গেরেজা আয়াম হলো ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মেজল্যাং অঞ্চলের অন্তর্গত একটি প্রার্থনাগৃহ। একে শুধুমাত্র প্রার্থনাগৃহ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, কারণ এই বিশেষ কাঠামোটির প্রতিষ্ঠাতা ডেনিয়েল আলমসজাহ কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের জন্য এই ভবনটি নির্মাণ করেননি।
যদিও তিনি নিজে খ্রিস্টান ছিলেন, তবুও তিনি সকল ধর্মাবলম্বীর জন্য এটি একটি প্রার্থনাগৃহ হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তবে তার উদ্দেশ্য ঠিক সেভাবে সফল হয়নি। আসুন আজ গেরেজা আয়াম সম্পর্কে জানা যাক।
ইতিহাস
গেরেজা আয়ামের প্রতিষ্ঠার পেছনের কাহিনীটি বেশ অদ্ভুতই বলা চলে। ডেনিয়েলের স্ত্রী ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের মেজল্যাং অঞ্চলের একজন বাসিন্দা ছিলেন। স্ত্রীর বাসা সেখানে হওয়ায় ডেনিয়েল বেশ অনেকবারই সে অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছেন, আশপাশটা ভালো করেই দেখেছেন। আর বলতে বাকি থাকে না, সে অঞ্চলটি এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কল্যাণে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত একটি জায়গা হিসেবে সমাদৃত।
একদিন রাতে, সেখান থেকে প্রায় শত মাইল দূরের জাকার্তায় অবস্থানকালে ডেনিয়েল একটি স্বপ্ন দেখেন বা তার ভাষ্যমতে ‘দৈবদর্শন‘ পান। তিনি দেখেন, একটি পায়রা একটি পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছে; এবং একটি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তাকে পরিষ্কারভাবে বলছে মেজল্যাং অঞ্চলের পাহাড়ের কাছে এমন একটি প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করতে, যেখানে বিশ্বের সকল মানুষ আসতে পারবে এবং প্রার্থনা করতে পারবে।
ডেনিয়েল আলমসজাহ অনেক চেষ্টা করলেন সেই দর্শনটি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার, কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তা ভুলতে পারছিলেন না।
দৈবদর্শন যখন সত্যি মনে হলো
এভাবে কেটে যায় একটি বছর। পরের বছর ১৯৯০ সালে ডেনিয়েল আবার মেজল্যাং অঞ্চল বেড়াতে যান। এ সময় তার সাথে একজন কর্মচারী ছিলো যে নিজেও ছিলো সে অঞ্চলের বাসিন্দা। তারা দুজনে সেবার বেড়াতে যান অঞ্চলটির রেমা পাহাড়ে। সেখানে পৌঁছে আলমসজাহ যারপরনাই অবাক হয়ে যান। কারণ তিনি তার দৈবদর্শনে যে জায়গাটি দেখেছিলেন, স্থানটি ছিলো হুবহু তেমনই দেখতে!
এরপরে সেই পুরনো দর্শনটি তার মাথায় একদম পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নেয়। কোনোক্রমেই ভুলতে পারছিলেন না বিষয়টি। সমাধান পাওয়ার জন্য তিনি বাইবেল খুলে বসেন এবং পড়তে শুরু করেন।
তিনি পড়তে পড়তে বাইবেলের ইসিয়াহ এর ২.২ নম্বর চরণে আসেন, যেখানে লেখা “শেষ সময়ের দিনগুলোতে ঈশ্বরের মন্দিরের পর্বত প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বত হিসেবে; এটি প্রতিষ্ঠিত হবে পাহাড়ের উপরে এবং সকল জাতি সেখানে বহমান হবে।” এটি পড়ার পর ডেনিয়েল আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে, এতদিন তিনি যে দৈবদৃশ্য দেখে আসছিলেন সেটা কোনো অমূলক বিষয় ছিলো না; এটি আসলে ঈশ্বরেরই কোনো সরাসরি নির্দেশ ছিলো।
গেরেজা আয়ামের নির্মাণকাজ
তার দু’সপ্তাহ পর তিনি রেমা পাহাড়ের উপরের দিকে একটি জমি কিনে নেন। স্থানীয় জমিদাররা পাহাড়টির ৩,০০০ বর্গ মিটার জমি মাত্র ২ মিলিয়ন রুপিয়াহতে (প্রায় ১২,০০০ টাকা) দিয়ে দেন ডেনিয়েলকে। তারপর সেখানে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন তিনি। নিজের দৈবদর্শন অনুযায়ী তিনি চেয়েছিলেন তার সেই প্রার্থনাগৃহ হবে সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষই এখানে আসতে পারবেন এবং নিজ নিজ প্রার্থনার কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন। এমনকি নাস্তিকদের জন্যও মন্দিরটির দরজা খোলা ছিলো। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য একটি সাধারণ প্রার্থনাগৃহ হিসেবেই গেরেজা আয়ামকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন ডেনিয়েল।
কিন্তু যখন থেকে তিনি নির্মাণের কাজটি শুরু করে দেন তখন থেকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকেন। ডেনিয়েল ছিলেন একজন খ্রিস্টান এবং আশেপাশের সকল মানুষজন ছিলো মুসলমান। তারা কখনোই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় একজন খ্রিস্টানের এমন প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ মেনে নিতে পারেননি। আর নিজেদের মসজিদ ছেড়ে সেখানে প্রার্থনা করতে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
অনেকে ডেনিয়েলের এমন প্রার্থনাগৃহ নির্মাণকে চার্চ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে গণ্য করে অনেক অভিযোগ প্রেরণও করেছিলো। প্রতিদিন সেই অভিযোগের পরিমাণ বেড়েই চলছিলো, যা ডেনিয়েলের নির্মাণকাজকে অনেকটাই স্থবির করে দেয়। ২০০০ সাল নাগাদ ডেনিয়েল অর্থ সংকটে পড়েন। ফলে নির্মাণকাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অর্থের অভাবে তিনি কোনো কেয়ারটেকারও রাখতে পারেননি। ফলে তার নির্মাণাধীন পুরো ভবনটি ভগ্নদশায় পরিণত হয়।
বর্তমানের গেরেজা আয়াম
নির্মাণকাজ চলাকালে ডেনিয়েল চেয়েছিলেন তিনি তার দৈবদর্শনে যেমনটি দেখেছিলেন, অর্থাৎ তার প্রার্থনাগৃহের আকার হবে একটি পায়রার মতো। পায়রাটির মাথায় থাকবে একটি মুকুট, যা ঘরটির পবিত্রতা নির্দেশ করবে। কিন্তু তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে ভবনটির আকৃতি আসেনি, এসেছে একটু অন্যভাবে।
পাশ থেকে হেঁটে যাওয়ার সময় গেরেজা আয়ামকে কখনোই একটি পায়রার মতো লাগে না দেখতে। বরং আকৃতিটির মাথায় মুকুট থাকায় তা সকলকে মুরগীর মাথার ঝুটির কথা মনে করিয়ে দেয়। ফলে বাইরের পুরো কাঠামোর নির্মাণ হয়ে গেলে এটিকে আর অন্য কিছু নয়, বরং বিরাট একটি মুরগীর মতো দেখতে মনে হয়।
হয়তো এটিই গেরেজা আয়ামের জন্য একটি আশীর্বাদস্বরূপ ছিলো। কারণ এমন আকৃতির জন্য ভবনটি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে ‘গেরেজা আয়াম’ নামে, যার অর্থ ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘চিকেন চার্চ’ বা বাংলায় ‘মুরগী গির্জা’। আর এমন অদ্ভুত আকৃতি এবং নামের কারণে গেরেজা আয়াম প্রচুর দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সকলে বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়ে এটি দেখতে যে কী এমন গির্জা রয়েছে যা দেখতে মুরগীর মতো!
একের পর এক ভ্রমণকারী আসতে থাকেন এবং তারা গির্জাটির ছবি তুলে এবং সে সম্পর্কে লিখে তা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে থাকেন। এতে করে ধীরে ধীরে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ডেনিয়েল আলমসজাহের এই নির্মাণকাজটি। গেরেজা আয়াম যত জনপ্রিয় হওয়া শুরু করে ডেনিয়েল তত অর্থ আয় করতে শুরু করেন গির্জাটির ভেতরে প্রবেশের জন্য টিকিটের প্রচলন করার মাধ্যমে। তা ছিলো জনপ্রতি মোটে এক মার্কিন ডলার করে। তবে প্রচুর মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থানে পরিণত হওয়ায় ডেনিয়েল বেশ ভালোই আয় করছিলেন। ফলে তিনি গির্জাটির ভেতরটার পুনরায় সংস্কারে হাত দেন। ঘরগুলো বিভিন্নভাবে সাজানো শুরু করেন।
এ বছরে ডেনিয়েল অবশেষে তার ভবনটির জানালাগুলোর কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন। আশেপাশের জায়গাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। মাটির অভ্যন্তরের প্রার্থনা কক্ষগুলোর পুনরায় পরিমার্জন কাজ চালানো হচ্ছে। স্থানীয় শিল্পীগণ এর দেয়ালে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবিও এঁকে দিচ্ছেন। ফলে দিন দিন এটি একটি বেশ চকচকে এবং আকর্ষণীয় ভবনে পরিণত হচ্ছে।
এমনকি ভবনটির শেষ মাথায় একটি ক্যাফেও রয়েছে, যেখানে ভ্রমণকারীরা তাদের ক্লান্তি ভুলতে বিশ্রাম নিতে পারেন। অর্থাৎ বিরাট একটি দৈত্যাকার মুরগীর অভ্যন্তরে বসেই ভ্রমণকারীরা ইন্দোনেশিয়ার প্রচলিত বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার উপভোগ করে থাকেন। গির্জাটির একদম মাথায় চড়ার সুযোগও রয়েছে ভ্রমণকারীদের, যেখানে তারা উঠে অঞ্চলটির মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ নিতে পারেন।
আরেকটি যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, গেরেজা আয়ামকে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। আলমসজাহ অবশ্য তথ্যটির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, “পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে গেরেজা আয়াম ব্যবহার করা হয়েছিলো মূলত বিভিন্ন প্রতিবন্ধী ও মানসিক বিকারগ্রস্ত শিশু, মাদকাসক্ত এবং উন্মাদ ব্যক্তিদের জন্য।”
বর্তমানে গেরেজা আয়াম চিকেন চার্চের পাশাপাশি বার্ড চার্চ, চার্চ ডাভ, পিজিয়ন হিল সহ আরো অনেক নামে পরিচিত।
ফিচার ইমেজ সোর্স: wikimedia commons