ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে ওই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
ট্রেনের ঝকঝক আওয়াজ তো বটেই, তার সাথে ট্রেন ভ্রমণে সুন্দর যেসব দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায় তা সহজেই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ইউরোপের কিছু কিছু রেলযাত্রা এতোটাই মনোমুগ্ধকর হয় যে, সেগুলো সম্পর্কে একেবারে না জানলেই নয়। চলুন জানা যাক সেসব ট্রেনযাত্রার কথা।
ওয়েস্ট হাইল্যান্ড লাইন, স্কটল্যান্ড
এটি ব্রিটেনের দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে লাইনগুলোর মধ্যে একটি! এই রেলওয়ে লাইনটি মাছ ধরার বন্দর মালেগ থেকে পশ্চিম উপকূলীয় এবং স্কটল্যান্ডের সবচাইতে বড় শহর গ্লাসগোর মাঝে সেতুবন্ধন হয়ে আছে। ২০০৯-১০ সালে ওয়ান্ডারলাস্ট ম্যাগাজিনের করা এক জরিপের মতে, এই রেলওয়ের যাত্রাকে পৃথিবীর সমস্ত রেলওয়ে যাত্রাগুলোর থেকে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশেষত, স্টিম ইঞ্জিন চালিত জ্যাকোবাইট ট্রেনের নান্দনিক যাত্রাই এই সৌন্দর্য বিবেচনায় শ্রেষ্ঠত্ব পাওয়ার প্রাপ্য। ৮৪ মাইল দীর্ঘ এই রেললাইনের যাত্রায় ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পাহাড়-পর্বত, গভীরতম হ্রদ, ছোট নদী এবং সর্বাধিক পশ্চিমা স্টেশনের দেখা মিলবে। হ্যারি পটার ভক্তরা এই ব্রিজটি চিনতে পারবেন না এমনটি হতেই পারে না! হ্যারি পটার মুভি সিরিজে হগওয়ার্টসে যাওয়া হতো এই রেলওয়ে লাইনের উপর দিয়েই, জ্যাকোবাইট ট্রেনে করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ২১ খিলানের এই গ্লেনফিনান ভায়াডাক্টটি তৈরি করা হয়েছিল, যা আজ ওয়েস্ট হাইল্যান্ড রেলওয়ে লাইনের একটি অংশ৷
বার্নিনা এক্সপ্রেস, সুইজারল্যান্ড
চোখ জুড়ানো রেলযাত্রা, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটেও নিজের স্থানটি দখল করে নিয়েছে! চারঘন্টা ব্যাপী এই নান্দনিক রেল যাত্রার অভিজ্ঞতা সহজে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। লাল রঙের এই বার্নিনা এক্সপ্রেস যে রেল লাইনের উপর দিয়ে চলে, তা আল্পস পর্বতের ২১৩ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। তুষারাবৃত সম্পূর্ণ আল্পস এলাকার সৌন্দর্য যে এই দর্শনীয় ট্রেনটি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাত্রী বোঝাই এই ট্রেনটি যখন ল্যান্ডওয়াসার নদীর দীর্ঘ সেতুর উপর দিয়ে পার হয়ে যায়, তখন চারদিকের দৃশ্যটা একেবারেই অপলক চেয়ে থাকার মতো মনে হয়। বার্নিনা এক্সপ্রেস উত্তর ইতালির তিরানো ও সুইজারল্যান্ডের প্রাচীনতম শহর শুরকে সংযুক্ত করেছে। এই রেল লাইনের সবচেয়ে উঁচু বিন্দু হলো সুইস স্টেশনের ‘অসপিজিও বার্নিনা’, যার অবস্থান সমুদ্রতল থেকে ৭,৩৯১ ফুট উপরে।
বার টু বেলগ্রেড, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া
স্বচক্ষে না দেখলে এই রেলযাত্রার অভিজ্ঞতা অনুভব করা সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ রেল লাইনটি ঘুরে আস্তে সময় লাগে দশ ঘন্টা বা তারও বেশি। ৪৭৬ কিলোমিটারের এই যাত্রায় মন্টেনেগ্রোর উপকূলীয় শহর বার থেকে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। এই পুরো যাত্রায় আপনি দেখতে পাবেন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের ঐতিহাসিক শহর বলাকানের সবচাইতে বড় হ্রদ, লেক স্কাদার এবং মন্টেনেগ্রোর অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়গুলো। পাহাড়ে পৌঁছানোর আগে চোখে পড়বে ইউরোপের অবশিষ্ট তিন অদূষিত বনগুলোর মধ্যে একটি- বায়োগ্রাদস্কা গোরা ন্যাশনাল পার্ক। এভাবেই যেতে যেতে আরো দেখা যায় বসনিয়া, বেলগ্রেডের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও নান্দনিক সব জায়গা। এটি হলো প্রকৌশলের বিস্ময়কর এক সৃষ্টি, যার সার্বিয়ার রাজধানী থেকে অ্যাড্রিয়াটিক যেতে ২৯৬ মাইলের যাত্রাপথে পড়বে ২৫৪টি সুড়ঙ্গপথ ও ৪৩৫টি সেতু।
গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস, সুইজারল্যান্ড
পৃথিবীর সবচাইতে ধীরগতির ট্রেন এই গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস। প্রায় আট ঘন্টার এই ট্রেনযাত্রার পথে ৯১টি সুড়ঙ্গপথ ও ২৯১টি সেতু রয়েছে। দৃষ্টিনন্দন ট্রেন যাত্রার দিক দিয়ে এই এক্সপ্রেসটির সাথে বার্নিনা এক্সপ্রেসের তুলনা করা হয়। ট্রেন যাত্রাটি সেন্ট মরিটজ, শুর (গ্রীষ্মকালে ড্যাভোস) থেকে যারম্যাট যাওয়া-আসা করে। এর মধ্য দিয়েই আল্পস পর্বতমালার পূর্ব থেকে পশ্চিম অংশের দেখা মিলবে। গ্লেসিয়ার এক্সপ্রেস দিয়ে যাওয়ার পথে দেখা যাবে তুষারাবৃত পর্বত, অনিন্দ্য সুন্দর সব নদ-নদী, শান্তিপূর্ণ আল্পাইন চারণভূমি, মনোমুগ্ধকর দুর্গ ও মনোরম গ্রাম। একেবারে সরু লাইনের উপর দিয়ে চলাচলকারী ২৯০ কিলোমিটার যাত্রার এই ট্রেনটি ঘন্টায় ২৪ মাইল বেগে ছোটে।
রমা লাইন, নরওয়ে
এই রেল লাইনটির যাত্রা হয় নরওয়ের ডম্বোস থেকে অ্যান্ডালস্নেস পর্যন্ত। রমা লাইনে যাত্রাপথে চোখে পড়বে চমৎকার সব পাহাড়, ওভার ব্রিজ, সুড়ঙ্গপথ ও ইউরোপের সবচেয়ে বড় শিলা মুখ ট্রলভেগ্যান। এছাড়াও দেখা যাবে পান্না সবুজ রঙের রমা নদী। কারণ এই রমা নদীর ধার দিয়েই চলে ট্রেনটি। তবে যাওয়ার তিন মাস আগে এর টিকিট কাটতে হয়। সবচাইতে দর্শনীয় জায়গাগুলো এবং জনপ্রিয় কাইলিং রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রেনটি ধীর গতিতে চলে, যেন যাত্রীরা প্রকৃতির বিস্ময়কর সুন্দর দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে পারে। আর ইউরোপের সর্বোচ্চ খাড়া পর্বত প্রাচীর ট্রলভেগ্যানে আসার পর ট্রেনটি সম্পূর্ণভাবে থামানো হয়। এই ট্রেনটির যাত্রার সময় নব্বই মিনিট।
ত্রেনিনো ভারদে ডেলা সারদেগনা, ইতালি
সারদিনিয়া (সারদেগনা) ভূমধ্যসাগরের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ যার অবস্থান ইতালিতে। সারদিনিয়ার ছোট্ট সবুজ ট্রেন ত্রেনিনো ভারদে ডেলা সারদেগনা শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালেই চলাচল করে। খুবই ধীর গতিতে চলাচলকারী এই ট্রেনটি যাত্রীদের নিয়ে যায় দ্বীপটির প্রায় সবগুলো ভৌগোলিক জায়গাতেই। এই ট্রেনটির চারটি ভিন্ন রেল লাইন আছে, যার মধ্য থেকে যাত্রীরা যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। তবে পশ্চিম অঞ্চলের শহর মানাদাস থেকে শুরু করে পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল আরবাটাক্স যেতে যে রেল লাইনটি পড়ে, সেখানে যাত্রাপথে দেখা যায় চোখ ধাঁধানো সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। একধরনের পাথরের টেবিল (মূলত খাড়া পাথরের উপর চ্যাপ্টা পাথর বসিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগে নির্মিত সমাধিকক্ষ), যা ‘জায়ান্টস গ্রেভ’ নামে পরিচিত, তার পাশ দিয়ে ট্রেনটি যায় এবং যাত্রাপথে সেখানে আরও চোখে পড়বে উঁচু উঁচু সব পাহাড়। সেই পাহাড়গুলোর ডাকনাম ‘টাকু’।
ইনল্যান্ডস্বানান, সুইডেন
দ্য ইনল্যান্ড লাইন বা ইনল্যান্ডস্বানান হলো সুইডেনের ১,৩০০ কিলোমিটার লম্বা একটি রেলওয়ে লাইন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ধীরগতির এই ট্রেনটির যাত্রাপথে মন বিমোহিত হয় সুন্দর সব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। ট্রেনটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে গ্যালিভার থেকে যাত্রা শুরু করে ক্রিস্টিনহ্যামে গিয়ে থামে। এই ট্রেনটির একটি বিশেষত্ব হলো, পুরো যাত্রায় ট্রেনে থাকা গাইডরা প্রতিটি জায়গা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। এতে করে জায়গাগুলো সম্পর্কে খুব ভালো ধারণাও হয়ে যায় যাত্রীদের। এই রেলযাত্রায় মোট সময় লাগে পাক্কা ১৪ ঘন্টা! এই সময়ের মধ্যে সুইডেনের পনেরোটি পৌরসভা ঘুরে দেখা যায় এই রেলগাড়ি চেপেই। শুধু কী তা-ই! যাত্রাপথে বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়বে মুজ, এল্ক (বিশেষ ধরনের হরিণ), বল্গাহরিণ ইত্যাদি।
লা ট্রেন জন, ফ্রান্স
‘লা ট্রেন জন’ কথাটির অর্থ হলো ‘ছোট হলুদ ট্রেন’। ৬৩ কিলোমিটার লম্বা এই ট্রেন যাত্রার মোট সময় ৩ ঘণ্টা। এই রেল লাইনটির সর্বোচ্চ বিন্দু হলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৫৯২ মিটার উঁচুতে, যা ফ্রান্সের রেল লাইনগুলোর মধ্যে সবচাইতে উঁচু বিন্দু! গ্রীষ্মকালে অবশ্য এই ট্রেনটির হলুদ বগির সঙ্গে সঙ্গে লাল বগিগুলোও চলাচল করে। তখন এই বগিগুলোর উপরের জানালাগুলো খুলে দেয়া হয়। ফলে সুড়ঙ্গপথ ও সেতু দিয়ে যাওয়ার সময় অভিজ্ঞতাটাই অন্যরকম হয়। প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলা এই ট্রেনটি ঘন্টায় ৫৬ কিলোমিটার বেগে ছোটে!