“দোহাই লাগে, তোরা আমাকে এখান থেকে টেনে তোল!”‚ কোমরসমান পানির মাঝে দাঁড়িয়ে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বললো আমার এক বন্ধু।
কেম্পটি ফলস (ঝর্ণা) দেখবার আশায় এসেছিলাম‚ পানিতে নামব এমন কিছু ঠিক করে আসিনি। দিল্লি থেকে উত্তরাখন্ডের যাত্রাটা বেশ ক্লান্তিকর ছিল, রাতে তাই ঘুমিয়েছিলাম মরার মতোই। মাসৌরির সকালটা এত আমেজে ভরা ছিল‚ সবাই কেমন অলস হয়ে পড়েছিল। তাই ফলস দেখার জন্যে রওনা দিতেও দেরি হয়ে গিয়েছিল। এদিকে সকালে আমি উঠেছিলাম সবার আগে। দাঁত মাজা‚ জামা বদলানো সারা হয়ে গেলে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব নিয়ে চারপাশটা ঘুরতে বের হলাম।
আমাদের হোটেল (ঠিক হোটেল না, বরং বোর্ডিং হাউজ বলা চলে) ছিল একটা পাহাড়ের চূড়ায়। রুম থেকে বের হয়ে আশেপাশের অসাধারণ দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল। সাপের মতো রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে গেছে কত নিচে! অভিযাত্রীর মতো এদিক ওদিক করে টিলা-টক্কর বেয়ে উঠতে উঠতে নিজেকে মনে হচ্ছিল‚ বাংলার কলম্বাস! ড্যান্ডেলিয়ন আর বুনো টগর নিয়ে খেলতে খেলতে আবিষ্কার করে ফেললাম হ্যান্সেল-গ্রেটেলের ডাইনির কুঁড়ের মতন পাথুরে কয়েকটা ঘর।
“বেহেনজি জলদি আসুন‚ নাস্তা খেয়ে বের হতে হবে”‚ ড্রাইভার সাহেবের তাড়া শুনে কাঠবিড়ালির মতন তরতরিয়ে নিচে নামা শুরু করলাম। অন্তত আমি তা-ই ভাবছিলাম। এমন সময় ফট করে স্যান্ডেল ছিঁড়ে গিয়ে পাথরের খোঁচায় ডান পায়ের তালুতে গভীরভাবে কেটে গেল। আমি মাথায় হাত দিয়ে ভাবলাম, এই বুঝি আমার অভিযাত্রিক জীবনের সমাপ্তি!
পা ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে মনমরা হয়ে গাড়িতে উঠলাম। হোটেল থেকে কেম্পটি মোটামুটি ২ ঘণ্টার পথ। এর মাঝেই কেউ ছবি তোলার জন্যে গাড়ি থামায় তো কেউ ‘নিম্বুপানি’ কেনার জন্যে। আমি ভেবেছিলাম ড্রাইভার সাহেব একটা রামধমক দেবেন‚ কিন্তু এতদিন ছিলাম- একবারের তরেও তিনি বিরক্ত হননি আমাদের শত আবদারের যন্ত্রণাতেও।
২ ঘণ্টার পথ যেতে আমরা লাগালাম সাড়ে ৩ ঘন্টা। পুরোটা পথ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি এগোচ্ছিল। মাঝে মাঝে এমন তীক্ষ্ণ কয়েকটা বাঁক নিচ্ছিল যে আশেপাশে তাকাতেও ভয় হচ্ছিল। কেম্পটি পৌঁছেও আবার পাহাড় বেয়ে প্রায় ১৫-২০ মিনিট নামতে হলো ঝর্ণার খোঁজ পেতে। এই রাস্তাটা কি যে সুন্দর‚ বলার মতো নয়। চিকন ফিতার মতো একগাছা রাস্তা‚ তার দু’পাশে বাহারি দোকানের সমাহার। জুতো-জামা থেকে শুরু করে রান্নাঘরের জিনিস‚ রঙিন গয়না‚ স্যুভেনির‚ বিচিত্র সব খাওয়াদাওয়া- কী নেই! ফেরার পথে ঘুরবো- নিজেকে এমন সান্ত্বনা দিয়ে তবেই এগোলাম।
বাংলাদেশের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলোতে যারা গিয়েছেন, তারা জানেন‚ পাহাড় বেয়ে একেবারে চপলা কিশোরীর মতন ছটফট করতে করতে পানির ধারা নামে‚ আর লোকে হাঁচড়-পাঁচড় করে গা ভিজিয়ে আসে সেখানে। একবারে ১৫-১৬ জন লোকের বেশি একসাথে গোসল করতে পারে না। কেম্পটি ফলসও এমন গোছের ঝর্ণা‚ এই ভেবে ঝর্ণার সিঁড়ি বেয়ে বাঁক ঘুরেই দেখি- কি এলাহী কাণ্ড!
এই ঝর্ণা মোটেই ছোটখাট নয়‚ বরং চারপাশে বাঁধ দিয়ে একটা সুইমিংপুল বানিয়ে ফেলেছে। গোটা চল্লিশেক লোক বিপুল উৎসাহে দাপাদাপি করছে‚ প্লাস্টিকের বল‚ খেলনা‚ টিউব কিছুর অভাব নেই পানিতে। আর ঝর্ণার কথা কী বলবো‚ ভীম সাইজের অনেকগুলো পানির ধারা একসাথে নামছে।
“প্লিজ প্লিইইজ গোসল করবো চল!”‚ নেকু-নেকু গলায় এক বন্ধু বলে উঠল।
আমরা দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে উঠে চেঞ্জ রুমে গেলাম। আমার সঙ্গের মানিব্যাগে প্রায় ৫,০০০ রুপি‚ বাকি রুপি হোটেলে রেখে এসেছি। ৮-৯ দিনের সফরে মোট ২৭,০০০ রুপির বাজেট‚ শপিং ছাড়া। ১৬,০০০ এর মাঝেই গেছে অ্যাডভান্স বুকিংয়ে। লকারে সব রুপি, পাসপোর্ট তালা দিয়ে দৌড়ে নামলাম‚ সবার আগে এক পণ্ডিত গোছের বন্ধু ঝুপ করে লাফিয়ে নেমে… (পাঠক‚ এবার একেবারে প্রথম লাইন পড়ুন!)
আমি হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি পানিতে ডুবিয়ে দেখি‚ সাড়ে সর্বনাশ। এমন ঠাণ্ডা পানি‚ ওর মধ্যে নামলে গোটা শরীর জমে বরফ হতে খুব একটা সময় লাগবে না। এর মাঝে এত লোক কী করে খালি গায়ে নাচানাচি করছে কে জানে! এটা-সেটা ভেবে শেষে স্রষ্টাকে স্মরণ করে পানিতে নেমে পড়লাম। প্রথম ১০ মিনিট অবর্ণনীয় ঠাণ্ডায় কেউ কথা বলতে পারছিলাম না‚ মনে হচ্ছিল সারা গায়ে সূঁচ ফুটছে! খানিক পরে সবাই ধাতস্থ হলাম। আমার পায়ের কাটাটা খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল‚ আমি খুব একটা আমলে নিলাম না।
পাহাড়ের উপর থেকে তীব্র বেগে পানি পড়ছিল। একটু মন দিয়ে দেখলে ঘণ্টায় কত বেগ, তা হিসেব করে ফেলা যেত‚ কিন্তু ভিজতে ভিজতে আর দাপাদাপি করতে সেই সময় কোথায় পাই?
বেশ অনেকক্ষণ গোসল করার পর উঠে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরলাম। পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠার সময় বেশ কিছু স্যুভেনিরের দোকানে ঢুকে এটা-ওটা নাড়লাম‚ সুন্দর একটা গণেশের মূর্তি পছন্দ হলে কিনে নিলাম। কত কী যে এই ১৫-২০ মিনিটে খেলাম‚ হিসেব নেই। আমুল কোম্প্যানির চকলেট মিল্ক‚ কয়েক ফ্লেভারের লেইস চিপ্স‚ নিম্বু পানি‚ ভূট্টা পোড়া… শেষের খাবারটা আমার বেশ ভালো লাগলো। বাংলাদেশের মতন শক্ত আর শুকনো নয়‚ মুখে দিলে গলে যায় এমন নরম। ভূট্টার ওপর লেবুর রস আর বিট লবণের একটা আস্তর। জিভে লাগলেই খোশমেজাজ এসে যায়!
এখানে একটা ভারি সুন্দর মলরোড আছে। দু-তিনজন লাঞ্চের জন্য একটা রেস্তোরাঁর খোঁজে গেল‚ আমি মল রোড ধরে খানিকক্ষণ হাঁটলাম। খুব বেশি পর্যটক নেই‚ স্থানীয় লোকজনই বেশি। একটা গুজরাটি দোকানে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম‚ এত সুন্দর সুন্দর বিছানার চাদর‚ জামা আর ওড়না! এখানে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি পোশাক পরে ছবি তোলা যায়‚ তা আমার ভোঁতা নাক আর ছোট চোখ দেখেই কি না কে জানে, আদিবাসী চেহারার কয়েকজন আমাকে বেশ হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাল। আমি উত্তরে হাসলাম।
লাঞ্চের সময় দুয়েকজনের বেশ মন খারাপ‚ গতকাল দুপুরের পর থেকে কোনো মাছ-মাংস খায়নি কেউ। দিল্লি থেকে গাড়িতে ওঠার আগে এক বেলুচি দোকানে প্রাণভরে খাসির দম বিরিয়ানি খেয়েছিলাম তাজা তাজা সালাদ সহযোগে‚ কাঁসার গ্লাসে লাচ্ছি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলাম। সেকথা মনে হতেই পেটের ভেতর কে যেন কেঁদে উঠল। আলু পরোটা‚ দই আর নুডলস কাঁহাতক ভাল লাগে? তবু‚ এখানে দোসা‚ ছোলা ভাটুরা আর পনিরের তরকারি খেয়ে বেশ ভালোই লাগল।
“ভাইসাব‚ পরের স্টপেজ কোথায়?”
“মাসৌরি সিটি!”
ফিচার ইমেজ © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম