একটা বানর তার ছোট্ট বাচ্চাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখে এক গাছ থেকে আরেক গাছে চড়ে বেড়াচ্ছে। কখনওবা নেমে আসছে মাটিতে, হাঁটছে দর্শনার্থীদের সাথে। যেন সে পথ দেখিয়ে যাবে এই সবুজ অরণ্যে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম চিরহরিৎ বন। বানরের দেখা পাওয়া গেল এই বনের প্রবেশমুখেই।
ইতিহাস
লাউয়াছড়া উদ্যানের পুরনো নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে বৃক্ষায়ন শুরু করে। এসব গাছপালা বেড়েই লাউয়াছাড়া বনের সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়।
শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলার মৌলভীবাজার রেঞ্জের প্রায় ২,৭৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যে এ বনের প্রায় ১,২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালের ৭ই জুলাই জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে এই বন সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের অধীনে রয়েছে।
সবুজের বিশালতায়
সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ মাস, লাউয়াছড়ায় যাওয়ার উপযুক্ত সময় ধরা হয়ে থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ড ট্যুরের অংশ হিসেবে গত বছর (২০১৯) আমরা গিয়েছিলাম জুলাইয়ের শেষে। সারারাতের বাস জার্নি শেষে সকালটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম জাতীয় এই উদ্যানে। বিশালাকার দুটি গাছের খণ্ড থেকে তৈরি মূল ফটকটি আপনাকে বনে প্রবেশের পূর্বেই এ বন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলবে। জানিয়ে রাখা ভালো, বনে প্রবেশ করতে বয়সভেদে নামমাত্র কিছু প্রবেশমূল্য দিতে হয়। সেটা পরিশোধ করে প্রবেশ করলাম আমরা।
এ বনে সমতল পথ যেমন আছে, তেমনই আছে পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ। তবে শুরুতে সমতল পথের দেখাই মিলল। দু’পাশে বিশালাকার উঁচু গাছের সারির মাঝে পিচঢালা পথ। এ পথেই দেখা সেই বানরের। যাওয়ার পথের বেশ অনেকটা সময় এই বানর তার বাচ্চাসমেত আমাদের সঙ্গী ছিল। বাংলাদেশে বানরের মোট পাঁচ প্রজাতির চারটিই রয়েছে লাউয়াছড়ায়।
লাউয়াছড়ায় বনের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। এসব ছড়ার বেশিরভাগই পানিতে পূর্ণ থাকে বর্ষাকালে। তবে অবস্থানগত কারণে এ বনে সারা বছরই কমবেশি বৃষ্টি হয়, বনবিভাগের তথ্যমতে, বৃষ্টির পরিমাণ বছরে গড়ে ৩৩৩ সেন্টিমিটার। এ বৃষ্টিপাত ভূমিকা রাখছে এই বনের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধিতে। আমরা যখন গিয়েছিলাম, সে সময়টা বর্ষাকাল ছিল, বৃষ্টির দেখাও মিলেছিল সময়ে সময়ে। ছড়াগুলোয় তাই পানি ছিল কিছুটা। যেসব ছড়ায় পানির পরিমাণ বেশি থাকে, সেসবের উপরে কালভার্ট নির্মাণ করে চলাচলের পথ তৈরি করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রেও লাউয়াছড়া
লাউয়াছড়ায় মূল ফটক পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই রেললাইন চোখে পড়ে, এই রেললাইন দিয়ে ঢাকা-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল করে থাকে। এই রেললাইনের কাছেই একটি সাইনবোর্ডে চলে গেল চোখ। জানা গেল, এ স্থানেই ৬৫ বছর আগে শ্যুটিং হয়েছিল হলিউড চলচ্চিত্র ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ এর। বছরখানেক পর ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। মাইকেল আন্ডারসন পরিচালিত এ চলচ্চিত্র অস্কারও জিতে নিয়েছিল পরের বছর। সেই চলচ্চিত্রের এ স্থানে হাতিকে দেখানো হলেও এত বছর পর এসে লাউয়াছড়ায় হাতির দেখা পাওয়া ভার। লাউয়াছড়ায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেরও শ্যুটিং হয়েছে। ২০০৮ সালে ‘আমার আছে জল’ নামের সেই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। এই সম্পর্কিত একটি সাইনবোর্ডও চোখে পড়বে রেললাইনের পাশে।
পাহাড়ি পথের বাঁকে
রেললাইন পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাই বনের আরও গভীরে। দেখি বনের সৌন্দর্য, নাম না জানা হাজারো উদ্ভিদ ঘেরা এই বনের সবুজের বিশালতা মুগ্ধ করবে প্রকৃতিপ্রেমী যে কাউকে। গবেষকেরা বলছেন, এ বনে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। আছে সুন্দরবনের বিখ্যাত সুন্দরী গাছও।
এছাড়া পথে পথে দেখা যাবে গর্জন, সেগুন, গামার, জামরুল, চাপালিশ, মেনজিয়াম, নাগেশ্বর, শিমুল, লোহাকাঠ, জাম, ডুমুর, তুন, কড়ই, জগডুমুর, মুলি বাঁশ ইত্যাদি গাছের। এ বনের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে নানা ধরনের বনফুল। দুর্লভ এসব ফুলের কোনোটি জানা-অজানা বিরুৎ-গুল্মের, কোনোটি বা পরাশ্রয়ী অর্কিডের। তবে নব্বই দশকের তুলনায় বনে এখন গাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। উদ্যানটির দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন এই তথ্য। তারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল কর্মচারী থাকায় উদ্যান রক্ষণাবেক্ষণে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। ফলে, দিনে দিনে গাছের সংখ্যা কমছে।
বনের যত গভীরে গিয়েছি আমরা, পাখিদের কলকাকলিতে মুখর দেখেছি আশেপাশের পরিবেশ। টিয়া, কোকিল, পেঁচা, ফিঙ্গে, ঘুঘুসহ প্রায় ২৪৬ প্রজাতির পাখির বিচরণ এই বনের গাছগাছালিতে। বন্যপ্রাণীদের জন্য এক অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে লাউয়াছড়ার এই বন। ৪৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫২ প্রজাতির সরীসৃপ ও ২৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীতে সমৃদ্ধ এই বন।
এই বন যে প্রাণীর জন্য বিখ্যাত বলে পরিচিত, সেই বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের দেখা পাইনি আমরা। বছর তিনেক আগের এক তথ্য বলছে, এ বনে এখন ১১টি পরিবারে প্রায় ৪০টি উল্লুক রয়েছে। ভাগ্য ভালো থাকলে রেললাইনের আশেপাশেই দেখা মিলতে পারে উল্লুকের দলের। এই বনে মুখপোড়া হনুমানের দেখা মিলবে, যেটিও আছে বিপন্ন হওয়ার তালিকায়। আমরা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোতে থাকি সবুজের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আলিঙ্গনে।
বনের বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় অনেক টিলা আছে। সেই টিলা কেটেই তৈরি হয়েছে পায়ে চলার পথ৷ লাউয়াছড়া উদ্যানে ঘুরে বেড়ানোর তিনটি পথ আছে। একটি তিন ঘণ্টার, একটি এক ঘণ্টার এবং অন্যটি আধ ঘণ্টার পথ। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়া পল্লীও আছে, যেটি দু’ ঘণ্টার পথটি ধরে এগোলেই পাওয়া যাবে। এখানকার বাসিন্দারা সাধারণত পান চাষ করে থাকেন। সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের দেখা হয়নি সে পল্লী। এ বনে একটি গেস্ট হাউস আছে, সে পথে এগোলে শুনতে পাবেন ঝিঁঁঝিঁ পোকার ক্লান্তিহীন শব্দ। আরও কিছু জায়গায় ভ্রমণসূচী ছিল বলে লাউয়াছড়ায় ঘণ্টাদুয়েক ছিলাম সেদিন।
বনের সমৃদ্ধিতে রাখুন ভূমিকা
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি মানবসৃষ্ট বন। এই বন তার জীববৈচিত্র্যের বাহারে ক্রমেই যেন হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক বনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই বনকে তার সমৃদ্ধির পথে সহযোগিতা করা আমাদেরই দায়িত্ব। লাউয়াছড়া ভ্রমণে গিয়ে তাই সচেতন থাকুন, সতর্ক থাকুন, আপনার কারণে যেন এই বনের পরিবেশ তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। বনের বিভিন্ন অংশে কিছুদূর পরপরই ডাস্টবিন আছে, সবধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলুন সেখানেই। যথাসম্ভব নীরব থাকার চেষ্টা করুন চলার পথে। বন এলাকায় আগুন জ্বালাবেন না। বানর বা অন্যান্য প্রাণী সামনে পড়লে তাদের বিরক্ত করবেন না, তাদেরকে তাদের মতো করেই থাকতে দিন। আমার আপনার ছোট্ট কিছু সচেতনামূলক কাজই এই বনকে বাঁচিয়ে রাখবে আরও বহু বছর।