এমন একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে, উড়ন্ত প্লেনে যদি কোনো শিশুর জন্ম হয়, তাহলে সে শিশু আজীবন বিনা খরচে প্লেনে চড়ার অধিকার লাভ করে। আসলেই কি তা-ই? গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আকাশে জন্ম নেওয়া শিশুর নাগরিকত্ব কীভাবে নির্ধারিত হয়? কিংবা আকাশে জন্মগ্রহণের ঘটনা আসলে কত বেশি ঘটে?
আকাশে জন্মগ্রহণ কতটা স্বাভাবিক?
সারা বিশ্বে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রতিদিন প্লেনে চড়ে। কিন্তু তারপরেও প্লেনে কোনো শিশুর জন্মগ্রহণের ঘটনা খুবই বিরল। এ পর্যন্ত সর্বমোট কতটি শিশু প্লেনে জন্মগ্রহণ করেছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব নেই। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম মাঝ আকাশে জন্ম গ্রহণের ঘটনা ঘটে ১৯২৯ সালে। সেই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মাঝ আকাশে মাত্র ৬০টি শিশু জন্মগ্রহণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। কিছু কিছু হিসেব অনুযায়ী এ সংখ্যা আরো কম, ৪৮ বা এর কাছাকাছি।
এর প্রধান কারণ, কোনো মা-ই সাধারণত প্লেনের অনিশ্চিত পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না। শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য প্লেন মোটেই উপযোগী কোনো স্থান না। প্লেনের ক্রুদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকলেও সন্তান জন্ম দেওয়ানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না। ফলে প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে মায়েরা সাধারণত বিমান ভ্রমণ এড়ানোর চেষ্টা করেন।
এয়ারলাইন্সগুলো নিজেরাও এই উটকো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। অনেক এয়ারলাইন্সই সন্তানসম্ভবা নারীদের ভ্রমণের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করে। আরব আমিরাতের ইত্তিহাদ, কাতারের কাতার এয়ারওয়েজ, তুরস্কের টার্কিশ এয়ারওয়েজেসহ বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্সই ৩৬ সপ্তাহের বেশি সময়ের গর্ভবতী নারীদেরকে প্লেনে চড়ার অনুমতি দেয় না। অনেক এয়ারলাইন্স ২৬ কিংবা ২৮ সপ্তাহের পর থেকেই ডাক্তারের সার্টিফিকেট চেয়ে বসে। এছাড়াও এক সন্তান, জমজ সন্তান প্রভৃতির জন্যও এয়ারলাইন্সগুলো ভিন্ন ভিন্ন শর্ত রাখে।
তারপরেও মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। অনেক সময়ই নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই অনেক নারীর প্রসব বেদনা উঠতে পারে। ২০১৫ সালে এরকম একটি ঘটনাও ঘটেছিল, যেখানে এয়ার কানাডার একটি ফ্লাইটে প্রসব বেদনা ওঠার পূর্ব পর্যন্ত অ্যাডা গুয়ানের কোনো ধারণাই ছিল না যে, তিনি গর্ভবতী! তার প্রেগন্যান্সি টেস্টে একাধিকবার ভুল ফলাফল এসেছিল, ফলে তার ধারণা ছিল এমনিতেই তার ওজন বৃ্দ্ধি পাচ্ছে!
এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা যদি ঘটেই যায় এবং উড়ন্ত প্লেনেই যদি কোনো নারীর প্রসব বেদনা ওঠে, সেক্ষেত্রে পাইলট সাধারণত যাত্রীদের মধ্যে কোনো কোনো ডাক্তার, নার্স বা অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির সাহায্য কামনা করেন। কিন্তু প্লেনের সংকুচিত স্থানে সন্তান জন্ম দেওয়ার কাজটি সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।
আকাশ-শিশুরা কোন দেশের নাগরিক?
ধরুন, বাংলাদেশ থেকে এমিরেটসের একটি ফ্লাইট যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানের আকাশসীমায় পৌঁছানোর পর প্লেনের ভেতরে থাকা এক ভারতীয় নারী একটি সন্তানের জন্ম দিলেন। তাহলে সেই সন্তানের নাগরিত্ব কী হবে? বাংলাদেশী? পাকিস্তানি? ভারতীয়? নাকি আমিরাতি? এরকম প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশ নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম অনুসরণ করে।
এরকম ক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে প্লেনটি সেই দেশের ভূমির উপর অবস্থান করলেই শিশু সেই দেশের নাগরিকত্ব দাবি করতে পারবে। এটাকে বলা হয় জুস সলি (Jus Soli) বা মাটির অধিকার। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি রাষ্ট্রই কেবল এ ধরনের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়। ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রে এ ধরনের নাগরিকত্ব লাভের কোনো সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু দেশের ক্ষেত্রে শিশুটি যে দেশের মালিকানাধীন প্লেনে জন্মগ্রহণ করে, সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভের অধিকার পায়। এই ধারণটি এসেছে প্রধানত সামুদ্রিক আইন থেকে। প্লেনের চেয়ে জাহাজে সন্তান জন্মানোর ঘটনা অনেক বেশি ঘটে থাকে। যেহেতু বিশাল সাগর-মহাসাগর কোনো দেশের অধীনে পড়ে না, তাই সেখানে জন্মগ্রহণকারী শিশুদেরকে অনেক সময়ই জাহাজটির মালিকানা যে দেশের, সেই দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সব দেশ এ ধরনের নাগরিকত্ব দেয় না। শুধুমাত্র Convention on the Reduction of Statelessness চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর ক্ষেত্রেই এ ধরনের নাগরিত্বের জন্য আবেদন করা যায়। বিশ্বের ৭৩টি রাষ্ট্র এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
তৃতীয়ত, যদি উপরের কোনো শর্তই প্রযোজ্য না হয়, তাহলে ভূমিষ্ঠ শিশু স্বাভাবিকভাবে উত্তরাধিকাসূত্রে তার বাবা বা মায়ের দেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবে।
আকাশ-শিশুরা কি আজীবন বিনা খরচে প্লেনে চড়তে পারে?
এই ধারণাটি জনপ্রিয় হলেও বাস্তবে এমন কোনো আইন নেই, যার বলে কেউ প্লেনে জন্মগ্রহণ করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আজীবন বিনা খরচে প্লেনে চড়ার সুযোগ লাভ করবে। কারণটাও সহজ। এ ধরনের ঘোষণা থাকলে সেটা অনেককে প্লেনে প্রসবের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পারে।
কিন্তু কিছু কিছু এয়ারলাইন্স সময়ে সময়ে তাদের প্লেনে জন্মগ্রহণ করা শিশুদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। অনেক এয়ারলাইন্স আজীবনের ফ্রি এয়ার টিকেটও দিয়েছে। কিন্তু এটা এয়ারলাইন্সগুলোর সব সময়ের পলিসি না। এ ধরনের উপহার দেওয়াটা একান্তই তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল। ২০১৭ সালে ভারতের জেট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে এক কন্যাশিশুর জন্ম হওয়ার পর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাকে আজীবনের ফ্রি এয়ার টিকেট দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এর আগে মালয়েশিয়ার এয়ার এশিয়াও ২০০৯ সাল এক পুত্র শিশুকে আজীবনের ফ্রি টিকেট দেয়। ২০১৬ সালে লিবিয়ার বুরাক এয়ারের একটি ফ্লাইটে জন্মগ্রহণ করা একটি শিশুকেও আজীবন ভ্রমণের জন্য ফ্রি টিকেট দেওয়া হয়।
কিন্তু সব এয়ারলাইন্স সব সময় আজীবনের টিকেট ফ্রি দেয় না। ২০১৬ সালে দুবাই থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পথে ফিলিপিন্সের কেবু প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে এক পুত্রশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাকে বিনামূল্যে ১ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণের জন্য বিশেষ একটি পাস দেয়। ২০০৪ সালে ব্রিটেনের ভার্জিনিয়া আটলান্টিকে জন্মগ্রহণ করা একটি শিশুকে ২১ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে প্লেনে চড়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
কিছু কিছু এয়ারলাইন্সের উপহার আরো অনেক কম আকর্ষণীয়। ২০১৭ সালে আমেরিকার স্পিরিট এয়ারলাইন্সে জন্মগ্রহণ করা একটি শিশুকে এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে একটি পাস দেওয়া হয়, যার ফলে সে প্রতি বছর শুধুমাত্র তার জন্মদিনের দিন একজন সঙ্গীসহ একবার করে ফ্রি ভ্রমণ করতে পারবে। অনেকের ভাগ্য আরো খারাপ হতে পারে। ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে জন্ম হয়েছিল শোনা ওয়েনের। ২০০৯ সালে তার ১৮তম জন্মদিনের দিন এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাকে দুটি ফ্রি এয়ার টিকেট উপহার দেয়।
তবে আজীবন ফ্রি টিকেট উপহার না পেলেও আকাশে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অনেকেই আজীবন ঐ ঘটনার সাথে যুক্ত কোনো স্মৃতি বহন করেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নাম রাখা হয় আকাশ, প্লেন বা এয়ারলাইন্সের সাথে মিলিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করা বিশ্বের প্রথম আকাশ শিশুর নাম রাখা হয়েছিল Airlene Evans। ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করা শোনা ওয়েভের পুরো নাম ছিল Shona Kirsty Yves। আকাশে জন্ম বলে তার বাবা-মা তার জন্ম এমন নাম বাছাই করেছেন, যার প্রথম অক্ষরগুলো নিলে SKY শব্দটি পাওয়া যায়।
অন্যদিকে ২০১৬ সালে লিবিয়ার বুরাক এয়ারে জন্মগ্রহণ করা শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল আব্দুল বাসেত। কারণ ঐ ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনের নাম ছিল আব্দুল বাসেত এবং তার আপ্রাণ প্রচেষ্টায়ই শিশুটি নিরাপদে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছিল।
এরোপ্লেন সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি-