ট্রিস্টান ডি কুনহা: পৃথিবীর সবচেয়ে দূরবর্তী দ্বীপ

এমন এক দ্বীপ যেখান থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপের দূরত্ব ২ হাজার কিলোমিটার। যাতায়াতের একমাত্র উপায় মাছ ধরার বোট কিংবা ক্রুজ শিপ। আপনি কি পারবেন সেই দ্বীপে বাস করতে? আশ্চর্য মনে হলেও সত্য, এরকম এক দ্বীপে সেই ১৯ শতক থেকে বাস করে আসছে কিছু ব্রিটিশ নাগরিক এবং তাদের বংশধর। দ্বীপটির নাম ট্রিস্টান ডি কুনহা (Tristan da Cunha)।

ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটোরি অফ সেন্ট হেলেনার অন্তর্গত ট্রিস্টানের একমাত্র গ্রামের নাম এডিনবার্গ অব সেভেন সিজ। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে মাত্র ৯৮ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট এই দ্বীপটির জনসংখ্যা মাত্র ২৪৫ জন। প্রকৃতপক্ষে দ্বীপটি একটি আগ্নেগিরি হতে তৈরি। সর্বশেষ ১৯৬১ সালে এর উদগিরনের পর এখন এটি এখনো জীবিত।

Image: Britanica

এখান থেকে সবচেয়ে কাছের দ্বীপটির দূরত্ব প্রায় ২১৬১ কিলোমিটার। সবচেয়ে কাছের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা যার রাজধানী কেপ টাউন থেকে এর দূরত্ব প্রায় ২৪৩২ কিলোমিটার।

দ্বীপটি বর্তমানে ব্রিটেনের অধিকারে থাকলেও সর্বপ্রথম এটি আবিষ্কার করে ট্রিস্টাও ডা কুনহা নামক একজন পর্তুগীজ। ১৫০৬ সালে। একটি আগ্নেগিরির দ্বীপ ছাড়া একে এর বেশি কিছু ভাবেননি তিনি। ১৮১৬ সালে এটিকে অধিকারে নেয় ব্রিটেন। প্রথমদিকে মিলিটারি কাজে ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে দ্বীপটিতে সিভিলিয়ানরা বসবাস করতে শুরু করে।

বর্তমানে ‘আইল্যান্ড কাউন্সিল’ দ্বীপটিতে প্রশাসনিক কাজ করে আসছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে কী করে এখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। মূলত কৃষি পেশার সাথে তারা জড়িত। আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন দ্বীপ হওয়াতে এর মাটি চাষের উপযোগী এবং উর্বর। আলু এর প্রধান কৃষিজ পণ্য। পাশাপাশি স্ট্রবেরী, পিচ অন্যান্য জিনিসও এখানকার অধিবাসীরা ফলিয়ে থাকেন। পশুপালন, খামার ইত্যাদির সাথেও তারা জড়িত যা থেকে অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় দুধ এবং ডিমের যোগান আসে। আর স্বাভাবিকভাবেই দ্বীপ হওয়ার কারণে এর মৎস্য সম্পদ বেশ সমৃদ্ধশালী। ট্রিস্টান ডি কুনহার বিখ্যাত ‘রক লবষ্টার’ জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়ে থাকে।

Image: leticicesblog.wordpress.com

 

সমগ্র দ্বীপে মাত্র ৯টি পরিবারের বাস। পুরো দ্বীপের জমির মালিক এই পরিবার, বাইরের কেউ জমি অধিগ্রহণ কিংবা ক্রয়ের অধিকার রাখে না। দ্বীপটিতে আছে একটি চার্চ, একটি স্কুল, একটি হাসপাতাল, একটি সুপারশপ, একটি পোস্টঅফিস, একটি কমিউনিটি হল, একটি ক্যাফে এবং একটি মিউজিয়াম। মোটামুটি সকল নাগরিক সুবিধাই এখানে বিদ্যমান।

সেন্ট মেরিস স্কুলটিতে তিন থেকে ষোল বছরের বাচ্চাদের শিক্ষাদান করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু দ্বীপেই সেরে নেয় অধিকাংশ শিক্ষার্থী। ১৬ বছরের উর্দ্ধে শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য ট্রাস্ট ফান্ডের সহায়তায় ইউকে অথবা সাউথ আফ্রিকায় যেতে পারে। ইন্টারনেটের সুবিধা খুব একটা ভাল না হলেও ভিস্যাটের মাধ্যমে ‘প্রিন্স ফিলিপ হল’-এ ইন্টারনেটের সুবিধা নেওয়া হয়। মিউজিয়ামটির মজার ব্যাপার হলো চাইলে যে কেউ বুকিংয়ের মাধ্যমে এখানে রাত্রিযাপন করতে পারে।

১৯৬১ সালে আগ্নেয়গিরির উদগীরনের কারণে দ্বীপের অধিবাসীদের ২ বছর ইংল্যান্ডে বসবাস করতে হয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এখানকার অধিবাসীরা আবার ফেরত আসে। এখন পর্যটকরা চাইলে আগ্নেয় পাহাড়ে হাইকিংয়ে যেতে পারে। ২০১৩ সালে সেখানে একটি পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৬১ সালের স্মৃতির কথা স্মরণ করে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ভলকানো পার্ক ৬১।

বৈচিত্র্যে ভরা দ্বীপটিতে প্রাণিবৈচিত্র্যও আছে। পেঙ্গুইন, এলব্রাটস, সিল, তিমি ছাড়াও নানা ধরনের জীবের দেখা পাওয়া যায়। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য যা যথেষ্ট। 

Image: southafrica.to

একটি মাত্র বাস চলাচল করে সমগ্র দ্বীপে। চাইলে যে কেউ বাসে অথবা পায়ে হেটে পুরো দ্বীপ ঘোরতে পারে। মাঝে বিশ্রামের জন্য আছে রাস্তার পাশে বেঞ্চ। পেছনে পাহাড় সামনে উত্তাল আটলান্টিক আর কোলাহল ও যান্ত্রিক শব্দ মুক্ত পরিবেশের টানে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ট্রিস্টান ডি কুনহায় চলে আসে।

তবে এ দ্বীপে যাওয়া যেমন কঠিন, তেমনই এখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়াও কঠিন। প্রথমে জাহাজের সময়সুচী মাথায় রেখে আবেদন করতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক বছর সময় নিয়েও তা করা লাগতে পারে। এরপর প্রয়োজন রাত্রিযাপনের স্থান নিশ্চিত করা। স্থানীয় অধিবাসীদের কোনো বাসা, গেস্ট হাউজ অথবা মিউজিয়ামে পর্যটকরা থাকতে পারেন। তবে গেস্ট হাউজে নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়।

এরপর অনুমতিপত্র। যাত্রার পূর্বেই প্রশাসনিক সচিবের নিকট ভ্রমণকারীর নাম, বয়স, জাতীয়তা, ভ্রমণের তারিখ এবং উদ্দেশ্য ইত্যাদি জানিয়ে ইমেইল পাঠাতে হয়। প্রয়োজনবোধে স্থানীয় প্রশাসন ভ্রমণকারীর ক্রিমিনাল রেকর্ডও চাইতে পারে।

শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যদি হাঁপিয়ে উঠেন তবে এডভেঞ্চারের স্বাদ দিতে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা। এরমাঝে হাইকিং, গলফ, বোট ট্রিপ ইত্যাদি আছে। তাছাড়া কুইন মেরি’স পিকে রয়েছে হার্ট আকৃতির ‘লাভ লেক’ যা  ২০৬২ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।

লাভ লেক; Image: tristandc.com

বর্তমান এই কোভিড-১৯ মহামারীতে যে কয়টি অঞ্চল নিজেদের মুক্ত রাখতে পেরেছে তার মাঝে একটি হলো ট্রিস্টান ডি কুনহা। সামাজিক দূরত্বের এই সময়ে তারা সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশি থেকে ২১৬১ কিলোমিটার দূরে। তাছাড়া ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে সকল ধরনের নৌ চলাচল বন্ধ রেখেছে তারা। আশা করা যায় তারা এই দূর্যোগ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।

এ দ্বীপের অধিবাসীদের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট আছে যাতে অদিবাসীদের সকল তথ্য, জন্ম, মৃত্যু, ঘোষণা ও নিয়মিত আপডেট রাখা হয়। ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলে মনে হবে সম্পূর্ন দ্বীপটি একটি বড় পরিবার যার সকল সদস্যদের খবরাখবর সকলের কাছেই আছে। https://www.tristandc.com/

Related Articles

Exit mobile version