ছোট কমলদহ ট্রেইল: ঝর্ণার আবরণে অপরূপ প্রকৃতি

একজন মানুষের জীবন হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দের সঞ্চয়। সেদিনের জন্য পাহাড়ের মাঝেই ক্ষুদ্র এক আনন্দ আমরা খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম। সেটি করতে গিয়ে জন্ম হয়েছিল কিছু রোমাঞ্চকর গল্পের।

রওনা দেবার আগের সমস্ত রাত অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বেশ চিন্তায় ছিলাম, এবার আমাদের যাওয়া হবে নাকি হবে না। ভোর পাঁচটায় রওনা দেয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টি তখনো পড়ছেই। ঝর্ণা দেখার আশায় সবাই ভোরে ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষা করছিলাম কখন বৃষ্টি থামবে, কিন্তু থামার কোনো লক্ষণই নেই। কেউ কেউ আবার বৃষ্টির মাঝেই বাসা থেকে বের হয়ে পড়েছিল এটা ভেবে যে, হয়তো পথে যেতে যেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। কিন্তু সেটারও কোনো লক্ষণ নেই। প্রায় এক ঘন্টা পর যখন বৃষ্টি মোটামুটি কমে আকাশ হালকা হয়ে এলো আমরা ট্রিপের জন্য বাসা থেকে বের হলাম। 

শুরুটা হয়েছিল মেঠো পথের ধার ঘেঁষেই।
শুরুটা হয়েছিল মেঠো পথ ধরে; Image: Author

ছোট কমলদহ। পাহাড় যেন সেখানে সজ্জিত হয়ে আছে ঝর্ণা গায়ে মেখে।  সে রূপ সচক্ষে উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে বেশ লম্বা একটি পথ। তারপর দেখা মিলবে নীলাম্বরী লেকের। বোটে করে নদী পাড়ি দিয়ে চাইলে চলার পথ সংক্ষিপ্ত করতে পারবেন।

কিন্তু আমরা সংক্ষিপ্ত পথে না গিয়ে পাহাড়ের পথই বেছে নিয়েছিলাম। মহাকর্ষের বিরুদ্ধে চলতে গিয়ে বল প্রয়োগ করতে হচ্ছিল বেশ। পথ তেমন একটা দুর্গম বা বিপজ্জনক না হলেও সেদিন রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পথে কিছুটা জটিলতা ছিল। তবে বলে রাখা ভালো, ঝর্ণার অবিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় মূলত বৃষ্টির পরেই। 

বিশালতা আঁকড়ে ধরে রাখা আকাশ যেন মিশে গিয়েছে পাহাড় আর নদীর সমাহারে।
নীলাম্বরী লেক; Image: Author

প্রথম ঝর্ণা, হরিণমারা ঝর্ণায় পৌঁছানোর পর ঝর্ণার চেয়েও বেশি মনোযোগের দাবি রেখেছিল এর নামকরণের ব্যাপারটি। একসময় এই এলাকায় প্রচুর হরিণ ছিল, এরা যখন এই ঝর্ণায় পানি পান করতে আসতো তখন তাদের শিকার করা হতো। সেই রেশ ধরেই ঝর্ণাটি  লাভ করেছিল হরিণমারা নাম। যেহেতু বৃষ্টি ছিল তাই বলা যায় আমরা ঝর্ণার সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত  হইনি।

হরিণমারা ঝর্ণা ; সৌন্দর্য বিলানোর জন্য যার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে।
হরিণমারা ঝর্ণা; Image: Author

যখন দ্বিতীয় ঝর্ণা অর্থাৎ সর্পপ্রপাত ঝর্ণায় পৌঁছাই তখন রীতিমতো ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড চলছিল আর ঝর্ণার তীব্র প্রবাহের কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করে দিয়ে ভাবছিলাম, ঝর্ণার সৌন্দর্যের মতোই তো জীবনের সফলতাগুলো। যার দেখা মেলে হাজারো কষ্টের পথ পাড়ি দেওয়ার পর। তখন পানির স্রোত এতোটাই বেশি ছিল যে একজনের ব্যাগ পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। 

বর্ষার দানবীয় সর্প প্রপাত
বর্ষার দানবীয় সর্প প্রপাত; Image: Author

সর্বশেষ ঝর্ণাটি ছিল হাঁটুভাঙা ঝর্ণা। সেই ঝর্ণায় পৌঁছানোর পর মানতে বাধ্য হয়েছিলাম, প্রত্যেকটি ঝর্ণারই সৌন্দর্য বিলিয়ে দিবার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে। এই ঝর্ণা দর্শনের মধ্য দিয়ে আপনি ফেরার পথে চলার চিন্তা শুরু করতে পারেন কিংবা ঝর্ণার গা বেঁয়ে উপরে উঠে যেতে  পারেন। সেখানে দেখা মিলবে আরো কিছু কেসক্যাডের। 

প্রকৃতির রহস্যের আবরণের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমার সৌন্দর্য - হাঁটুভাঙা ঝর্ণা।
প্রকৃতির রহস্যের আবরণের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমার সৌন্দর্য- হাঁটুভাঙা ঝর্ণা; Image: Author

যাওয়ার পথটা সাধারণের মতো করে পাহাড় বেয়ে পাড়ি দিলেও ফেরার গল্পটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। শর্ট রাস্তা খোঁজার আশায় আমরা পায়ে কাঁটা বিঁধে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম কিন্তু তারপর আমরা আবিষ্কার করলাম আর তো কোনো পথ নেই। পাশে ছিল নীলাম্বরী লেক আর আমাদের হাতে ছিল তিনটি অপশন- ১. আগের সেই  রাস্তা ধরে ফিরে যাওয়া; ২. লেকের পানিকে সাঁতরে জয় করে পার হওয়া; এবং
৩. বোটে করে নীলাম্বরী লেক পার হওয়া। আমরা দ্বিতীয় অপশনটিকে বেছে নিয়েছিলাম। (উল্লেখ্য সাঁতার না জানলে গভীর কোনো লেক পাড়ি দেবার ঝুঁকি না নেওয়াই উত্তম।)

আপনারা যারা ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে আরামে ফিরতে চান তাদের জন্য রয়েছে বোট। লেক পার হতে আপনার কাছ থেকে ১৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত দাম রাখতে পারে। তবে আপনি যদি ভাষার দক্ষতায় দরদাম করতে পারেন তাহলে কমাতে পারেন দাম। আমাদের গল্পটা ছিল অন্যরকম । আমরা কোনো নৌকাও নিইনি আবার যে রাস্তা দিয়ে ঝরনায় এসেছি সে রাস্তা দিয়েও যাইনি। লেকের কিনার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড় না চড়েই লেক পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম।

নীলাম্বরী লেকের খাড়া এবং বিপদসংকুল পাহাড়ি কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছলাম এমন এক প্রান্তে যেখান থেকে লেকের ওপার মাত্র ৩০-৪০ ফুটের ব্যবধান। এখানে পানি কিছুটা গভীর। একে অপরের সাহায্যে লেক পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম আরেক প্রান্তে অফট্রেইলে। সে এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা।

ওপারে পৌঁছলাম, কিন্তু রাস্তার দেখা নেই সেখানেও। শুনেছিলাম, যেকোনো জায়গার উদ্দেশ্যে পথে নামলে, পথই তাকে সেই জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। আর আমাদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না, একটি খেজুর গাছেই তার প্রমাণ মিললো যে গাছ আমরা যাওয়ার পথেও পেয়েছিলাম। ঘন জঙ্গল আর পিছলে কাদামাটিতে খানিক পাহাড় বেয়ে উঠার পর খুঁজে পেলাম মূল রাস্তা। 

খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ।
খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ; Image: Author

এরপর আস্তে আস্তে ফিরে এলাম সীতাকুণ্ডের জনমানবের মাঝে। ব্যস্ত নগরীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে আরো একটু বিশেষ কিছু হিসেবে ছিল ‘হিচহাইকিং পদ্ধতি’। মানে একটি কড়িও না খসিয়ে  বিনা খরচে ট্রাকের পেছনে পুরো টিমের আনন্দ করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছানো। সারাদিনের এই ধকলের পরও আমার জীবনে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের আবির্ভাব হয়েছিল আরো একবার, সময় যেন ফুরিয়ে গিয়েছিল খুব দ্রুতই।

হিচহাইকিং এর প্রয়োগে ট্রাকে আমরা
হিচহাইকিং পদ্ধতি অবলম্বনে ট্রাকে আমরা; Image: Author

 

রেল রাস্তা ধরে গন্তব্যের ইতি টানা যাক।
রেল রাস্তা ধরে গন্তব্যের ইতি টানা যাক; Image: Author

আমি হারিয়ে যাবো, বারে বারে হারিয়ে যাবো! হারাবো সমুদ্রের গর্জনে, হারাবো পর্বতের চূড়ায়, রচয়িতা হবো কিছু গল্পের।

যেভাবে যাবেন

চট্টগ্রাম থেকে গেলে, যেকোনো জায়গা থেকে আপনাকে সোজা চলে আসতে হবে একে খান মোড়। সেখানে ফেনী যাওয়ার যেকোনো একটি বাসে দরদাম করে উঠে পড়বেন। গন্তব্য হিসেবে ছোট কমলদহ বাজারের কথা উল্লেখ করবেন, ভাড়া নেবে ৪০ থেকে ৭০ টাকা। আমাদের জনপ্রতি ৫০ টাকা লেগেছিল।

ঢাকা থেকে আসতে চাইলে ফেনীর যেকোনো বাসে উঠে যাবেন। ফেনী নেমে সেখান থেকে যেকোনো লোকাল বাসে করে ছোট কমলদহ বাজারে এসে নামতে পারবেন। ছোট কমলদহ বাজারে পৌঁছে যদি পর্যাপ্ত সময় ও শক্তি থাকে তবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বাজারের ভেতরে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করবেন। সময় না থাকলে সিএনজি কিংবা যেকোনো ছোট যানে করে পাকা রাস্তাটুকু এগিয়ে রেললাইন পর্যন্ত চলে যেতে পারেন। এতে কষ্ট কিছুটা কমে যাবে।  এরপর থেকে ট্রেইল শুরু। বাকি পথটুকু শুধুই হাঁটার।

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো আপনি যদি সবগুলো ঝর্ণা না চিনে থাকেন তবে স্থানীয় কোনো একজন মানুষকে গাইড হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেন। গাইড আপনার কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা রাখতে পারে। প্রয়োজনে দামাদামি করে নেবেন। আমাদের দশজনের চট্টগ্রাম থেকে সম্পূর্ণরূপে শেষ করে চট্টগ্রাম ফিরে আসতে জনপ্রতি আড়াইশো টাকার মতো খরচ হয়েছিল।

ভ্রমণের সময় খেয়াল রাখবেন, যেখানে সেখানে পানির বোতল কিংবা খাবারের প্যাকেট যেন ফেলা না হয়। পাহাড়ে জোক থাকে অনেক। জোকের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। 

নোট

১. নীলাম্বরী লেক- আশেপাশের লোকজন এখান থেকে তাদের চাষাবাদের পানি সংগ্রহ করে থাকেন। পর্যটকদের জন্য নীলাম্বরী লেক নাম নিয়ে সবুজের মাঝে নীল জলরাশি সৌন্দর্য বিলায়।

২. হিচহাইকিং পদ্ধতি- হিচহাইক বা হিচহাইকিং একটি ক্রিয়া পদ্ধতি। একে আঙ্গুল দেখানোও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত রাস্তায় কোন চলন্ত গাড়িকে আঙ্গুলের ইশারায় থামিয়ে সেই গাড়িতে বিনামূল্যে ভ্রমণ করাকেই হিচহাইক বা হিচহাইকিং বলা হয়। এই পদ্ধতি অবশ্য আমাদের দেশে তেমন একটা চলে না, কিন্তু অনেক দেশে সুন্দর এ পদ্ধতি প্রচলিত। রাস্তার পাশে কেউ বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে ইশারা করলে ট্রাক চালকরা বুঝে নেয়, তিনি একজন পর্যটক। যদি সুযোগ থাকে, তাকে সহযোগিতা করে, ট্রাকের পেটে তুলে নেয়। যেখানে নামতে চায়, বিনা ভাড়ায় নামিয়ে দেয়। এটি যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি রোমাঞ্চকরও বটে।

Featured Image: Author

Related Articles

Exit mobile version