বিনা পয়সায় ভ্রমণ! এমন শিরোনাম দেখে অনেকটা গল্পের মতো মনে হতে পারে। প্রচলিত একটা ধারণা আছে, ভ্রমণ মানেই বাড়তি খরচ। ভ্রমণে যেতে চাইলে যাতায়াত, থাকা এবং খাওয়া মিলিয়ে বিপুল অঙ্ক পকেটে নিয়ে বের হতে হয়। কিন্তু এসব হিসাব তাদের জন্য যারা প্রমোদ ভ্রমণ করতে যান। আর যারা প্রকৃতই ভ্রমণ করতে চান, বিশ্বকে দেখতে চান এবং মানুষ চিনতে চান, তাদের জন্য অবশ্যই বিনা পয়সায় বিশ্ব ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।
এজন্য আপনাকে হতে হবে দুঃসাহসী। আপনি আরামপ্রিয় আর নাক উঁচু স্বভাবের হলে প্রথমেই এই পরিকল্পনা বাদ দিন। আর যদি সত্যিই ভ্রমণের নেশা আপনার থাকে, এবং হয়ে উঠতে চান ‘এক্সট্রিম ট্রাভেলার’ তাহলে আজকের এই লেখাটি আপনার জন্যই।
ভ্রমণ করতে হলে দরকার হয় যাতায়াত, থাকা এবং খাওয়ার খরচ। দুঃসাহসী ট্রাভেলার হলে এর সবগুলোই আপনি বিনা পয়সায় করতে পারবেন। তবে আজকের প্রতিবেদনে কেবল যাতায়াত খরচ বাঁচানোর কৌশল তুলে ধরা হলো।
এই কৌশলের নাম ‘হিচহাইকিং’। সাংঘাতিক রকমের অদ্ভুত শব্দ। অভিধান ঘাঁটলে দেখা যাবে, ‘হিচ’ অর্থ ঝাঁকি দেওয়া। অথবা বাগড়া দেওয়া। আর ‘হাইকিং’ অর্থ ভ্রমণ করা। তাহলে ‘হিচহাইকিং’ শব্দের অর্থ দাঁড়ালো বাগড়া দিয়ে ভ্রমণ করা!
হ্যাঁ, অনেকটা এমন-ই। ধরুন পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। মহাসড়কে সাঁই সাঁই করে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে। যেতে হবে অনেক দূর। ওই ট্রাকগুলোই ভরসা। তখন আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। একটা হাত সামনে বাড়িয়ে বুড়ো আঙ্গুলটা তুলে ধরতে হবে। ভ্রমণবান্ধব দেশগুলোর চালকেরা এতেই বুঝে যাবে আপনি একজন ট্রাভেলার, হিচহাইকিং করতে চান। ইচ্ছে হলে তিনি ট্রাক থামাবেন। আর আপনাকে বিশ্বাস করতে না পারলে থামাবেন না। একটা ট্রাক থামল না তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। একটু অপেক্ষা করুন। আরো একটা ট্রাক আসবে, আবার বুড়ো আঙ্গুল তুলে ধরুন। দেখবেন কোনো না কোনো ট্রাক আপনাকে তুলে নেবে। এবং এর জন্য আপনাকে কোনো ভাড়া গুনতে হবে না।
সাবধান, এই পদ্ধতিটা এখনি বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে যাবেন না। এখানে বুড়ো আঙ্গুল দেখলে চালক ক্ষেপে যেতে পারেন। সড়কে বাগড়া দেওয়ার অপরাধে আপনাকে হেনস্তাও করতে পারেন। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এই ‘হিচহাইকিং ব্যাপক প্রচলিত’। বাংলাদেশ-ভারতেও অনেক চালক পর্যটকবান্ধব, তবে বুঝিয়ে বলতে হবে ভিন্নভাবে।
এবার বলা যাক একজন হিচহাইকারের কথা। তার বাড়ি ফ্রান্স। সেখানে পড়ালেখা করেন এবং একটি ওয়াইন কোম্পানিতে চাকরি করেন। চাকরিতে ছুটি পেলে ‘হিচহাইকিং’ করে পৃথিবী ঘুরেন। মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। পল বালডি এসেছিলেন বাংলাদেশেও। এখানে এসেও একটি ভ্রমণ সংগঠনের সঙ্গে ‘হিচহাইকিং’ করেছেন।
পল বালডি ফ্রান্স থেকে মালয়েশিয়ায় যান বিমানে করে। এছাড়া নিজের গাঁটের পয়সা হিসাব করে যতদূর পেরেছেন বাসে চড়েছেন, গাড়িতে চড়েছেন। কখনো সাইক্লিং করেছেন, আবার হেঁটেও চলেছেন। তবে যেখানে সুযোগ মিলেছে, পয়সা বাঁচানোর জন্য ‘হিচহাইকিং’ করেছেন। তার ব্যাকপ্যাকে সবসময়ই একটা তাঁবু থাকে। যেখানে রাত হয়, সেখানেই এই তাঁবু মেলে স্লিপিং ব্যাগ খুলে তিনি কাঁত হয়ে যান।
ইরানের একটি অভিজ্ঞতা বলেন তিনি, “আমি ইরানে হিচহাইকিং করছিলাম। একটি ট্রাক থেকে নামলাম সিরাজ শহরে। শরীর খুব ক্লান্ত ছিল। পকেটে নগদ পয়সা ছিল না। আশপাশে এটিএম বুথও নেই। আমি বসলাম সড়কের পাশে একটা বেঞ্চিতে। চোখে ঘুম নামলো। ভাবছিলাম, এই ভারি মাথাটা কোথায় রাখা যায়। একজন এগিয়ে এলেন আমার দিকে। খুব কড়াভাবে এটা ওটা জিজ্ঞেস করলেন। শেষে খাতির হয়ে গেল তার সঙ্গে। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে তিনদিন ছিলাম।”
তাজিকিস্তানের অভিজ্ঞতা বললেন পল, “ওখানে আমি হিচহাইকিংয়ের চেষ্টা করছিলাম। তখন তাজিকিস্তানে ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। বাইরে খুব লোকজনও নেই। একটা ট্রাক আমাকে ছোট্ট গ্রামের জীর্ণ হোটেলে নামিয়ে দিল। ওখানেই দুইদিন একজন আমাকে আশ্রয় দেন। ওই সময়গুলো আমি ভুলতে পারি না।”
তিনি বললেন, “মিয়ানমার, জাপানের টোকিওতে হিচহাইকিং করার অভিজ্ঞতা দারুণ ছিল। ওইসব এলাকায় কয়েকজন গাড়িচালক আমাকে ঘুমানোর জায়গা পর্যন্ত করে দিয়েছেন। তাদের বাড়িতে রেখেছেন। খেতে দিয়েছেন, পোশাক পড়তে দিয়েছেন। নিজেদের ভ্রমণের চমৎকার গল্প শুনিয়েছেন।”
এবার বলা যাক তিয়াং লি’র কথা। এই তরুণীর বাড়ি চীন দেশে। বাংলাদেশে এসেছিলেন এক বন্ধুর প্রেমে পড়ে। প্রথম দফায় বন্ধুর সঙ্গে। এরপর আরো কয়েক দফা। তিনি নিয়মিতই ভ্রমণে বের হন এবং সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসেন। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, তার ভ্রমণের বড় অংশজুড়েই থাকে ‘হিচহাইকিং’। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে তিনি বিনা খরচায় ট্রাকে চড়ে যাননি। এমনকি গভীর রাতে, একা ট্রাক চালকের সঙ্গেও।
একজন নারী, একা ‘হিচহাইকিং’ করেছেন, তাও রাতে!
বিষয়টার ব্যাখ্যায় লি বলেন, “আসলে ব্যক্তিত্বটাই আসল। একজন ভালো ব্যক্তিত্বের লোক খুব সহজেই অন্যের ব্যক্তিত্বও আঁচ করতে পারেন। আমি যখন চালককে নিরাপদ মনে করেছি, তখনই তার সঙ্গে গাড়িতে উঠেছি। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি আমার জন্য নিরাপদই ছিলেন। আর যাকে নিরাপদ মনে হয়নি, তার গাড়িতে উঠেনি।”
তিয়াং লি বাংলাদেশে হিচহাইকিং করেননি এবং করার চেষ্টাও করেননি। যারা হিচহাইকিং করতে চান, তাদের জন্য লি বলেন, “সবার আগে মানুষ চিনতে জানতে হবে। আপনার মন যদি সায় দেয়, তাহলে মানুষটাকে বিশ্বাস করুন। আপনার ব্যক্তিত্ব এমন হতে হবে, তিনিও যেন আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেন।”
চীন দেশের তরুণী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই কথাগুলো বললেও, ‘হিচহাইকিং’-এর ঝুঁকি কিন্তু কম নয়। চালকের সঙ্গে চলতে চলতে অনেক অঘটনই ঘটে যেতে পারে। চালক আপনাকে ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে ফেলে দিতে পারে। আবার ‘হিচহাইকিং’-এর সুযোগ নিয়ে অনেক প্রতারকও চালককে বিপদের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঝুঁকিটা থাকে উভয় দিক থেকেই।
আবার পেয়ে যেতে পারেন এমন কিছু, যা আপনি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। চালক যদি বন্ধুসুলভ হয়ে থাকেন, তাহলে অপরিচিত এলাকায় তিনি হয়ে উঠতে পারেন আপনার বিশাল অবলম্বন। তার মাধ্যমেই আপনি মিশে যেতে পারেন স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে। পেতে পারেন থাকা কিংবা খাওয়ার সুবিধা। বন্ধুসুলভ চালকদের অনেকে আছেন, যারা নিজেদের দেশ দেখাতে পারলে খুশি হন। নিজেদের পছন্দের জায়গাগুলো দেখিয়ে অনেকটা ভারমুক্ত হন। ট্রাভেলারকে খুশি করানোর জন্য বিনা দ্বিধায় খরচও করে ফেলেন শত শত ডলার।
এইসব সুবিধা নিয়ে প্রতি বছর অনেক ট্রাভেলার ঘর ছাড়েন হিচহাইকিং করতে। এরা মাটির স্পর্শে থেকে মানুষের জটলায় মিশে যান। নতুন নতুন সংস্কৃতির ভেতর নিজেদের উজাড় করে দেন। কিছু দেশ আছে, যেখানে ট্রাভেলারদের জন্য হিচহাইকিং করাটাই বেশি সহজ। আর্জেন্টিনা, চিলি, তুরস্ক এবং উরুগুয়েতে এর প্রচলন অনেক। কখন গাড়ি আসবে, তার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার চাইতে ওইসব দেশে সড়কের পাশে বুড়ো আঙুল তুলে দাঁড়ানোটাই সহজ।
যেকোনো কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে। তেমনি হিচহাইকিং করতে হলে আপনার থাকতে হবে ধৈর্য এবং বুদ্ধিমত্তা। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, এই কাজটির ঝুঁকি অনেক। নারী হাইকাররা ধর্ষণের শিকারও হতে পারেন। এছাড়া পড়তে পারেন ডাকাতের খপ্পরে। সংবাদমাধ্যমে এসব নিয়ে রোমহর্ষক ঘটনার খবরও পাওয়া যায়। হিচহাইকিং নিয়ে আছে কিছু ভৌতিক গল্প। তৈরি হয়েছে সিনেমা। রোমাঞ্চকর যে কোনো কিছুতে ঝুঁকি যেমন থাকে, তেমনি থাকে আনন্দও। গা ছমছমে কোনো পরিস্থিতি থেকে উতরাতে পারলে একটা স্বস্তি তো থাকেই। এছাড়া থাকে শ্বাসরুদ্ধকর বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার আনন্দ।
মূলত এইসব অভিজ্ঞতার জন্যই পথে নামেন দুঃসাহসিক এক্সট্রিম ট্রাভেলাররা। কখনো একা, কখনো দলবল নিয়ে। তবে নিরাপত্তার বিষয়টি সবার মাথায়ই থাকে। অনেক হাইকার গাড়িতে উঠার আগে গাড়ির নাম্বার টুকে রাখেন। তারপর সেই নাম্বার এসএমএস করে রাখেন পরিচিত বন্ধুর কাছে।
যখন থেকে হিচহাইকিং শুরু, তখন অবশ্য প্রযুক্তি এতোটা উন্নত ছিল না।
সত্তরের দশকে কয়েকজন আমেরিকান ছাত্র এভাবে বিনা খরচায় ভ্রমণ করা শুরু করেন। তাদের দলটা তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারত পৌঁছে। তারা যে পথে ভ্রমণ করেছেন এই পথের নাম রাখা হয় ‘হিপ্পি ট্রেইল’।
‘হিপ্পি ট্রেইল’-এ হাইকিং করা যতটা কঠিন ছিল, এখন ততটা কঠিন নয়। সময় বদলেছে। অনেক দেশেই এই পদ্ধতিটার প্রচলন হয়েছে। সেই সুযোগটা নিতে পারেন আপনিও। বাংলাদেশে এর প্রচলন না হলেও পাশের দেশ ভারতে গিয়ে অনেক পশ্চিমা দুঃসাহসিক ‘হিচহাইকিং’ করেন। তারা জানান, ভারত ও পাকিস্তানে ‘হিচহাইকিং’ পরিচিত না হলেও হাত তুলে দাঁড়ালে খুব একটা বিমুখ হতে হয় না। একজন জানান, হাইকাররা হাত তুলে দাঁড়ালে পাকিস্তানের চালকরা কিছুটা অবাক হন। তারপর সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। শেষে নামিয়ে দেওয়ার সময় কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন, পরে যেন এমনটা না করে। কারণ সব চালক তার মতো ভালো হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
কিন্তু এক্সট্রিম ট্রাভেলাররা এইসব উপদেশ শুনেন না। কারণ এরা ঝুঁকি নিতেই অভ্যস্ত।