাহলমুখর আয়োজনে সযত্নে লালিত হয় সেইসব ঐতিহ্য। ইতিহাসেও পিছিয়ে নেই ইকুয়েডর। ল্যাটিন আমেরিকার একসময়ের প্রতাপশালী ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন ধারণ করে আছে দেশটি। স্প্যানিশ উপনিবেশের সময়ে নির্মিত নানা চার্চ, মঠ এবং স্প্যানিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাড়িঘরের দেখা মেলে ইকুয়েডরে। পাঠক, আজকের আয়োজন অনন্য ইকুয়েডরের সেরা কিছু পর্যটন আকর্ষণ নিয়ে।
কিটো
ইনকা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপর সতের শতকে স্প্যানিশদের নির্মিত শহর কিটো দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক কেন্দ্র। ইকুয়েডরের রাজধানী এই শহরটি দেশটির উত্তরের উচ্চভূমিতে গোয়াইলাবাম্বা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। সুউচ্চ পিচিঞ্চা আগ্নেয়গিরির পূর্বে সুদীর্ঘ এক মালভূমির উপর শহরটি নির্মিত হয়। এটি নিরক্ষরেখার সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থিত শহর। ২৮২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরটি পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজধানী। কিটো থেকে পিচিঞ্চার তুষারঢাকা চূড়া চোখে পড়ে।
সক্রিয় এই আগ্নেয়গিরি কিটোকে যে শুধু বাড়তি সৌন্দর্য উপহার দিয়েছে, তা-ই নয়, সাথে দিয়েছে অগ্নুৎপাতে ভস্মীভূত হওয়ার আতঙ্কও! নিরক্ষরেখার কাছের শহর হলেও উচ্চতার কারণে এখানে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। বলা হয়, কিটোতে একদিনে চারটি ঋতু প্রত্যক্ষ করা যায়- মৃদু কুয়াশাঢাকা বসন্তের প্রভাত, উষ্ণ দুপুর আর শীতল রাত। বর্ষাকাল হলে দেখা মিলবে বৃষ্টিভেজা বিকেলেরও!
কিটো শহরকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। দক্ষিণ অংশটি শিল্প ও আবাসিক এলাকা। উত্তর অংশটি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা আর আলো ঝলমলে শপিংমলে ঠাসা আধুনিক কিটো। আর শহরের কেন্দ্র রয়েছে পুরনো শহর বা হিস্টোরিক সেন্টার। এই অংশটিই কিটোর মূল আকর্ষণ। এখানে রয়েছে ৪০টি চার্চ, ১৭টি নগরচত্বর আর ১৬টি মঠ। এই এলাকার ঔপনিবেশিক ও স্বাধীনতা পরবর্তী স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের কারণে একে বলা হয় ‘আমেরিকার স্মৃতির আধার’। ইউনেস্কোর সর্বপ্রথম ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটগুলোর মধ্যে পুরনো কিটো অন্যতম। কিটোর প্রাচীন বা অর্বাচীন স্থাপনাগুলোতে লক্ষ করা যায় ইউরোপীয়, ম্যুরিশ, ঔপনিবেশিক ও দেশীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ।
কিটোর সবচেয়ে সুন্দর চার্চ হচ্ছে দ্য চার্চ অব কোম্পানিয়া দ্য জেসাস। এর সৌন্দর্যের মূলে রয়েছে এর স্বর্ণখচিত চোখ-ধাঁধানো অভ্যন্তরভাগ। স্প্যানিশ বারোক রীতিতে তৈরি হয়েছে এই চার্চটি। কিটোর সবচেয়ে বড় চার্চটির নাম ব্যাসিলিকা দেল ভোটো নাসিওন্যাল।
বিশাল এই চার্চটি ফ্রান্সের বোর্জ ক্যাথেড্রালের অনুকরণে নির্মিত। দ্য চার্চ এন্ড মনেস্ট্রি অব স্যান ফ্রান্সিসকো কিটোর সবচেয়ে প্রাচীন চার্চ। এই চার্চটির ভেতরে রয়েছে বেশকিছু চার্চ, কনভেন্ট ও মিউজিয়াম। কিটোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপূর্ব সুন্দর চার্চ হচ্ছে ক্যাথেড্রাল দ্য কিটো। কিটোর পুরনো শহরের পাশেই অবস্থিত বিশাল একটি পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় শোভা পাচ্ছে মাতা মেরির ডানাওয়ালা প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতিটি দেখলে মনে হবে যেন কিটোর নীল আকাশে ওড়ার জন্য মাতা মেরি মনের আনন্দে ডানা মেলে দিতে যাচ্ছেন।
বিচিত্র পাহাড়ের নাম এল পেনিসিলো। শহরের বেশিরভাগ জায়গা থেকেই মূর্তিমাথায় দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়টি চোখে পড়ে। কিটোর ঠিক মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া নিরক্ষরেখার স্মরণে নিরক্ষরেখার মাত্র ২৪০ মিটার দূরে নির্মিত হয়েছে এই স্থাপনা সিউদাদ মিটাড দেল মান্ডো।
এখানে দাঁড়িয়ে একইসাথে আপনি পা রাখতে পারবেন উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে। কিটোর প্রধান নগরচত্বর ইন্ডিপেন্ডেন্স স্কয়ার আরেকটি দেখার মতো জায়গা। ব্যস্ত এই চত্বরে ভিড় জমায় আয়ুর্বেদিক ওষুধ বিক্রেতা শামান, গায়ক-বাদক সহ বিবিধ পেশার লোকজন। কিটো ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে এর জনবহুল রাজপথ আর নগরচত্বরে হেঁটে হেঁটে দর্শনীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্য অবলোকন করা।
কটোপ্যাক্সি
কটোপ্যাক্সি আন্দিজ পর্বতমালার অন্তর্গত একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। ৫৮৯৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরিটি ইকুয়েডরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীর অন্যতম উঁচু আগ্নেয়গিরি। তুষারঢাকা শুভ্র চূড়ার অপরূপ এই আগ্নেয় পর্বতটি দেখলে মনেই হয় না, জেগে উঠলে এটি কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।
কটোপ্যাক্সি প্রথম অগ্ন্যুৎপাত করে ১৭৩৮ সালে। তারপর থেকে ক্যাটোপ্যাক্সির বুক থেকে আগুন ঝরেছে ৫০ বার। শেষবার ২০১৫ সালে অগ্নিবর্ষণ করেছিল আগ্নেয়গিরিটি। ১৮৭৭ সালের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত লাভার স্রোত ষাট মাইল রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে। আশেপাশের এলাকা বহুবার এই আগ্নেয়গিরির ভয়ঙ্কর থাবায় বিপর্যস্ত হয়েছে। রাজধানী কিটো থেকে মাত্র ৫০ কি.মি. দূরে কটোপ্যাক্সি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কিটো থেকে কটোপ্যাক্সির মোচাকৃতির চূড়া চোখে পড়ে৷ ৫০০০ মিটার উচ্চতায় কটোপ্যাক্সিতে বেশকিছু হিমবাহ রয়েছে। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে কটোপ্যাক্সির চূড়ায় উঠতে পারা পর্যটকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।
গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ
প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জ এখানকার বেশকিছু প্রজাতির প্রাণীর জন্য বিখ্যাত। ১৮টি বড় এবং তিনটি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জ। গ্যালাপোগাস দ্বীপ এবং আশেপাশের সামুদ্রিক এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছে গ্যালাপোগাস ন্যাশনাল পার্ক এবং গ্যালাপোগাস মেরিন রিজার্ভ। ১৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি অধ্যুষিত এই আগ্নেয় দ্বীপপুঞ্জের নিরক্ষরেখার একদম উপরে অবস্থিত আগ্নেয়গিরিগুলো অগ্ন্যুৎপাত করেছে অনেকবার।
নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ার এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেশি। ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া দ্বীপগুলোতে সারাদিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়। গ্যালাপোগাসের দ্বীপগুলো ক্যারিবিয়ানের দ্বীপের মতো গাঢ় সবুজে ছাওয়া কোন স্বর্গরাজ্য নয়, বরং গ্যালাপোগাসের বেশিরভাগ দ্বীপই অনেক রুক্ষ। তবে এর ভঙ্গুর ইকোসিস্টেমে যে প্রাণী-বৈচিত্র্য দেখা যায় তা যেন রূপকথাকেও হার মানায়। গ্যালাপোগাসের প্রধান আকর্ষণ এর দানবাকৃতির গ্যালাপোগাস কচ্ছপ।
এই কচ্ছপের নামানুসারেই দ্বীপের নাম রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে গ্যালাপোগাস পেঙ্গুইন, সী লায়ন, অ্যালবেট্রস, নীল পায়া সামুদ্রিক হাঁস, পাখাহীন করমোরেন্ট, সামুদ্রিক ইগুয়ানা ইত্যাদি। প্রথম গ্যালাপোগাস আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে যখন পানামার চতুর্থ বিশপ পেরুর উদ্দেশে যাত্রা করেন ফ্রান্সিসকো পিজেরো আর তার লেফটেন্যান্টদের মধ্যে বিবাদ বাঁধানোর আশায়। পথে জাহাজডুবি হয় এবং তারা আশ্রয় নেন এই দ্বীপে।
১৫৩৫ সালের কথা। উনিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত দ্বীপগুলো স্প্যানিশদের ধনসম্পদবাহী জাহাজগুলো লুট করে লুকানোর জন্য ব্যবহার করতো ইংরেজ জলদস্যুরা। পরে ইকুয়েডর ১৮৩২ সালে গ্যালাপোগাস দখল করে নেয়। তবে গ্যালাপোগাস পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে মূলত ১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইনকে নিয়ে এইচএমএস বিগল এখানে এসে নোঙ্গর করার পর। ডারউইন এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করে অরিজিন অভ স্পিসিস থিওরি প্রদান করেন। যেকোনো প্রকৃতিবিদের জন্য নিঃসন্দেহে স্বপ্নের গন্তব্য গ্যালাপোগাস।
কোয়েঙ্কা
সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার কোলে অবস্থিত কোয়েঙ্কা শহরটি ইকুয়েডরের অন্যতম চিত্তগ্রাহী শহর। এটি ইকুয়েডরের আজুয়ে প্রদেশের রাজধানী এবং ইকুয়েডরের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহরটি দক্ষিণ সিয়েরা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রও বটে। আমাজনের চারটি শাখানদীর মোহনায় অবস্থিত কোয়েঙ্কা ২৫৬০ মিটার উঁচু। প্রাচীন সব চার্চ ও স্থাপনার কল্যাণে কোয়েঙ্কা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে। শহরের কেন্দ্রীয় পার্ক ক্যালেডেরনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রধান চার্চ দ্য নিউ ক্যাথেড্রাল।
তিনটি আকাশি নীল রঙের সুদৃশ্য গম্বুজ চার্চটিকে আকর্ষণীয় করে তু্লেছে। গোলাপি মার্বেলের মেঝে আর ভেতরটা কাঁচ দিয়ে সুশোভিত এই চার্চের। চার্চটির পাশেই রয়েছে পুরনো ক্যাথেড্রাল। এখন এটি মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়েছে। কোয়েঙ্কার আরেকটি অসাধারণ মিউজিয়াম হচ্ছে মুসিও দেল বাংকো সেন্ট্রাল এন্ড পুমাপানজো। এই মিউজিয়ামটি সংরক্ষণ করেছে ইকুয়েডরের জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস। শহরের আমাজন চিড়িয়াখানাও পর্যটকদের কাছে বেশ উপভোগ্য স্থান।
দক্ষিণ আমেরিকার বন্যপ্রাণীদের বিশাল এই সংগ্রহ যে মানুষের মনোরঞ্জন করবে, তা বলাই বাহুল্য। মূল শহর থেকে ৩০ কি.মি. পশ্চিমে রয়েছে কাজাস ন্যাশনাল পার্ক। কাজাসে দেখতে পাবেন, ঘন সবুজের চাদরাবৃত উঁচু উঁচু গাছগুলো সাদা মেঘের স্তর ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে। এই গাছগুলো যে বন তৈরি করে, তাকে বলে ক্লাউড ফরেস্ট। পার্কে হাঁটার সময় হঠাৎই চোখে পড়বে কোন কনডোর ডানা মেলে দিয়েছে আকাশে, কানে আসবে হামিং বার্ডের মধুর গুঞ্জন। হামিং বার্ডের শরীরের রঙের খেলা আপনার মন জুড়াবেই।
মন্টানিটা বীচ
ইকুয়েডরের দক্ষিণ উপকূলের ছোট্ট একটি শহর মন্টানিটা। ছোট মন্টানিন্টা শহরের বড় আকর্ষণ এর অনন্যসাধারণ সৈকত। মন্টানিটার সৈকত ইকুয়েডরের সেরা সৈকতগুলোর একটি। এই সৈকতের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানকার সাগরের শক্তিশালী ঢেউ। বিশাল সব ঢেউয়ের কারে সারাবিশ্বের সার্ফারদের তীর্থ হয়ে উঠেছে এই সৈকত ।
দক্ষ সার্ফাররা এখানে ঢেউয়ের সাথে খেলতে মজা পেলেও নতুন সার্ফারদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং মন্টানিটা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে একটি সার্ফিং স্কুল আছে, যারা আগ্রহী পর্যটকদের সার্ফিং শেখায়। শুধু সৈকতই নয়, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা প্রত্যক্ষ করার জন্যও মোক্ষম জায়গা মন্টানিন্টা। ১৯৬০-৭০ এর দশকে বিদেশ থেকে হিপ্পি এবং স্থানীয় জেলেদের সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে ওঠে শহরটি। নানাদেশী হিপ্পিদের আখড়া তাই এই শহরটি। মন্টানিন্টার সৈকতে সার্ফিং ছাড়াও সময় কাটানোর মতো মজার কাজের অভাব নেই। চাইলে এখানে স্কুবা ডাইভিং, মাছ ধরা, পাখি দেখা- সবই করা যাবে।
টেনা
আমাজন রেইনফরেস্টের মাঝখানে অবস্থিত শহর টেনা ইকুয়েডরের ন্যাপো প্রদেশের রাজধানী। মিশনারি অভিযাত্রীদের প্রতিষ্ঠিত এই শহরটি ইকুয়েডরের ‘দারুচিনি রাজধানী’ নামে খ্যাত। তো দারুচিনির এই শহরে অভিযান, দারুচিনি দ্বীপে অভিযানের চেয়ে কোন অংশেই কম রোমাঞ্চকর হবে না! আমাজনের ঘনসবুজ অরণ্যে অ্যাডভেঞ্চার যে কারো জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত। আর টেনাতে মিলবে সেই সুযোগ।
প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে বনের ভেতর বয়ে চলা নদীগুলো প্রচণ্ড খরস্রোতা। দুধসাদা এই স্রোতস্বিনীগুলোতে কায়াকিং বা রাফটিং খুবই জনপ্রিয়। সেইসাথে বন আর বন্যপ্রাণীদের দেখার আনন্দ তো আছেই।
আন্দিজের একদম প্রান্তে অবস্থিত টেনা ঘনবনে ঢাকা পাহাড়ে বেষ্টিত। শহরের প্রবেশপথে রয়েছে স্প্যানিশ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াকু বীর জুমান্ডির মূর্তি। শহর থেকে একটু দূরে মিসাহোয়ালিতে দেখতে পাওয়া যায় বিখ্যাত ক্যাপুচিন বানর।
শহরের ভেতরে বেশকিছু পার্ক আছে। নির্জন পার্কের নীরব-নিস্তব্ধ পথে মায়াবী প্রকৃতির সান্নিধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আশ্চর্য প্রশান্তিতে ভরে যাবে আপনার মন, মনে হবে, বেঁচে থাকা সত্যিই দারুণ ব্যাপার।
ডেভিলস নোজ
উনিশ শতকে ইকুয়েডরের অবকাঠামো উন্নয়নের সময় প্রেসিডেন্ট ইলয় আলফারো চেয়েছিলেন, রাজধানী কিটো আর উপকূলীয় শহর গুয়াকুইলকে রেলযোগে সংযুক্ত করতে। কিন্তু কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। রেললাইনের পথে ছিল বিপদজনক খাড়া পাহাড়, নদী, ক্লাউড ফরেস্ট ইত্যাদি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট দমলেন না। বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনা হাজার হাজার নির্মাণকমীকে দিয়ে শুরু করলেন রেলপথ নির্মাণের কাজ এবং অসাধ্য সাধন করে বানিয়ে ফেললেন সেই পথ। সেই সময়ের অনুন্নত ইঞ্জিনিয়াংয়ের তৈরী সেরা দৃষ্টান্ত এই রেলপথ। কিংবদন্তি বলে, এজন্য তাকে নাকি শয়তানের সাথে চুক্তি করতে হয়েছিল। ফলে ভূমিধ্বস, সাপের কামড় আর রোগশোকে মারা যায় ৪০০০ কর্মী। এজন্যই রেলপথটির নাম হয়েছে ডেভিলস নোজ।
আপনি ট্রেনপ্রেমী হোন বা না হোন, এই রেলপথে ভ্রমণ আপনার ভালো লাগবেই। আন্দিজের রহস্যময়তাকে ছুঁতে চাইলে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর পাবেন না। ডেভিলস নোজে ভ্রমণ করতে চাইলেন আপনাকে যেতে হবে আন্দিজের ছোট্ট শহর আলৌসিতে। এখান থেকে শুরু হয়ে রেলপথটি শুরু হয়েছে আরেক শহর সিবাম্বেতে।
আঁকাবাঁকা রেলপথ ধরে যাওয়ার সময় আন্দিজের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আপনাকে শিহরিত করবে। পর্বতের নির্জনতার মাঝে বাতাস কেটে ট্রেনের ছুটে চলা আপনার হৃদয়ে একাকিত্বের হাহাকার সৃষ্টি করবে। সিবাম্বের কাছাকাছি এলে ধ্যানের মধ্যে শুনতে পাবেন, কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এক অচেনা সুর। ট্রেন সিবাম্বতে এসে থামলে অবশেষে আপনার ধ্যান ভঙ্গ হবে । ট্রেন থেকে নামলে আপনাকে স্বাগত জানাবে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত আদিবাসী নৃত্যশিল্পীদের দল। সিবাম্বেতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হওয়া ছাড়াও জানতে পারবেন আদিবাসীদের বিচিত্র জীবনধারা সম্পর্কে। সিবাম্বে থেকে আলৌসি ফেরার পথে আবারো হারানো আন্দিজের প্রেমে, সবুজের মোহে কিংবা দুর্গম গিরিপথের শিহরণ জাগানিয়া সৌন্দর্যে।
ওটাভালো বাজার
ইকুয়েডরের ইম্বাবুরা প্রদেশের ওটাভালো শহরে মূলত ওটাভালো আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের বাস। এই আদিবাসীদের উলবোনা কাপড় বেশ বিখ্যাত। কাপড়গুলো বিখ্যাত স্যাটারডে মার্কেটে বিক্রি হয়। তবে সারা সপ্তাহ ধরেই স্থানীয় দোকানগুলোতে হাতে তৈরী কাপড় বিক্রি চলতে থাকে।
ওটাভালো বাজারে কাপড় ছাড়াও নানাজাতের গয়না, নকল সংকুচিত মাথা, পার্স, মশলাসহ আরো অনেককিছু বিক্রি হয়। এই বাজারে ঘুরে আপনি ইকুয়েডরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। সারাদিন আন্দিজের পাইপ সঙ্গীত, স্থানীয় ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁক-ডাক আর কটন ক্যান্ডি মেশিনের শব্দে মুখরিত থাকে বাজারটি।