যারা ভুতে বিশ্বাস করেন না তাদের জন্য আজ এক অভিশপ্ত কেল্লার গল্প বলব। রাজস্থানের আলোয়ার জেলার গোলকবাস গ্রামে এই কেল্লা অবস্থিত। দিল্লি হয়ে জয়পুরের দিকে প্রায় তিন ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত এই কেল্লা৷ সপ্তদশ শতকে তৈরি হয় এটি, তৈরি করেন সম্রাট আকবরের সেনাপতি মান সিং এর ছোট ভাই মাধো সিং। ভারতের রাজস্থানে ভানগড় শহরে তৈরি হয় এই দূর্গ। আর সেই থেকেই এই দূর্গের নাম হয়ে যায় ভানগড় দূর্গ।
কেল্লা এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলেও তার স্থাপত্য নিদর্শনের কিছুটা চিহ্ন এখনও অবশিষ্ট রয়ে গেছে। কেল্লায় ঢোকার দরজার উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। দরজা দিয়ে ঢুকেই বাগান, যার ভগ্ন চিহ্ন থেকে কালের বিলাসিতার কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া যায়। বাগান পেরিয়ে সামনে গেলেই একটা জলাধার, স্থানীয় ভাষা যাকে বলে ‘বউলি’৷
কথিত রয়েছে এই এলাকা থেকে কোনো শব্দ বাইরে যেতে পারে না। যেকোনো শব্দের ধ্বনি এই এলাকার মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়। বাউলির এই অংশ থেকে অনেকেই নাকি নূপুরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। যদিও কেল্লার কোনো শব্দ বাইরে থেকে শোনা যাওয়ার কথা না। এই কেল্লায় এখন পর্যন্ত নেই কোনো ইলেক্ট্রিসিটি। ফলে নিরেট ঘন অন্ধকারে আরও জমাট বেঁধেছে ভূতুড়ে গল্প।
তবে রাজার কেল্লায় ভূত এলো কী করে, কিভাবে এই কেল্লা অভিশপ্ত এবং ভূতুড়ে তা নিয়ে দুটি কাহিনী লোকমুখে বেশ প্রচলিত। একটি হচ্ছে সাধু বালুনাথ আর অপরটি রাজকন্যা রত্নাবতীকে নিয়ে।
মাধু সিং ও সাধু বালুনাথ
স্থানীয়দের নানা তথ্যমতে, মাধু সিং যখন প্রথম ভানগড়ের কেল্লা তৈরি করছিলেন, সেই কেল্লার চত্বরের এককোণেই ছিল সাধু বালুনাথের আশ্রম। তিনি এই কেল্লা তৈরিতে বাঁধা দেন। মাধু সিংকে গুরু বালুনাথ আদেশ দিয়েছিলেন, তিনি কেল্লা বানাচ্ছেন তাতে তার আপত্তি নেই। তবে কেল্লার ছায়া যেন তার আশ্রমের উপর না পড়ে। ছায়া পড়লে তিনি মাধু সিংয়ের এই সাধের কেল্লা ধ্বংস করে দেবেন। এমনকি রাজবংশের কেউকে তিনি বেঁচেও থাকতে দেবেন না!
ভয়েই হোক কিংবা সাধুর প্রতি শ্রদ্ধায়ই হোক, মাধু সিং কথা দিয়েছিলেন, বালুনাথের আদেশ তিনি পালন করবেন। কেল্লা বানানো শেষ হলেও বালুনাথের কথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলেন না মাধু সিং৷ দেখা গেলো দিনের একটা সময়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেল্লার ছায়া বালুনাথের আশ্রমের উপর পড়ত। সেই কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন বালুনাথ। তার তীব্র আক্রোশে ভানগড়ের কেল্লার সঙ্গে গোটা ভানগর রাজ্যও ধ্বংস করে দিলেন!
এই রাজ্যে যে বাড়িগুলো রয়েছে, সেখানে একটি বাড়িরও ছাদ নেই। ভানগড়ে গেলে দেখা যায়, সেখানে বাড়ির অভাব নেই। অথচ কোনো বাড়ির ছাদ নেই। স্থানীয়রা বলেন, গুরুনাথ চেয়েছিলেন এই এলাকায় অন্য কেউ এসে যাতে বসবাস করতে না পারে, সেই কারণেই তিনি বাড়ির ছাদ উড়িয়ে দিয়েছেন।
রাজকন্যা রত্নাবতী ও তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া
ভানগড়ের এই ভূতুড়ে কেল্লার গল্প এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক কাহিনী রয়েছে এই কেল্লাটিকে কেন্দ্র করে। রাজকন্যা রত্নাবতীর গল্প ঠিক সেই রকম। শোনা যায়, বহুকাল আগে এই দূর্গের কছাকাছি এক জায়গায় এক তান্ত্রিক থাকতেন। তার নাম ছিল সিঙ্ঘিয়া। সে রাজকুমারীকে পছন্দ করত। রত্নাবতীর প্রেমে সে ছিল পাগল। ভানগড়ের রাজকুমারী রত্নাবতী বয়ঃপ্রাপ্ত হলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। তন্ত্রবলে তান্ত্রিক বুঝে নেয়, রাজকুমারী তার প্রেমে সাড়া দেবে না।
তাই সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। একদিন রত্নাবতী তার দাসীদের নিয়ে বাজারে সুগন্ধী কিনতে গিয়েছিলেন। তান্ত্রিক সুগন্ধীর উপর জাদুর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। সিঙ্গিয়ার মতলব ছিল, রাজকুমারী এই গন্ধ শুঁকলেই বশীভূত হয়ে পড়বেন ও সিঙ্ঘিয়ার পিছনে পিছন চলে আসবেন। কিন্তু রূপের সঙ্গে রত্নাবতীর বুদ্ধিও ছিল মারাত্মক৷ তিনি সিঙ্ঘিয়ার এই ছল বুঝতে পেরে সুগন্ধীর বোতল একটি পাথরে ছুঁড়ে মারেন। জাদুবলে ওই পাথরটি বশীভূত হয়ে সিঙ্ঘিয়ার পিছনে ছুটতে আরম্ভ করে। আর ওই পাথরের তলায় চাপা পড়েই সিঙ্ঘিয়া মারা যায়। আর মরার সময় সে রাজকুমারীকে অভিশাপ দিয়ে যায়, রাজপরিবারের কাউকে সে বাঁচতে দেবে না, আর রাজকুমারীকে সে মরার পরেও ছাড়বে না।
এই সময় ভানগড় এলাকায় প্রায় দশ হাজার লোকের বসবাস ছিল। এই ঘটনার ঠিক কিছুদিনের মধ্যেই ভানগড়ের সঙ্গে আজবগড়ের যুদ্ধ লাগে। সিংগিয়ার অভিশাপ ফলতে দেরি হয়নি। ভানগড়ের মানুষ সাহসীকতার সাথে লড়াই করলো, কিন্তু আজবগড়ের সৈন্যদের হাতে মারা পড়ল প্রায় সকলে। রাজকন্যা নিজেও ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ দিলেন।
সেই যুদ্ধে রাজপরিবার সহ গোটা ভানগড় ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস ওই কেল্লায় নাকি তান্ত্রিক ও রত্নাবতীর অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেরোয়। আর তাদের সঙ্গে ভানগড়ের অসংখ্য মানুষের আত্মাও কেল্লায় বিরাজমান। এলাকার অনেকেরই বিশ্বাস- সেই আত্মার দল এখনও ভানগড়কে পাহারা দিয়ে চলেছে। রাজকুমারী রত্নাবতী একদিন না একদিন পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসবেন ভানগড় দুর্গে। সেদিন তার হাতে ভানগড়ের শাসনভার ফিরিয়ে দিয়ে তবে তাদের মুক্তি হবে।
এরপর কত শতাব্দী কেটে গেছে। ভানগড় এখনো সেই নিঃশব্দে তার শীতল, হিংস্র পরিত্যক্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরাবল্লীর কোলে। এ কেল্লা আর তার আশেপাশের নগরী অভিশপ্ত হিসেবে পরিচিতি পায় সারা ভারতজুড়ে। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা আসেন দেখতে। তবে সকলে এই কেল্লার বাতাসে একটা তীব্র আতংকের স্পর্শ অনুভব করে থকে। কেল্লাকে ঘিরে একের পর এক গল্প তৈরি হলেও কেউ স্বচক্ষে ভুতের দেখা পায়নি৷
তবে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে এক কড়া নির্দেশ- ‘ভানগড় এলাকায় সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ।’ কেউ এই আদেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ভারত সরকার কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে বলে কেল্লার পাশেই এক সাইনবোর্ড ঝোলানো রয়েছে।
বিশ্বের সেরা দশটি হন্টেড জায়গার মধ্যে একটা এই ভানগড়ের কেল্লা। সন্ধ্যা নামার আগেই এলাকাটি থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরে যাওয়া নিরাপদ মনে করে এলাকার লোকজন। বার দুয়েক কিছু দুঃসাহসী সেখানে রাতের অন্ধকারে ঢোকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। বেশ কিছুকাল আগে দুই স্থানীয় দুঃসাহসী তরুণ সন্ধের পর সে দুর্গের পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকেছিল। কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। মারা গেছে কিনা তা কেউ বলতে পারে না। শুধু তাদের আর কোনোদিন দেখা যায়নি।
এর বেশ কিছুদিন পর তিনজনের একটা দল ভূতের অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য আলো জালিয়ে, থাকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে দূর্গের মধ্যে ঢুকে যায়। রাতে এক বন্ধু সেই দূর্গে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তার সঙ্গী তাকে নিষেধ করেছিল। কিন্তু সেই বন্ধুকে কিছুতেই টলানো যায়নি। দূর্গে রাত কাটাতে গেলেন সেই অবিশ্বাসী লোক। তার অপেক্ষায় বন্ধু ও গাড়ির ড্রাইভার গাড়িতে থেকে যায়।
পরদিন ভোর হলে কেল্লার ভিতরের বন্ধুকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাকে যখন দ্রুত গতিতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন গাড়িটি দূর্ঘটনার শিকার হয়। আর তাতে মারা যায় দুই বন্ধু সহ গাড়ির ড্রাইভার। আর এরপর থেকেই সেই কেল্লায় রাত কাটানো একবারেই নিষেধ হয়ে যায়। এভাবেই কেল্লাটি হয়ে পড়ে অভিশপ্ত ও ভূতুড়ে।