কফি হাউজে বসে আছি। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের সেই বিখ্যাত কফি হাউজ। হ্যাঁ, মান্না দে’র সেই কফি হাউজ। এই কফি হাউজই ছিল এককালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল। নিকটতম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী-লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার অবারিত জায়গা হিসেবে এটি খ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরনো বইয়ের বাজার ও নতুন বইয়ের বাজার সামনে আছে বলে হাউজটিতে সব সময়েই ভিড় থাকে।
অনেকক্ষণ হলো এসেছি, কিন্তু ফাঁকা চেয়ার পাইনি। তাই দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। চেয়ারের জন্য পাশে দাঁড়িয়ে কলকাতার নানা এলাকার পঞ্চায়েত বা তৃণমূলের আলোচনা থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য, ব্যক্তিগত আলোচনা সব হজম করতে হলো। অবশেষে চেয়ার পেলাম। বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম একসময় কফি হাউজ ছিল না। অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নামকরণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউজটির নাম। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ বসু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তি আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে। এসব ভেবেই রোমাঞ্চিত হলাম।হয়ত যে চেয়ারে বসে আছি সেখানেই একদিন সত্যজিত রায় তার লেখা বা চলচ্চিত্র নিয়ে আড্ডা দিতেন।
কফি হাউজের ভিতর অন্যরকম এক পরিবেশ। দোতলার কোনার এক চেয়ারে বসে আছি, অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করতে লাগলো। বিশাল একটি পুরনো হলরুমের মধ্যে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল ঠাসাঠাসি করে বসানো। উপরে ফ্যান ঝুলছে, মানুষেরও অভাব নেই সেখানে। কেউ কফি পান করছেন, কেউ ধূমপান করছেন আর কেউ বা খোশগল্প। মান্না দে’র গান শুনে অনেকে ভেবে থাকবেন, হয়ত মান্না দে’র মতো পরিণত আর কবি-সাংবাদিকরাই বুঝি সেখানে যান। কিন্তু তা নয়, এখানে তরুণ থেকে শুরু করে যুবক, বয়স্ক, এমনকি প্রেমিক যুগলরাও কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। এত মানুষের উপস্থিতিতে পুরো কফি হাউজ যেন গমগম করছিলো।
দিনেও কফি হাউজে প্রচুর ভিড় থাকে। ঐ সময়টার ভিড়ে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরই বেশি দেখা যায়। কফি হাউজটি কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত। আর কলেজ স্ট্রিটে স্কুল-কলেজের সব ছাত্রছাত্রীর আনাগোনা থাকে সকাল থেকে রাত অবধি। কফি হাউজের পাশেই হিন্দু স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজ। এছাড়াও কলেজ স্ট্রিট হলো কলকাতার প্রধান বই প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্র। এখানে তাই শিক্ষার্থী ও সাহিত্যপ্রেমীদের জটলা সবসময় থাকে। তাই এই অঞ্চলটিকে বইপাড়া বলা হয়। আনন্দ পাবলিশার্স, দে’জ পাবলিশিং, রুপা অ্যান্ড কোং, দেব সাহিত্য কুটির, সাহিত্যম, পত্র ভারতী প্রভৃতি প্রধান বাংলা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রধান কার্যালয় এখানেই অবস্থিত। রাস্তার দু’ধারে বইয়ের অনেক ছোট ছোট দোকান আছে। এখানে পুরনো ও নতুন বই ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশের বই পাওয়া যায়। এখানে আসলে অনেকটা আমাদের ঢাকার নীলক্ষেতের মতো মনে হয়। ২০০৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের “বেস্ট অফ এশিয়া” তালিকায় ভারতের উল্লেখযোগ্য স্থানের স্বীকৃতি পায় কলেজ স্ট্রিট। কলেজ স্ট্রিট পৃথিবীর বাংলা বইয়ের বৃহত্তম বাজার। শুধু কি তা-ই? এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরনো বইয়ের বাজার। আর ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার। তাই আজও গোটা উপমহাদেশে কলেজ স্ট্রিটের নাম মানুষের মুখে মুখে।
স্মিথসোনিয়ান পত্রিকার একটি নিবন্ধে কলেজ স্ট্রিট সম্পর্কে বলা হয়েছে, “...(কলেজ স্ট্রিট) আধ-কিলোমিটার লম্বা বইয়ের দোকানে ভরা রাস্তা। এর দু’পাশের ফুটপাতে প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত বইপত্র পাওয়া যায়। এমনকি ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডে আউট-অফ-প্রিন্ট হয়ে যাওয়া অনেক বই-ই এখানে পাওয়া যায়।“
কলেজ স্ট্রিটে খুঁজলে পাবেন না এমন বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। আমি যাচাই করবার জন্য ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনীর বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম, পেয়েও গেলাম। এমনকি এক দোকানে কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রীকে হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের খোঁজ করতে দেখলাম। আমি সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হুমায়ুন আহমেদের কোন কোন বই পড়া আছে? অবাক হয়ে গেলাম, গরগর করে অনেকগুলো বইয়ের নাম বলে দিলেন। আলাপ-পরিচয়ের ফাঁকে যখন জানতে পারলেন ঢাকা থেকে এসেছি, তখন হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর সাথে কখনো দেখা হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। হুমায়ুন আহমেদ স্যার একসময় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী পরিচয় পেয়ে তার আগ্রহ যেন আরো বেড়ে গেলো। জানতে পারলাম, তিনি কলেজ স্ট্রিটের ধারের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কলেজ স্ট্রিটের ধারে আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই রাস্তার ধারে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হলো:
১. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮১৮ সালে কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত; উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান)
২. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়)
৩. কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, এশিয়ার প্রথম মেডিকেল কলেজ)
৪. সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ)
৫. ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত, ভারতের প্রথম এমবিএ পাঠের শিক্ষাকেন্দ্র)
৬. হেয়ার স্কুল (১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত)
৭. হিন্দু স্কুল (১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস পূর্ব-পশ্চিম এ ঘটনার আবহে এই কফি হাউজ ও কলেজ স্ট্রিটের চিত্র ফুটে উঠেছে বারবার। পূর্ব-পশ্চিমের কথা মনে পড়তেই কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের এই কফি হাউজে বসে তাই ১৯৪৭ এর দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলা থেকে কলকাতায় পাড়ি জমানো গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষগুলোর জীবন সংগ্রামের কথা মনে পড়তে লাগলো। পূর্ব বাংলা থেকে সহায় সম্বলহীন, গৃহহীন মানুষগুলো, যাদের এই কলকাতার সভ্য মানুষেরা বাঙ্গাল বলে ডাকত, তারা কতটা লড়াই ও সংগ্রাম করে আজ এই কলকাতায় নিজেদের স্থায়ী ভিত গড়েছে। বাঙ্গালরা দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে একেবারে নিঃস্ব থেকে শুরু করে জীবনে সফল হতে হয়। তারা একদিন এই কলকাতায় ছিল শরণার্থী হিসেবে। আর দীর্ঘ জীবন যুদ্ধের পর তারা আজ সফল।
কফি হাউজ ও কলেজ স্ট্রিট একে অপরের পরিপূরক। একসময় কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো কলকাতার নামকরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কলেজ স্ট্রিটজুড়ে যখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তখনই বহু ব্যবসায়ী এই কলেজ স্ট্রিটে এসে বইয়ের দোকান খোলেন। তারপর ধীরে ধীরে কলেজ স্ট্রিট একসময় হয়ে ওঠে কলকাতার বইয়ের সেরা বাজার। সেই সাথে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে এখানে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক সেই কফি হাউস, দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন ইত্যাদি। কলেজ স্ট্রিটকে আরও বিখ্যাত করেছে ঐতিহাসিক এই কফি হাউস। কলেজ স্ট্রিট ও কফি হাউজ এখন সমার্থক হয়ে গেছে। কারণ, কলেজ স্ট্রিট যেমন বইয়ের প্রাণ, বইয়ের সূতিকাগার, তেমনি কলেজ স্ট্রিটের প্রাণ এই কফি হাউস। তাই তো দেশ-বিদেশের বিজ্ঞজ্জনেরা এখনো কলকাতায় এলে পা রাখেন এই কলেজ স্ট্রিটে বই কেনার জন্য আর এক কাপ কফি পান করতে কফি হাউসে।
টেবিলে এসে বেয়াড়া দুই একবার দেখে গেলেন। আশ পাশেও অনেকে আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। এতক্ষণ লিখছিলাম তাই খেয়াল করিনি। কফি হাউজে বসেই কফি হাউজকে নিয়ে লেখার লোভটা সামলাতে পারিনি। কফি যেমনটা ছিল তেমনি টেবিলে রয়ে গেছে। ঠান্ডা কফি কোনোরকমে গলাধঃকরণ করতেই সাইরেন বেজে উঠলো। এবার কফি হাউজ বন্ধ হবে, তাই আমাকেও উঠতে হবে।
হলুদ ট্যাক্সি করে হোটেলে ফেরার সময় মনে হচ্ছিলো কে যেন গেয়ে চলেছেন,
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই, আজ আর নেই.
…
কত স্বপ্নের রোদ উঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।“
ফিচার ইমেজ: roundglass.