বিস্তীর্ণ নীল সমুদ্র। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্লাটফর্ম। নাম তার সিল্যান্ড। এটি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ! কী? চমকে উঠলেন? হ্যাঁ, আমরা সবাই হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে ভ্যাটিকান সিটিকেই চিনি। কিন্তু ভ্যাটিকান ছাড়াও আরো একটি দেশ রয়েছে, যাদেরকে বিশ্বের অন্য দেশগুলো এখনো স্বীকৃতি না দিলেও এরা নিজেদেরকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ বা মাইক্রোনেশন হিসেবেই দাবি করে। আর শুধু তা-ই নয়, তাদের দাবি অনুসারে, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ। তো চলুন আজকে জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ সিল্যান্ড সম্পর্কে।
প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড
‘প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড’ সংক্ষেপে সিল্যান্ডের অবস্থান ব্রিটিশ সমুদ্র উপকূল থেকে ছয় মাইল দূরে। প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে টিকে আছে এই সিল্যান্ড। এটি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন কর্তৃক স্থাপিত একটি সামুদ্রিক দুর্গ। প্রথমদিকে একে ডাকা হতো ‘রাফস টাওয়ার’ নামে। এর কাজ ছিল শত্রু বিমানকে প্রতিহত করা, ইংল্যান্ডের জলসীমায় জার্মান মাইন বসানো পর্যবেক্ষণ করা ও তা সম্পর্কে রিপোর্ট করা। যুদ্ধের সময় এটি ছিল প্রায় ১৫০-৩০০ জন সৈন্যের আবাসস্থান। সেই সাথে এখানে ছিল বিভিন্ন রাডারের যন্ত্রপাতি, দুটি ৬ ইঞ্চি বন্দুক, এবং দুটি ৪০ মি.মি. অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট অটোমেটিক কামান। ১৯৫৬ সালে রয়াল নেভি একে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
সিল্যান্ডের গঠন
সিল্যান্ডের এই অবকাঠামোটি আসলে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল ডুবন্ত জাহাজের উপরে। ১৯৪২ সালে প্রথমে একটি ফেরির ন্যায় বিশাল ভাসমান সমতল জাহাজ নেওয়া হয়। এরপর এর উপরে পাটাতন যুক্ত দুটি কংক্রিটের ফাঁপা টাওয়ার যুক্ত করা হয়, যাতে এর উপরে অন্যান্য কাঠামো তৈরি করা যায়। এই দুই টাওয়ারের প্রতিটি ছিল মোট সাত তলা করে। এগুলো খাবার ও ঘুমানোর ঘর, গুদাম ঘর ও নানা যুদ্ধোপকরণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো। এর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনটি টাগবোটের সাহায্যে একে ‘রাফ স্টান্ড’ বালুতটে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে নিয়ে আসার পর এটির সেই বিশাল সমতল জাহাজটিকে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সেটি উপরের গোটা কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। উপরে সমস্ত কাঠামোর ক্ষেত্রফল ১৫ গজ X ৪০ গজ।
সিল্যান্ডের ইতিহাস
যুদ্ধশেষে যখন সিল্যান্ডের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখন রয়েল নেভি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। ফলে এই অবকাঠামোটি পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে থাকে কয়েক বছর। এরপর ১৯৬৭ সালে এখানে একটি অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী দল ঘাঁটি গাড়ে। তারা এই স্থানটি তাদের হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং প্যাড হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এবং এখানে আরামে বসবাস শুরু করে। কিন্তু তাদের এই আরাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে আরেক অবৈধ বেতার সম্প্রচারকারী রয় বেটস এখানের আগের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে এই স্থানটি দখল করে নেয়। রয় বেটস এর আগে ‘রেডিও এসেক্স’ নামের আরেকটি অবৈধ বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করতো। কিন্তু তা ৩-মাইল ব্রিটিশ এলাকার মধ্যে হওয়ার একসময় বেটস ধরা পড়ে যায় ও তাকে জরিমানা দিতে হয়। ফলে বেটস তার সমস্ত যন্ত্রপাতি ও ১৫ বছর বয়সী ছেলে মাইকেলকে নিয়ে রাফস টাওয়ারে এসে ওঠে ও দীর্ঘ এক লড়াইয়ের পর এটি দখল করে নেয়। কিন্তু তবুও এই টাওয়ারটি পরবর্তীতে আর পরিপূর্ণভাবে বেতারকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ ততদিনে সমুদ্র আইনে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। আর সেই পরিবর্তন অনুসারে ব্রিটিশ এলাকার বাইরের বেতার সম্প্রচারগুলো অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
সে যা-ই হোক, রয় বেটস দখলকৃত এই কৃত্রিম দ্বীপটি ছেড়ে যাননি আর। তিনি এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এবং একে ‘প্রিন্সিপ্যালিটি অফ সিল্যান্ড’ নামের এক সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। তার এই ঘোষণার পেছনে কলকাঠি নাড়েন একজন উকিল, যিনি বেটসকে কীভাবে এটি স্থায়ীভাবে দখল করা যায়, সে বুদ্ধি দেন। আসলে এই অবকাঠামোটির অবস্থান আন্তর্জাতিক জলসীমায়। আর পৃথিবীর কোনো দেশেরই এই আন্তর্জাতিক জলসীমার মালিকানা নেই। কোনো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে। ফলে যে কেউ এখানে ইচ্ছা করলেই ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারবে। এছাড়া এটি ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরে। ফলে চাইলেও রয়েল নেভি এখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
কিন্তু এর পরের বছরই সিল্যান্ডকে মুখোমুখি হতে হয় আরেক বিপদের। একদিন সিল্যান্ডের দিকে একটি ‘ব্রিটিশ ট্রিনিটি হাউজ’ জাহাজ এগিয়ে আসলে রয় বেটস জাহাজটির দিকে সতর্কীকরণ গুলি ছোড়েন। ফলে পরবর্তীতে বেটস ইংল্যান্ডে প্রবেশ করলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রয় ও মাইকেল বেটসের নামে দায়েরকৃত এই মামলা আদালতে উত্থাপন করা হয়। তবে সিল্যান্ড ব্রিটিশ সীমানা ও বিচারব্যবস্থার বাইরে হওয়ায় বেটস পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না বলে ঘোষণা দেন বিচারক। ফলে সে যাত্রায় বেঁচে যান বেটস।
এরপর কয়েক বছর বেশ শান্তিতেই কেটে যায়। এর মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন গ্রুপ ও চোরাকারবারি দল সিল্যান্ড দখল নেওয়ার চেষ্টা করলেও রয় বেটস তাদের প্রতিহত করেন এবং তার এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর ১৯৭৫ সালে সিল্যান্ড থেকে রাজ্যের সংবিধান প্রকাশ করা হয়। ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, ডাক টিকিট, মুদ্রা ও পাসপোর্ট চালু করা হয়। সিল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক ও সীলমোহরের নকশা তৈরি করা হয় সিল্যান্ডের জাতীয় নীতিবাক্য “E Mare Libertas” অনুসারে, যার অর্থ, “সমুদ্র হতে, স্বাধীনতা”।
এই স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক ১০ বছর পর ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে একটি জার্মান ও ডাচ হীরা ব্যবসায়ী দল রয় বেটসকে একটি ব্যবসায়িক কাজে অস্ট্রিয়াতে আমন্ত্রণ জানায়। অস্ট্রিয়ায় এসে পৌঁছলে রয় ও তার স্ত্রী জোয়ানকে পাঁচজনের একটি দল স্বাগত জানায় ও ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে নিয়ে যায়। বেটস পরিবার সম্মেলনে পৌঁছান, তবে সম্মেলনে কিছু আলোচনা না হতেই সম্মেলনটি শেষ হয়ে যায়। এমন সন্দেহজনক আচরণে রয় বেটস সিল্যান্ডে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তবে সেখানে কোনো টেলিফোন কিংবা রেডিও না থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। তবে তারা পার্শ্ববর্তী জেলেদের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন সিল্যান্ডে নাকি বিশাল এক হেলিকপ্টার অবতরণ করেছে। ফলে এক বিপদের সম্ভাবনা বাসা বাঁধে বেটস দম্পতির মনে।
তাদের এই সন্দেহ সত্যিতে পরিণত হয় যখন তারা কয়েক দিন পর মাইকেলের খোঁজ পান। তারা সিল্যান্ড ত্যাগ করার কয়েকদিন পর রয়ের কাছ থেকে পাঠানো একটি চিঠি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে সিল্যান্ডে একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে। কিন্তু অবতরণের সাথে সাথেই তারা রয় কর্তৃক নিযুক্ত তৎকালীন সিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় গোটা সিল্যান্ড দখল করে নেয় এবং মাইকেলকে আটক করে। এরপর তারা মাইকেলকে খাদ্য ও পানীয়হীন অবস্থায় তিন দিন একটি কক্ষে আটকে রাখে এবং অবশেষে তাকে একটি ডাচ লঞ্চে করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। লঞ্চটি মাইকেলের অর্থকড়ি ও পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে তাকে কর্পদকশূন্য অবস্থায় হল্যান্ডে ফেলে রেখে যায়।
এই ঘটনার পর পুনরায় পরিবারের সবাই একত্র হলে বেটস পরিবার কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও জনবল জোগাড় করেন। তাদের মধ্যে জেমস বন্ড সিনেমায় কাজ করা একজন পাইলটও ছিলেন। এরপর তারা সবাই মিলে সিল্যান্ড পুনরুদ্ধার অভিযানে রওনা হন। সেখানে পৌঁছানোর পর মাইকেল লুকিয়ে সিল্যান্ডের ডেকে শটগান হাতে নেমে পড়েন এবং কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। খুব শীঘ্রই সিল্যান্ড দখলকারী দল আত্মসমর্পণ করে। তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বহুদিন আটক করে রাখা হয়। পরবর্তীতে তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে তাদের মুক্তির আবেদন করা হলে তাদেরকে সেই দেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে সিল্যান্ড ফিরে পায় তার স্বাধীনতা। এর বহু বছর পর ২০১২ সালে রয় বেটস মৃত্যুবরণ করেন।
সিল্যান্ডের বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশ সিল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব ও বৈধতার স্বীকৃতি না দিলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। মাত্র ৫৫০ বর্গ মিটারের এই রাষ্ট্রটি বর্তমানে পর্যটন ও বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও ধারণের স্থানে পরিণত হয়েছে। গোটা সিল্যান্ডে রয়েছে একটি মাত্র ভবন ও একটি হেলিপ্যাড। বর্তমান কর্তৃপক্ষের দাবী অনুসারে, ২৭ জন মানুষ এখানে বাস করেন। তবে প্রকৃতপক্ষে, এখানে মাত্র ৪ জন স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইন্টারনেটে সিল্যান্ডের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইটও রয়েছে। সেখানে সিল্যান্ডের নানা স্মারক, ডাকটিকিট, মুদ্রা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়াও আপনি চাইলে সিল্যান্ডের লর্ড, ব্যারন, কাউন্ট প্রভৃতি পদবী কিনতে পারবেন। সেই সাথে সিল্যান্ডের পাসপোর্ট করে চাইলে ঘুরেও আসতে পারবেন দেশটি থেকে।
ফিচার ইমেজ – 80runs.co.uk