চিন্তা করুন তো একবার, পানির নিচে কাঁচে ঘেরা এক রেস্টুরেন্টে বসে প্রিয়জনের সাথে সময় কাটাচ্ছেন, আপনার সামনে পরিবেশন করা হচ্ছে দেশ-বিদেশের সুস্বাদু সব খাবার। এই বুঝি আপনার পাশে কাঁচের ওপাশে একটি বিরল সামুদ্রিক মাছ সাঁতার কেটে গেল, যেন হাত বাড়ালেই ধরা যায়, কিন্তু ধরতে পারছেন না। অপরূপ এ পরিবেশে যেতে ইচ্ছে করছে? সত্যি কিন্তু এরকম জায়গা আছে! আর সেটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল দুবাইয়ের বুর্জ আল আরবের আন্ডারওয়াটার রেস্টুরেন্ট। আর কী কী আছে এ হোটেলে? এগুলো নিয়েই আমাদের আজকের পরিবেশনা।
‘বুর্জ’ শব্দের অর্থ টাওয়ার। তাই ‘বুর্জ আল আরব’ (برج العرب) অর্থ আরবের টাওয়ার। আরব আমিরাতের দুবাইতে এই বিলাসবহুল হোটেলটি অবস্থিত। এটি বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম হোটেল। অবশ্য পুরো দালানের ৩৯% ব্যবহারের অযোগ্য, এমনি এমনিই রাখা আছে কেবল উচ্চতা বাড়াবার জন্য।
বুর্জ আল আরব জুমাইরা বিচ থেকে ২৮০ মিটার বা ৯২০ ফুট দূরে এক কৃত্রিম দ্বীপের উপর দাঁড়িয়ে। একটি ব্রিজের দ্বারা মূল ভূমির সাথে এটি লাগানো। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, সাগরের বুকে একটি জাহাজের পাল যেন এটি।
বুর্জ আল আরবের চূড়ায় রয়েছে একটি হেলিপ্যাড, যা কিনা মাটি থেকে ২১০ মিটার বা ৬৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ইচ্ছে করলেই এখানে ক্লিক করে আপনি এর ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখে নিতে পারেন!
১৯৯৪ সালে এই হোটেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়, আর শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। হোটেলের ৫৬টি তলার মাঝে তিনটি হলো পানির তলে! ১৮টি লিফট আছে পুরো হোটেলে। স্থাপত্যবিদ টম রাইট এই দৃষ্টিনন্দন ভবনের নকশাকারী। তাকে বলা হয়েছিল এমন কিছু নির্মাণ করতে, যেটি হবে দুবাইয়ের ‘আইকন’। সিডনির নাম শুনলেই যেমন অপেরা হাউজের কথা মাথায় আসে, লন্ডন বলতেই যেমন বিগ বেন কিংবা প্যারিস বলতেই আইফেল টাওয়ার, তেমনই দুবাই বলতেই যেন মাথায় আসে বুর্জ আল আরব! তিনি ঐতিহ্যবাহী আরবীয় নৌকার পালের আকারে বুর্জ আল আরবের ডিজাইন করেন, যা ভবিষ্যতের দিকে পাল তুলে এগিয়ে যাওয়া বোঝায়। ব্রিটিশ মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিজাইন কোম্পানি ডব্লিউএস অ্যাটকিন্স নির্মাণ দেখভাল করে এই ২০২ কক্ষের হোটেলটির।
যেখানে বুর্জ আল আরব আছে, সেই বিচের আগের নাম ছিল শিকাগো বিচ। সেখানে আগে দুবাই শিকাগো বিচ হোটেল ছিল, যা ১৯৯৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়। বুর্জ আল আরব বানাবার সময় প্রোজেক্টের নাম দেয়া ছিল ‘দুবাই শিকাগো বিচ হোটেল প্রোজেক্ট’, এরপর দুবাইয়ের শাসক এবং আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নতুন ‘বুর্জ আল আরব’ নাম ঘোষণা করেন।
কৃত্রিম দ্বীপটি ১৯৯৪ সালে বানানো শুরু হয়। হোটেলটি বানাতে প্রায় ২,০০০ জন শ্রমিক লেগেছিল। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে হোটেলটির উদ্বোধন করা হয়। দ্বীপটি বানাতে তিন বছর লাগলেও হোটেলটি বানাতে তিন বছরের কম সময় লেগেছিল! ভবনটি বানাতে লেগেছিল সত্তর হাজার কিউবিক মিটারের কনক্রিট আর নয় হাজার টন ইস্পাত। বুর্জ আল আরব যদিও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম হোটেল, তবে খোদ দুবাইতেই কিন্তু এটি উচ্চতম ভবন নয়! দুবাই এর রোজ রায়হান হোটেল (৭২ তলা) বুর্জ আল আরব থেকেও ১১ মিটার বা ৩৬ ফুট বেশি উঁচু।
জুমাইরা গ্রুপ বুর্জ আল আরব হোটেলটি পরিচালনা করে থাকে। এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও এই হোটেলে মাত্র ২৮টি উভতল তলা রয়েছে, সব মিলিয়ে যেখানে আছে ২০২টি স্যুট। হোটেলের সবচেয়ে ছোট যে স্যুটটি, সেটি ১,৮২০ বর্গফুট, আর সবচেয়ে বড়টি ৮,৪০০ বর্গফুট! স্যুটগুলোর রয়েছে পূর্ব আর পশ্চিম পাশ। সাদা রঙের কলামে ভরপুর কক্ষ ছাড়াও রয়েছে মোজাইক টাইল করা বাথরুম, বাথরুমের নানা উপকরণ আবার সোনায় মোড়ানো!
২০১২ সালে সিএনএন-গো বিশ্বের ১৫টি দামি হোটেল স্যুটের তালিকায় বুর্জ আল আরবের রাজকীয় স্যুটকে স্থান দেয় ১২তম অবস্থানে। জানতে চান, কত খরচ পড়বে এক রাত সেখানে থাকতে? মাত্র চব্বিশ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রায় বিশ লক্ষ টাকা। সত্যিকারের বিলাসবহুল রাজকীয় বা হানিমুন স্যুটগুলো ওরকম ২০ লাখ টাকার মতো প্রতি রাত, কিন্তু নামকাওয়াস্তে রুম দেড় লাখ টাকা থেকেই পাওয়া যেতে পারে। হানিমুনের জন্য এর চেয়ে ভালো হোটেল আর হয়না, তবে দুবাইয়ের ধর্মীয় আইনের কারণে কাপলদেরকে অফিশিয়াল ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখাতে হতে পারে একই রুমে থাকবার জন্য।
এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে, হোটেলে যাবেন কিন্তু খানাপিনা করবেন না তা কি হয়? আল মুন্তাহা নামের রেস্তোরাঁটি ৬৬০ ফুট উঁচুতে, যেখানে বসে আপনি চারপাশ তাকিয়ে দেখতে পাবেন দুবাইয়ের পুরো দৃষ্টিনন্দন একটি দৃশ্য, আবার অন্যপাশে দেখতে পাবেন সাগর। মূল ভবন থেকে ক্যান্টিলিভারের সাহায্যে ২৭ মিটার বর্ধিত জায়গাতে স্থাপিত এ রেস্তোরাঁটি। খাবারের দাম যে খুব বেশি, সেটি নিশ্চয়ই বলবার অপেক্ষা রাখে না।
হোটেলের আরেকটি বিখ্যাত রেস্তোরাঁ হলো আল মাহারা, ওখানে ঢুকবার জন্য আপনাকে অনুভূতি দেয়া হবে যেন আপনি সাবমেরিনে করে চলেছেন। বিশাল এক একুরিয়ামের পাশে বসে আপনি খাবেন, আপনার চারপাশে মাছ পানিতে সাঁতার কেটে চলেছে, নয়নাভিরাম একটি আন্ডারওয়াটার রেস্তোরাঁ। একুরিয়ামে ৯,৯০,০০০ লিটার পানি রয়েছে। ৭.১ ইঞ্চি পুরু অ্যাক্রিলিক কাঁচ দিয়ে পানির চাপকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা আছে এখানে।
অনেকে বুর্জ আল আরবকে ‘সেভেন স্টার’ হোটেল বলে থাকেন, কিন্তু আসলে সেটি একটি ভুল ধারণা। এটি একটি পাঁচ তারা বা ফাইভ স্টার হোটেলই। ‘সাত তারা’ কথাটা কীভাবে এসেছে কে জানে, তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ বলে থাকেন যে, তারা কখনোই এটা বলেননি! যত অসাধারণই হোক দেখতে এই হোটেলটি, সমালোচনার উর্ধ্বে কিন্তু উঠতে পারেনি এটিও। অনেক সমালোচকের মতে, বাস্তবিক ভালো ডিজাইনের চেয়ে টাকার জোশ দেখানোতেই নাকি ব্যস্ত এই হোটেলটি!
৬৮৯ ফুট উঁচুতে থাকা সেই হেলিপ্যাডে অনেক বিখ্যাত অনুষ্ঠান করা হয়েছে মিডিয়াকে আকর্ষণ করবার জন্য। যেমন- ২০০৪ সালে টাইগার উডসকে আনা হয়, ২০০৫ সালে আগাসি আর ফেদেরার সেখানে টেনিস খেলেন, তবে টেনিস খেলার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে জায়গাটিতে চার ঘণ্টা কাজ করতে হয়েছিল। এরকম আরো অনেক মিডিয়া স্টান্ট সেখানে করা হয়েছে। এমনকি অনেক মুভি কিংবা সিরিজেও দেখা যায় বুর্জ আল আরবকে, যদিও বুর্জ খলিফা এ ব্যাপারে বেশি প্রাধান্য পায় বুর্জ আল আরবের চেয়ে; সেই বুর্জ খলিফা নিয়ে কথা হবে অন্য কোনো দিন!
এবার কিছু অবাক করা বিষয় জানা যাক বুর্জ আল আরব নিয়ে। যেমন- এই হোটেলের Junsui Lounge-কে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির মতো বানাবার জন্য ২৯,০০০ ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয়!
প্রতি বছর এই হোটেলের রেস্টুরেন্টগুলোতে ১০ টন চকলেট ব্যবহার করা হয়।
যদি একজন লোক একা এই ভবন নির্মাণের কাজ করতেন, তবে তার আট হাজার বছর সময় লাগত কাজ শেষ করতে।
দিনের বেলাতে কোনো রকমের কৃত্রিম আলো এই হোটেলে জ্বালানো হয় না আদৌ! এটি আলোকিত থাকে সম্পূর্ণ সূর্যের আলোয়!
হোটেলের ফ্রন্ট অফিস ও গ্রিটিং ডেস্কের সকল নারী সদস্য বুর্জ আল আরবের লোগোর আকৃতিতে বানানো সোনার নেকলেস আর কানের দুল পড়েন।
হোটেলের সকল জানালা বাইরে থেকে পরিস্কার করবার জন্য ১৯ জনের টিমকে পুরো এক মাস কাজ করতে হয় দড়িতে ঝুলে ঝুলে। আর আপনি যদি হোটেলের ২৭ তলায় হেঁটে উঠতে চান, তবে ১০৮০টি সিঁড়ি বাইতে হবে।
দুবাই এর সর্বোচ্চ দালান বুর্জ খলিফা নিয়ে রোরের লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন। তবে বুর্জ আল আরব নিয়ে আমাদের আজকের আলাপ এ পর্যন্তই; লেখাটি পড়ে কি আপনার ইচ্ছে হচ্ছে বুর্জ আল আরবে একটি রাত কাটাবার?