মনোলেক: অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া এক ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে  সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার কোল ঘেঁষে অবস্থিত ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্ক থেকে ১৩ কি.মি. উত্তরে গেলে পড়বে লি ভাইনিং নামের পাহাড়ি শহর। শহরের পাশেই অবস্থিত অনিন্দ্যসুন্দর মনোলেক।

অপরূপ মনোলেক; Image Source:youtube

মনোলেক নামটি পর্যটক আর গবেষক মহলে সমান সমাদৃত। মনোলেকের নীল জলে বরফঢাকা সিয়েরা নেভারার প্রতিফলন যে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের অবতারণা করে তা যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করে, তেমনি লেকের জটিল বাস্তুসংস্থান এবং অনন্য ভূতাত্ত্বিক গঠন সারা দুনিয়ার গবেষকদেরও টেনে আনে মনোলেকের তীরে। উত্তর আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন ও ক্যালিফোর্নিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক এটি। এই লেকটি তৈরি হয়েছিল ৭,৬০০০০ বছর পূর্বে, গত বরফ যুগের সময়ে। আগ্নেয়গিরি বেষ্টিত এই লেকটি ৭৮০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। আর এর গভীর নীল জলরাশির গভীরতা ৯০০ ফুট বা ২৭০ মিটার।

মনোলেক একটি বদ্ধ লেক। এর কোনো শাখা-প্রশাখা নেই যেগুলো সাগরে পানি বয়ে নিয়ে যাবে। পাহাড়ি ঝর্ণা ও আশেপাশের নালাগুলো থেকে আসা পানি এই লেকের জলের যোগান দেয়। এছাড়া লেকে রয়েছে ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা। মনোলেকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অস্বাভাবিক লবণাক্ততা এবং সুউচ্চ টুফা টাওয়ার (tufa towers)

দৃষ্টিনন্দন টুফা টাওয়ার; Image Source: undergroundnerdd

একসময় টুফা টাওয়ারগুলো লেকের জলেই নিমজ্জিত ছিল। আজকের মনোলেক তার টুফা টাওয়ার দিয়ে হয়ত পর্যটকদের টানতে পেরেছে কিন্তু এর জন্য চড়া মূল্যও দিতে হয়েছে। তবে দোষটা তো আর লেকের নয়! দোষটা লস এঞ্জেলস শহর কতৃপক্ষের। ১৯৪১ সালে লস এঞ্জেলসের Department water and power এর উদ্যোগে খাল কেটে মনোলেকের পানি নিয়ে যাওয়া হয় লেক থেকে ৩০০ মাইল দক্ষিণে। এতে মনোলেকের পানির পরিমাণ অস্বাভাবিক হ্রাস পায়। এর গভীরতা কমে গিয়ে অর্ধেকে নেমে আসে। লেকহত্যার এই নিষ্ঠুর প্রক্রিয়াটি চলতেই থাকে যতক্ষণ না ১৯৭৮ সালে David Gaines এর নেতৃত্বে ‘মনোলেক সংরক্ষণ কমিটি’ গঠিত হয় এবং পানি স্থানান্তরকে বাধা দেয়। কমিটির দৃঢ়সংকল্প আর কঠোর চেষ্টায় লেকটি অবশেষে রক্ষা পায়। তবে এতদিনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।

মনোলেক একটি বদ্ধ লেক হওয়ায় এর পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাওয়া ছাড়া পানির হারানোর বা চলাচলের অন্য কোনো পথ নেই। লেকের পানি রোদে বাষ্পীভূত হয় কিন্তু খনিজগুলো পানিতে রয়ে যায়। এজন্য লেকের লবণাক্ততা অনেক বেশি বেড়ে যায়। লেকটিতে প্রায় ২৮০ মিলিয়ন টন লবণ দ্রবীভূত আছে। অবশ্য লবণাক্ততা পানির পরিমাণের উপর অনেকটাই নির্ভর করে। পানি স্থানান্তরের আগে লেকের অগভীর পানি এবং গভীর পানি বছরে অন্তত একবার পরস্পরের সাথে মিশ্রিত হতো। ফলে গভীর পানি কিছু অক্সিজেন পেত। কিন্তু পানি স্থানান্তরের পরের সময়টাতে বিভিন্ন স্তরের পানির মিশ্রণ আর ঘটে না। ফলে গভীর পানি হয়ে পড়ে অনেক বেশি লবণাক্ত।
অস্বাভাবিক লবণাক্ততার কারণে লেকটি অসম্ভব ক্ষারীয়। অস্বাভাবিক ক্ষারীয় হওয়ার পরও মনোলেকের রয়েছে অনন্য এবং ভীষণ উৎপাদনশীল বাস্তসংস্থান এবং জটিল খাদ্যজালের সমাবেশ। লেকের পানিতে কোনো মাছ নেই। তবে জীবন এই রুক্ষ পরিবেশেও এগিয়ে চলেছে। লেকের জলে প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হয় শীতকালে এককোষী সবুজ শৈবালের মাধ্যমে। মার্চ মাসে লেকের পানি ঘন সবুজ মটরশুঁটির স্যুপের মতো হয়ে যায়। সবুজ শৈবাল খাবার হয় লেকের এন্ডেমিক প্রাণী খুদে ব্রাইন শ্রিম্প ও কালো মাছির।

ব্রাইন শ্রিম্প; Image Source: bettaboxx.com

ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্রাইন শ্রিম্পের আখড়া এই লেক। আর লেকের পাশের জমিতে উড়ে বেড়ানো কাল মাছি বা অ্যালকেলি মাছিরও আছে মজার দিক। এই মাছির লার্ভা খায় স্থানীয় কুটজাডিকা ইন্ডিয়ানরা। তারা একে বলে কুটসাভি।

মনো লেকের কালো মাছি; Image Source: science source

তো এই মাছি আর ব্রাইন শ্রিম্প আবার পরিণত হয় ক্যালিফোর্নিয়া গালসহ প্রায় একশ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির খাদ্যে। লেকের পানি কমে যাওয়ায় এখন পাখির পরিমাণ কমে গেছে। তারপরও মনোলেককে পাখি ও পাখিপ্রেমীদের স্বর্গোদ্যান বলা যেতে পারে। এখনো মিলিয়নেরও বেশি পাখির আশ্রয়স্থল লেকটি।

মনোলেকে অগণিত পরিযায়ী পাখির আনাগোনা চোখে পড়ে; Image Source: North america nature photography association 

এখন বলব টুফা টাওয়ারের কথা। বিস্ময়কর এই গঠনগুলোর সৃষ্টির প্রক্রিয়াও কম বিস্ময়ের নয়।
আগেই বলেছি লেকের পানি ক্ষারীয়। পানি কতটা ক্ষারীয় হবে, তা নির্ভর করে পানিতে কতটা ক্ষার আছে তার উপর। লেকের পানিতে কার্বনেট আয়ন আছে, যা ক্ষারীয়। ভূগর্ভস্থ ঝর্ণার পানি চলে যায় একদম লেকের তলদেশে। এই পানিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। লোনাপানির কার্বনেট আর স্বাদুপানির ক্যালসিয়াম বিক্রিয়া করে তৈরি করে ক্যালসিয়াম কার্বনেট যা লেকের তলায় জমতে থাকে। জমতে জমতে একসময় বিশাল উঁচু স্তম্ভ হয়ে যায়। তখন এদেরকে বলা হয় টুফা টাওয়ার। টুফা টাওয়ার নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ ভালোই গবেষণা হয়েছে এবং টুফার বাহ্যিক গঠনের উপর ভিত্তি করে তারা টুফাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন-
১. লিথোয়েড টুফা: বিশালাকৃতির, ফুটোযুক্ত, পাথরের মতো দেখতে এই টুফাগুলো।
২. ডেনড্রাইটিক টুফা: উদ্ভিদের মতো এদের শাখা-প্রশাখা আছে।
৩. থিনোলিটিক টুফা: এরা দেখতে ক্রিস্টালের মতো। কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা হয়।

লেকের গভীরতা যখন বেশি ছিল, তখন এগুলো দেখা যেত না। গভীরতা কমে যাওয়ায় টুফা টাওয়ারগুলো দৃশ্যমান হয় এবং মনোলেক ধরা দেয় ভিন্ন রূপে। এখন এই টুফা টাওয়ার দেখতে ভিড় জমায় অসংখ্য পর্যটকের দল। লেকের স্বচ্ছ নীল জলও টানে অভিযানপ্রেমীদের।

লেকের জলে সাঁতার কাটা, ক্যানু আর কায়াকে চড়ে জল ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চায় তারা।

মনো লেকে ক্যানু ভ্রমণ; Image Source: Norcal yak

লেকের শান্ত সমাহিত প্রকৃতিকে ক্যামেরাবন্দী করতে ফটোগ্রাফারদেরও আসতে দেখা যায় এখানে। এছাড়া মোহনীয় এই লেকের তীরে রয়েছে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা। আর ট্রেইল ধরে হাইকিং আর অবিরাম ঘোরাঘুরির সুযোগ তো রয়েছেই। চলুন জেনে আসি মনোলেকে বেড়াতে গেলে কোথায় কোথায় ঘুরবেন, সে সম্পর্কে।

সাউথ টুফা

সাউথ টুফা এলাকা; Image Source: tripadvisor

প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকে মুখর হয় সাউথ টুফা। এখানে রয়েছে লেকের সবচেয়ে বড় টুফা টাওয়ারটি। এখান থেকে রয়েছে পাখি দেখার সুবর্ণ সুযোগ। গাইডের সহায়তা নিয়ে ঘুরে আসা যায় টুফা টাওয়ার থেকেও।

ওল্ড মেরিনা

হাইওয়ে ৩৯৫ এর ধার ঘেঁষে অবস্থিত ওল্ড মেরিনা জায়গাটি থেকে দারুণভাবে চোখে পড়ে মনোলেক। এছাড়া বেশ কিছু টুফা টাওয়ার আর লেকের দুইটি দ্বীপেরও দেখা মেলে এখান থেকে।

পানুম ক্রেটার

মনোলেকের যে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো আছে সেগুলো কোনো দর্শনার্থীদেরই দেখতে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। জাঁকালো রূপের এই নতুন আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে যেকোনো সময় অগ্ন্যুৎপাত ঘটতে পারে। সবচেয়ে উত্তরের জ্বালামুখটি হচ্ছে পানুম ক্রেটার।

নেভি বিচ

কায়াক ও ক্যানু লেকে নামানোর সবচেয়ে আদর্শ জায়গা হচ্ছে নেভি বিচ। এটি সাউফ টুফার সাথে একটি সরু পথ দিয়ে যুক্ত হয়েছে।

কাউন্টি পার্ক

ইউএস হাইওয়ে ৩৯৫ এর পাশেই রয়েছে এই পিকনিক স্পট। এখান সহজেই হেঁটে মনোলেকে যাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে এখানে পাখিদেরও হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়।

সূর্যাস্তের সময় মনোলেক সাজে বর্ণিল রূপে।

মনোলেকে চোখধাঁধানো সূর্যাস্ত; Image Source: Edin chavoz 

কমলা-লাল আকাশের পটভূমিতে লেকের জলে দাঁড়িয়ে থাকা চুনাপাথরের টুফা টাওয়ারগুলো দেখতে অপার্থিব লাগে। সূর্যোদয়ের মনোলেকও অবিশ্বাস্য সুন্দর। মনোলেকের পানি স্থানান্তরের ফলে প্রায় মারা পড়তে যাওয়া লেকটি এখনো বেঁচে আছে। বেঁচে আছে বুকে অপরূপ রূপ-সুষমা নিয়ে। বেঁচে থাকুক মনোলেক আর এর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্য।

ফিচার ইমেজ- Environmental law history

Related Articles

Exit mobile version