সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে জাপান এক আকর্ষণীয় দেশ। দেশটির যেমন রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, তেমনি তার অনিন্দ্যসুন্দর ভূ-সৌন্দর্য, বিস্ময় জাগানিয়া নানা স্থাপত্যকর্ম আর রয়েছে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তাই প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক জাপান ভ্রমণে আসেন।
জাপানের চারটি দ্বীপের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ও কম বসতিপূর্ণ একটি দ্বীপ হচ্ছে শিকোকু। প্রায় ১৮,৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দ্বীপটি বিস্তৃত। দ্বীপেরই ছোট এক উপত্যকা লিয়া। এই দুর্গম পার্বত্য এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে দ্বীপের প্রধান নদী য়োশিনো। উপত্যকারই পাদদেশে গড়ে উঠেছে অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা ছবির মতো এক গ্রাম নাগোরা। গ্রামটিতে লোকজন তেমন নেই। একসময় এখানে ৩০০ জনের মতো বাসিন্দা ছিল।
এমনিতেই জাপানের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। নাগোরা গ্রামটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এক তথ্যমতে, ২০১৫ সালে গ্রামটিতে লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ এবং ২০১৬ সালে তা কমে ৩০-এ দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে এ গ্রামে ২৭ জন বাসিন্দা আছেন, যাদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সী ব্যক্তির বয়স ৫০ বছর। বেশিরভাগই বয়োবৃদ্ধ। গ্রামের অধিকাংশ জনগণ হয় মারা গেছেন, নয়তো অন্যত্র চলে গেছেন। গ্রামটিতে কমবয়সী লোকজন নেই বললেই চলে।
শিকোকু দ্বীপ থেকে বেশ দূরে উপত্যকা সংলগ্ন গ্রামটি অবস্থিত হওয়ায় এই গ্রামে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। দিনে একবার গ্রামের পথে হাতেগোনা কয়েকটি বাস চলাচল করে, আবার কখনো কোনো বাসই এ পথে যাওয়া-আসা করে না। কাছের রেল স্টেশন থেকে গ্রামে পৌঁছতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
গ্রামের যুবকেরা উচ্চতর পড়াশোনা ও আর্থিক সচ্ছলতার জন্য জাপানের বড় বড় শহরগুলোতে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছে। গ্রামে ফিরে আসার তেমন কোনো আগ্রহই তাদের নেই। ফলে গ্রামে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন তা শূন্যের কোঠায়।
বছরে একবার আত্মীয়-পরিজনদের দেখতে কেউ কেউ শহর থেকে গ্রামে আসেন। সময়ের অভাবে অনেকে আসতেও পারেন না।
এমন সুন্দর গ্রামে তেমন কোনো লোকজন নেই- তা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না গ্রামেরই এক বাসিন্দা সুকিমি আইয়ানো। বয়স ৬৭-এর কাছাকাছি। শৈশবে আইয়ানোর পরিবার-পরিজন সহ তিনশোরও বেশি অধিবাসী এ গ্রামে বাস করতেন। পড়াশোনার জন্য এ গ্রাম ছেড়ে নিকটবর্তী শহর ওসাকাতে আইয়ানোকে চলে যেতে হয়েছিল।
ওসাকাতে দীর্ঘ ১১ বছর কাটিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে দেখাশোনার জন্য ২০০২ সালে তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন। ফিরে এসে দেখতে পান, গ্রামের পুরনো অনেকেই আর বেঁচে নেই। তার বাড়ির পাশের প্রতিবেশীরাও তার আসার কিছুদিন আগেই মারা গেছেন।
শৈশবের সেই দেখা গ্রামের সাথে এ গ্রামকে যেন কিছুতেই মেলাতে পারেন না আইয়ানো। পুরো গ্রাম ঘুরেও কোনো পরিচিত মুখ খুঁজে পান না। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবহীন গ্রামটি তার কাছে যেন এক শ্মশানপুরী মনে হতে লাগলো।
একদিন নিজের বাগানের জন্য তার বাবার আদলে একটি কাকতাড়ুয়া তৈরি করতে গিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন, এভাবে পুরো গ্রামটি যদি মানুষ পুতুলে ভরে তোলা যায়, তাহলে মনুষ্যবিহীন গ্রামটিতে মানুষের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ হতে পারে। সেই থেকে শুরু আইয়ানোর পুতুল তৈরির কাজ।
গ্রামের সেসব চলে যাওয়া এবং মারা যাওয়া মানুষদের একসময়ের উপস্থিতি স্মরণ করে তিনি একের পর এক পুতুল তৈরি করতে থাকেন।
২০০৩ সালে আইয়ানো তার কৃষিজমির জন্য প্রথম কয়েকটি পুতুল তৈরি করেন। এরপর তার প্রতিবেশীর মুখের আদলে তৈরি করেন আরও কয়েকটি পুতুল। সেগুলো প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে এমনভাবে রাখলেন, যেন পুরনো দিনের মতোই সেই প্রতিবেশী তার সাথে বাক্যালাপ করছে বলে মনে হয়।
এভাবে একের পর এক তৈরি করতে লাগলেন মানুষের আদলে পুতুল। শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সব ধরনেরই পুতুল তৈরি করতে লাগলেন। ক্রমেই পুরো গ্রাম বিভিন্ন বয়সী পুতুলে ভরে উঠতে লাগলো।
এক সময় গ্রামে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাকে তা ছাড়িয়ে গেলো। বর্তমানে গ্রামটি পুতুলের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত দশ বছরে আইয়ানো প্রায় সাড়ে তিনশো’র বেশি পুতুল তৈরি করেছেন।
গ্রামে যে-ই আসেন, সেই গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী পুতুল দেখে তাজ্জব বনে যান। গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে যায় ফসলের মাঠে কোনো ব্যস্ত কৃষকরূপী পুতুলকে। নদীর ধারে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়বে ঢিলে-ঢালা প্যান্ট আর চেক শার্ট গায়ে, মাথায় টুপি পরিহিত একজন পুতুল মাছ ধরায় ব্যস্ত, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন সত্যিকার এক মানুষ।
ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে গ্রামের একমাত্র স্কুলটি সে কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলে শোনা যায় না আগের সে কোলাহল। ধুলোবালি, মাকড়সা আর পোকামাকড়েরা সেই স্কুলবাড়িতে বসতি করেছে। জঙ ধরে গেছে স্কুল ঘণ্টাতে।
বিষয়টি আইয়ানোকে খুব নাড়া দেয়। তিনি স্কুলের ক্লাসরুমগুলোকে পুতুলে ভরিয়ে তুললেন।
প্রতিটি ক্লাসরুমের বেঞ্চে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে এক দল পড়ুয়া। পড়ুয়াদের সামনে বই, খাতা। ছাত্রদের কেউ কেউ পেন্সিল দিয়ে খাতায় শিক্ষকের নোট নিতে ব্যস্ত। কেউ বা গভীর মনোযোগ সহকারে আঁকার খাতায় দাগ কাটছে। গম্ভীর মুখে ক্লাস নিচ্ছেন স্কুলের শিক্ষক। আইয়ানো পুতুলগুলোকে এমনভাবে তৈরি করেছেন, যেন মনে হবে বাস্তব কোনো ক্লাসরুম। এখন স্কুলে সবই রয়েছে, শুধু নেই কোলাহল।
আইয়ানো কীভাবে তৈরি করেন এই পুতুলগুলো? তার কথায়, তিনি হাতের কাছে যা পান, তা-ই দিয়ে পুতুলগুলো তৈরি করেন।
তবে পুতুল তৈরির চেয়ে পুতুলের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিভিন্ন বয়সী মানুষের মুখের গড়ন ও তাদের মুখের অনুভূতি ভিন্নরকম হয়ে থাকে। একজন যুবকের মুখের অভিব্যক্তির সাথে একজন বৃদ্ধের মুখের অভিব্যক্তি কিছুতেই মেলানো সম্ভব নয়। তেমনই একজন গৃহিণীর মুখের আদল, আর একজন শিক্ষকের মুখের আদল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মানুষের বয়সের কারণে তার চেহারা এবং পোশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন বয়সী পুতুল তৈরির সময় বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়েছে বলে আইয়ানো এক সাক্ষাৎকারে জানান।
প্রতিটি পুতুল তৈরির পর তিনমাস নিজের কাছে রাখেন আইয়ানো। পরে সেই কাঠামোর ওপরেই তৈরি হয় নতুন এক পুতুল। এই পুতুলগুলো তার সন্তানতুল্য। আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবহীন গ্রামে পুতুলগুলো নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন তার পুতুলের সংসার।
পূর্বে নাগোরা একটি সাধারণ গ্রাম ছিল। গ্রামটি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ২০১৪ সালে একজন জার্মান চিত্রনির্মাতা ফ্রিৎজ শুম্যান আইয়ানোর কাজ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তিনি সেই তথ্যচিত্রে নাগোরা গ্রামকে পরিচয় করিয়ে দেন ‘ভ্যালি অফ ডলস’ নামে।
আইয়ানোর শিল্পকর্ম আর সাথে ছবির মতো সাজানো গ্রামটি বিশ্বের পর্যটকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। তারপর থেকেই এই গ্রামের আমূল পরিবর্তন হতে থাকে। দেশ বিদেশের অনেক চিত্রসাংবাদিক গ্রামটিতে আসতে শুরু করেন। সাথে বিভিন্ন বয়সী পর্যটকও।
গ্রামটি ঘুরতে গেলে দেখতে পাবেন গ্রামের পুতুলরূপী মানুষেরা ব্যস্ত তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে। যেমন, টুপি মাথায় কোনো নির্মাণ শ্রমিক রাস্তা মেরামতে ব্যস্ত, নদীর ধারে ছায়া-নিবিড় গাছের তলায় বসে নববিবাহিত দম্পতি পাশাপাশি বসে প্রকৃতির শোভা উপভোগরত, গ্রামের বাজারে কেউ কেউ তরিতরকারি নিয়ে বসে আছে খদ্দেরের আশায়, কয়েকজন বয়স্ক মানুষ বাগান পরিচর্যা শেষে ক্ষণিকের বিশ্রামের জন্য চেয়ার পেতে বসে আছেন।
এসবই ব্যস্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি হলেও, তা সবই করছে মানুষরূপী পুতুলেরা। তাই সেখানে নেই কোনো শোরগোল, নেই উত্তেজনা। সারা গ্রামেই যেন নিঃশব্দ, কোলাহলবিহীন এক পরিবেশ।
গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহের রবিবার এই গ্রামে পুতুল উৎসব পালিত হয়ে আসছে। অনেক পর্যটকই সেসময় গ্রামটিতে আসেন। তারা আইয়ানোর বাড়িতে তার সৃষ্ট শিল্পকর্ম দেখার জন্য উদগ্রীব থাকেন।
ওসাকা-তে আবার ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে কিনা জানতে চাইলে আইয়ানো বাকি জীবনটা এই পুতুলদের সাথেই কাটিয়ে দিতে চান বলে সাংবাদিকদের জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও জানান,
“আমি আমার অসুস্থ বাবার দেখাশোনার জন্যই এখানে ফিরে এসেছিলাম। যদি আমি অসুস্থ হই বা খুব বৃদ্ধ হয়ে পড়ি, তবেই ওসাকাতে আমার সন্তানদের কাছে ফিরে যাওয়া হতে পারে। অন্যথায় আমি যতদিন সুস্থ থাকি, এই গ্রামেই এসব পুতুলদের মাঝেই কাটাতে চাই।”