সূর্য তখন দিগন্তরেখার খুব কাছে। দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে আসছে, ঝেঁকে বসছে অন্ধকার। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। পেছনে নির্জন ম্যানগ্রোভ বন। থেকে থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। মাঝে সবুজ বেলাভূমি। আমরা হেঁটে যাচ্ছি এক অপার্থিব টানে, বেলাভূমির সবুজ মাড়িয়ে।
ঘাট থেকে হাঁটা শুরু। সেটা এখন অনেকদূর। হেঁটে চলেছি অবিরাম।
হলুদ গেঞ্জি, পরনে লুংগি, খালি পা। রোদে পোড়া চেহারা, খোচা খোচা দাড়ি, একহাতে দা, আরেক হাতে সিগারেট, জ্বলজ্বলে দুটি রক্তিম চোখ; এক অচেনা লোক বেশ দূর থেকে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। লোকটা কখন যে আমাদের পিছু পিছু এতদূর চলে এলো খেয়ালই করতে পারিনি। এ কি সত্যই কাঠুরিয়া নাকি অন্য কেউ? সম্বিৎ ফিরে পেলাম। পেছনের পথ দেখেই গা শিউরে উঠল। আমরা তো অনেক দূর চলে এসেছি! অথচ আমাদের কেবলই মনে হচ্ছিল, “এই না হাঁটা শুরু করছি, এতদূর এলাম কীভাবে?” সূর্য ডোবার বাকি নেই। ফিরতে ফিরতে রাত হবে নিশ্চিত। তার উপর একজন আগন্তুক আমাদের চুপি চুপি অনুসরণ করছে। ভয় মাথাচাড়া দিল।
আমাদের গাইডের দিকে তাকালাম; স্থানীয় ছেলে, সে-ও খেয়াল করল। উঁচু আওয়াজে স্থানীয় ভাষায় আমাদের সাথে কথা বলার ছলে কিছু বুলি আওড়াল। আমরা নিষ্প্রভ। কিছুক্ষণ পর আড়চোখে আবার তাকালাম পেছনে, দেখি অনুসরণকারী সেই লোকটি আর নেই। যাক, আপাতত বাঁচা গেল!
নাটক-সিনেমায় ক্লাইমেক্স থাকে। থাকে ভ্রমণেও। আমাদের মুরাদপুর সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের ক্লাইমেক্সও সম্ভবত এটাই।
“মুরাদপুর সমুদ্র সৈকত!” ভাবছেন, এটি আবার কোথায়? নামও নিশ্চয়ই শোনেননি অনেকে। দেখার তো প্রশ্নই আসে না। গুগল কিংবা ইউটিউবে এ সৈকতটি নিয়ে কোনো কনটেন্ট কিংবা ছবি নেই বললেই চলে। আপনি যদি মুরাদপুর সৈকত লিখে গুগল করেন তবে যেসব ভিডিও বা ছবি দেখবেন তার প্রায় সবগুলোই গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের।
সেটা কি সার্চ ইঞ্জিনের দোষ তবে? হ্যাঁ, কিছুটা! আবার শতভাগ দোষ সার্চ ইঞ্জিনকেও দেয়া যায় না। কেন? সেই কথায় আসছি একটু পরে।
বসন্তের প্রায় শেষ। সীতাকুণ্ড সদরে বসবাসরত এক ছোট ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল সীতাকুণ্ডের আশপাশের কোনো এক জায়গায় বন্ধুদের নিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে তাদের এক দুর্দান্ত সমুদ্র সৈকতে গিয়ে ওঠার বিষয়ে। আমরা জানতাম সীতাকুণ্ড সদরের খুব কাছে রয়েছে বিখ্যাত গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। কিন্তু সে আমাদের জানাল, তাদের হারিয়ে পাওয়া সৈকতটি আর যা-ই হোক গুলিয়াখালী না। সেখানে তারা গিয়েছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে সীতাকুণ্ড সদরের আরো মাইলখানেক দক্ষিণে গিয়ে এবং হাইওয়ে থেকে পশ্চিমের কোনো এক রাস্তা দিয়ে। অন্যদিকে গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত যেতে হয় সীতাকুণ্ড সদরের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে সোজা পশ্চিমে।
তাকে সাথে সাথে বললাম, দ্রুত খবর নাও, আমরা সেখানেই আসছি!
ম্যাপ দেখে এবং আরো কিছু খবর নিয়ে সে নিশ্চিত হলো সৈকতটির অবস্থান সীতাকুণ্ড ফকিরহাটের মুরাদপুর ইউনিয়নে। অবশেষে চৈত্রের এক পড়ন্ত বিকেলে চট্টগ্রাম শহর থেকে আমরা রওনা দিলাম মুরাদপুর সৈকতের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড যাওয়ার জন্য রয়েছে বেশ কিছু বাস। উত্তরা, সতেরো নাম্বার, আট নাম্বার সেসবের মধ্যে অন্যতম। আমরা আট নম্বরে চেপে রওনা দিলাম। ভাড়া জনপ্রতি ৪০ টাকা। ঘন্টা দেড়েক পরেই আমরা পৌঁছে যাই মুরাদপুর ফকিরহাটে। ফকিরহাট নেমে পশ্চিমের রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। সিএনজিযোগেই যেতে হয়। ভাড়া পড়ে সিএনজিপ্রতি ৮০-১০০ টাকা।
এখানে ড্রাইভাররা সাধারণত মুরাদপুর সৈকত বললে চেনেন না। তারা গুলিয়াখালী ভেবে ভুল করেন। মুরাদপুর ঘাট বললে তারা ভাল বোঝেন। কারণ মুরাদপুর সৈকতটি যেখানে, সেই জায়গা আগে সন্দ্বীপ পারাপারের ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ঘাটের নিলাম ডাক বেশি হওয়ায় ইজারাদাররা এটি এখন আর ইজারা নেন না। এখন সেখানে ঘাট নেই৷ তবুও পরিচয় মুরাদপুর ঘাট হিসেবেই রয়ে গেছে। মুরাদপুর ঘাট অর্থাৎ মুরাদপুর সৈকত যেতে যেতে ড্রাইভারই আমাদের এসব তথ্য জানান।
দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, পিচঢালা নির্জন পথ, রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর গাছ দেখতে দেখতে অটোরিক্সা পৌঁছে যায় মুরাদপুর ঘাটে। সেখানে নেমে শুনশান নীরব দোকানপাট দেখে আঁচ করলাম ঘাট ঘিরে এখানে একসময় প্রাণচাঞ্চল্য ছিল।ঘাট থেকে সৈকত আরও পশ্চিমে। ১৫-২০ মিনিটের হাঁটার পথ।
পথের কিছু কিছু অংশ জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। ফলে মাঝে মাঝে পথটি কাদা আর পানিতে দুর্গম হয়ে ওঠে। পথের পাশে বয়ে গেছে একটি ছোট খাল। মেঠোপথ, শান্ত খাল, আর আমরা। সবাই সমান্তরালে এগিয়ে চলছি এক অন্যরকম সমুদ্রতীরের দিকে, অভিন্ন লক্ষ্যে।
পথে কিছু কালভার্ট চোখে পড়ে, চোখে পড়ে কিছু জরাজীর্ণ কাঠের সাঁকো। সন্দ্বীপ পারাপারের যাত্রীদের সুবিধের জন্য যেগুলো নির্মিত হয়েছিল। এখন ঘাট নেই, তাই সেসব পরিত্যক্ত। খালে কদাচিৎ দু-একটি কাঠের নৌকা চোখে পড়ে, চোখে পড়ে জেলেদের মাছ ধরে ফেরার দৃশ্য।
সমুদ্রতীরের কাছে পৌঁছে দেখতে পাওয়া যায় এক বিশাল, বিস্তৃত সবুজ বেলাভূমি। বেলাভূমি জুড়ে ছড়িয়ে আছে জেলেদের মাছ ধরার জাল। দেখা মেলে ছোট কিছু গরু-ছাগলের পাল। সাথে আছে রাখাল।
বেলাভূমি পেরোবার পরই দেখা মেলে সমুদ্রের ঊর্মিমালা, যার তরঙ্গে গা এলিয়ে ভেসে আছে কিছু বিশালকায় ট্রলার।
মুরাদপুর সৈকতটির দুটি অংশ। উত্তরের অংশে দেখতে পাওয়া যায় মুরাদপুর খাল আর তার মোহময় মোহনা। অর্থাৎ এখানেই প্রসারিত হয়ে খালটি সমুদ্রে পড়েছে। আর সেই খাল পেরিয়ে আরো উত্তরে গেলে দেখা মেলে গুলিয়াখালী বিচ। এখানেই মুরাদপুর সৈকতের সাথে গুলিয়াখালীর প্রাসঙ্গিকতা।
মুরাদপুর সৈকতের দক্ষিণের অংশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। এটিই এই সৈকতের মূল অংশ। এই বনের কাছে এসেই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। ঘন কেওড়া বন, অগণিত শ্বাসমূল, শেষ জোয়ারের প্লাবনদাগ, লাল সাদা কাকড়ার লুকোচুরি। এ যেন দৈবে নেমে আসা একটুকরো সুন্দরবন। বনের কিনারা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে এক অপার্থিব মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলাম। পশ্চিমে বসন্তের শান্ত সাগর, পূর্বে নির্জন বন, মাঝখানে আমরা। চারদিকে নীড়ে ফেরায় ব্যস্ত পাখিদের কিচিরমিচির গান। সে এক নির্জন মহাসমারোহ।
পর্যটকের ভীড় নেই, যত্রতত্র দোকানপাট নেই, চিপস কিংবা আচারের জঞ্জাল নেই। নির্জন বন, সবুজ বেলাভূমি, নীল সমুদ্র আর আপনি। এমন নিষ্কলুষ প্রকৃতি নিজ থেকে এসে কখনও ধরা দেয় না। একে ধরে নিতে হয়, খুঁজে নিতে হয়। এজন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়। এক-আধটু কাদাপানি অন্তত মাড়াতে হয়। নিরাপত্তার ঝুঁকিও মাঝে মাঝে এসে যায়।
মুরাদ সৈকতের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এটি লোকালয় থেকে অনেক দূরে। সুতরাং যে কেউ চাইলেই নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। শুরুতেই যেমন আভাস পেয়েছেন, আমাদের ক্ষেত্রে সেটি প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যগুণেই হয়তো বেঁচেছি। তাই এখানে আসার আগে নিরাপত্তা ঝুঁকির ব্যাপারটি মাথায় রাখা চাই। দল ভারী হলে অথবা স্থানীয় কাউকে গাইড হিসেবে নিতে পারলে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
যা-ই হোক, শেষ বিকেলে ডুবন্ত সূর্যের মুগ্ধতা ভুলে পেছনে বনের দিকে চোখ পড়তেই দেখি দুটি খেঁকশিয়াল আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভয় পাওয়া উচিত নাকি মুগ্ধ হওয়া? বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে এটা বুঝতে কষ্ট হয়নি যে সে আমাদের সংকেত দিচ্ছে- বনের ধারে আর থাকা যাবে না, দ্রুত ফিরতে হবে। আমরাও সুবোধ বালকের মতো ফিরতে শুরু করি; নীড়ে ফেরা পাখির মতো। শেয়াল দুটিও কী বুঝে জানি না আবার বনে ফিরে যায়। আমরা নিষ্ক্রান্ত হলেই হয়তো আবার নেমে আসবে, বন ছেড়ে মাঠে।