এই পথ যদি না শেষ হয়?

এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে চলো কোথাও চলে যাই
ঐ আকাশটাকে শুধু চোখে রেখে মনটাকে কোথাও হারাই।
ঐ সারি সারি সব ছবির মত তীর ছাড়িয়ে যাই চলো দূরেই কত
সেই স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুক ওরাই,
কী চাইনি কী পাইনি সবই ভুলে যেতে চাই।।

এই গানের মতোই আমাদের শরীর, মন কি প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে ছুটি পেতে চায় না? শহরের কোলাহলকে দূরে সরিয়ে যেন প্রকৃতিরে নির্জনতাকে বড় আপন করে নিতে কার না ইচ্ছে করে! হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির মোহনীয় পথগুলোতে। কার না ইচ্ছে করে কোনো কল্পজগতের রূপকথার রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে?

যদি সেসব রাস্তা বা পথের সন্ধান বাস্তবে পাওয়া যেতো, তবে কেমন হতো বলুন তো! এই পৃথিবীতেও এমন কিছু রাস্তা রয়েছে, যা কল্পনার জগতকেও হার মানাবে। প্রকৃতির তৈরী সেসব নিবিড় ছায়াঘেরা পথে প্রিয়জনকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর মুহূর্তটাই জীবনের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির এমন কিছু মনভোলানো পথের সন্ধানে চলুন আজ বেরিয়ে পড়ি।

সাগানো ব্যাম্বো ফরেস্ট, জাপান

জাপানের কিয়োটো শহরের অ্যারাশিয়ামা নামক এক অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বাঁশের এক জঙ্গল। এই বাঁশের জঙ্গলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পার্ক, বেশ কয়েকটি কৃত্রিম লেক এবং পর্যটকদের জন্য লোভনীয় সব আহারের স্বাদ নেয়া জাপানী রেস্টুরেন্ট। সবকিছুতেই যেন প্রকৃতির ছোঁয়া। প্রকৃতিতে যে সূক্ষ্ম কৃত্রিমতার ছোঁয়া রয়েছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। আর এই বাঁশের জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হয়েছে অপূর্ব এক রাস্তা। এই সরু আঁকাবাকা রাস্তাকে ঘিরে রয়েছে দুপাশে বাঁশের সারি, যেন স্বর্গীয় এক পথের সৃষ্টি করেছে। সেই রাস্তায় প্রিয়জনকে নিয়ে হেঁটে বেড়াতে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটকই। স্মরণীয় এক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকেন তারা।

জাপানের বাম্বো ফরেস্ট; Image Source: Inside Kyoto

দ্য টানেল অফ লাভ, ইউক্রেন

ইউক্রেনের পশ্চিমের এক ছোট শহর ক্লেভান। শহর থেকে সামান্য দূরে প্রকৃতি তার নিজের হাতে তৈরি করেছে এক ভালবাসার সুড়ঙ্গ। দু’ পাশে গাছের সারি এমনভাবে পরষ্পরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে, দেখলে মনে হবে কোনো সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আপনি হেঁটে চলেছেন। এ টানেলের মাঝ দিয়ে চলে গেছে ট্রেন লাইন, প্রথম দেখে বোঝারই কোনো উপায় নেই যে এখানে কোনো ট্রেন লাইন আছে। ১.৮ মাইল দীর্ঘ ট্রেন লাইনটিও পুরোপুরি সবুজে ঢাকা। প্রাকৃতিকভাবে নির্মিত টানেলটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য এক পবিত্র স্থান। কিংবদন্তি রয়েছে, এই টানেল দিয়ে প্রিয় মানুষকে নিয়ে হাঁটলে তাদের মনের বাসনা পূরণ হয় এবং দুজনের ভালবাসা চির অটুট থাকে। আর এ থেকেই সুরঙ্গটির নাম হয়েছে ‘টানেল অফ লাভ’।

ক্লেভান শহরে অবস্থিত পুরোপুরি সবুজে ঢাকা টানেল অফ লাভ; Image Source: earthporm.com

তিন ঋতুতে তিন ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই প্রাকৃতিক টানেলে দেখতে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে টানেলের চারপাশের গাছের শুষ্ক পাতা ঝড়ে পড়ে এবং সম্পূর্ণ টানেলটি পত্রশুণ্য হয়ে পড়ে। শীতকালে বরফের সাদা চাদরে ঢাকা পড়ে টানেলটি। আর বসন্তকালে নতুন সবুজ পল্লবে ছেয়ে যায় টানেলটি যেন সবুজের মেলা বসেছে চারধারে। এই সময় টানেল দিয়ে হেঁটে বেড়ানো সকলের জীবনের এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয়।    

ল্যাবারনাম টানেল, ওয়েলস

ওয়েলসের তাল-ই-সিফোন শহরে অবস্থিত বোডনান্ট গার্ডেনটি দেশটির এক ঐতিহাসিক বাগান হিসেবে পরিচিত। কারণ এই বাগানের সাথে জড়িয়ে আছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্মিত একটি বাড়ি, বোডনান্ট হাউস। এই বাড়িটিকে ঘিরে প্রায় ৮০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বাগানটি। পূর্বে বাড়ি এবং বাগানটি পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে থাকলেও পরে দেশটির জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে এটি অধিগ্রহণ করা হয়। বাগানে রয়েছে বিশাল গোলাপ বাগান, বাগানকে চতুর্দিকে ঘিরে থাকা এক অপূর্ব লেক। এসব ছাড়া আর রয়েছে হলুদ রঙের গোল্ড ল্যাবারনাম ফুলে ঢেকে থাকা একটি টানেল, যা বাগানটিকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। ফুল ফোটার দিনগুলোতে পুরো টানেল ছেয়ে যায় হলুদ ল্যাবারনাম ফুলে, তখন এক অনবদ্য দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। 

ক্যাম্পিগনা ন্যাশনাল পার্ক, ইতালি

১৯৯৩ সালে ৩৬৮ বর্গ কি.মি. এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ইতালির ক্যাম্পিগনা ন্যাশনাল পার্কটি শীতকালে এক অন্যরূপে হাজির হয় পর্যটকদের সামনে। শীতের ভোর এবং সূর্যোদয় এই পার্কের প্রকৃতিতে যেন এক নৈসর্গিক রূপ তৈরি করে। তা দেখতে সূর্যোদয় হওয়ার অনেক আগেই পর্যটকদের তো বটেই, স্থানীয়দেরও তর সয় না। শ্বেত শুভ্র তুলতুলে বরফের আবরণে ছেয়ে থাকা পার্ক, পার্কের দুই পাশের গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয়া সকালের ভোর আর সূর্যের প্রথম মিষ্টি আলো যখন গাছের প্রাচীর ভেদ করে সরু রাস্তাটিতে পড়ে, তখন সেটি যেন রূপকথার কোনো দেশ বলে মনে হয়। 

ইতালির ক্যাম্পিগনা ন্যাশনাল পার্ক; Image Source: Pinterest

উইস্টেরিয়া ফ্লাওয়ার টানেল, কিতাকিউশু, জাপান

জাপানের টোকিও শহর থেকে ৬ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছতে হয় কিতাকিউশুতে। সাজানো-গোছানো এক শহর। এই শহরে অবস্থিত কওয়াচি ফুজি গার্ডেনটি এককথায় অনন্য। বাগানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটি হলো উইস্টেরিয়া ফুলে ছেয়ে যাওয়া এক টানেল। এপ্রিল ও মে মাসে যখন উইস্টেরিয়া গাছ ফুলে ঢেকে যায়, তখন টানেলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার মনে হতে পারে যে, আপনি ভুল করে হয়তো কোনো পরীর দেশে চলে এসেছেন।

কওয়াচি ফুজি গার্ডেনের উইস্টেরিয়া ফুলে ছেয়ে যাওয়া টানেল; Image Source: earthporm.com

ডার্ক হেজেস, আয়ারল্যান্ড

উত্তর আয়ারল্যান্ডের দুটি জনপ্রিয় শহর অ্যান্ট্রিম এবং স্ট্র্যানোকামকে সংযোগকারী একটি রাস্তা এই ডার্ক হেজেস। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর একটি দৃশ্যে এই রাস্তাকে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে কিংস রোড হিসেবে, যা দেখে দর্শকেরাও বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। আর তারপর থেকেই এই রাস্তা অবলোকন করতে পর্যটকরা অস্বাভাবিক ভিড় করতে থাকেন ।

উত্তর আয়ারল্যান্ডের অ্যান্ট্রিম এবং স্ট্র্যানোকাম শহরের সংযোগকারী এক রহস্যময় রাস্তা ডার্ক হেজেস; Image Source: Getty Images

রাস্তার দু’পাশের বিশাল বিশাল বিচ ট্রির সারির কারণে রাস্তাটিতে সবসময় এক আলো-আঁধারির খেলা চলতে থাকে। এই পরিবেশে একা হেঁটে যেতে একটু গা ছমছম করতেই পারে, কিন্তু তাই বলে, এর অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা না দেখে কি থাকা যায়! তিন শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ ট্রি এমনভাবে রাস্তার ওপর তার ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে, যা দূর থেকে দেখে মনে হবে কোনো এক স্বর্গীয় পথের সন্ধানে আপনি গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন।

হোয়াইট কারপাথিয়ানস, স্লোভাকিয়া

দর্শনীয় কান্ট্রি সাইট, বিস্তৃত পর্বতমালা এবং তাকে বেষ্টন করে থাকা বনভূমি, অপূর্ব মোহনীয় ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যে মনমাতানো স্লোভাকিয়া তার জাদুকরী সম্মোহনীতে ভুলিয়ে রেখেছে পর্যটকদের বছরের পর বছর ধরে। আর সেই স্লোভাকিয়ার হোয়াইট কারপাথিয়ানস বনভূমি সারা ইউরোপের মধ্যে অনন্য এক বনভূমির স্বীকৃতি পেয়েছে। আর সেজন্য ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে এই বনভূমি।

এই বনভূমির মধ্যে একটি আকর্ষণীয় স্পট হচ্ছে কমলা এবং সোনালি রঙের পাতায় ছাওয়া এক নৈসর্গিক পথ যা বনভূমিতে অপরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। শরৎকালে এই স্থানটিতে বিভিন্ন অর্কিড গাছের পাতায় যেন নানা রঙের খেলা চলে। আর দুইপাশের সে সব রঙ-বেরঙের পাতায় ছাওয়া গাছগুলো দেখতে দেখতে আপনি  কোনো এক উদাসী রাজকুমারের মতো নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইবেন।

ফিচার ইমেজ- Getty Images

Related Articles

Exit mobile version